অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

লিলির যেচিঠির জন্যে পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছিলাম, সেচিঠি এসে গেছেলিলি গােটা গােটা হরফে লিখেছে, আমি জানি, তুই রাগ করেছিস

অচিনপুর

কত দিন হল গিয়েছি, কিন্তু কখনাে তাের কাছে চিঠি লিখি নিকী করব বল? এমন খারাপ অবস্থা গেছে আমার! তাের দুলাভাইয়ের চাকরি নেইবসতবাটিও পদ্মায় ভেঙে নিয়েছেএকেবারে ভিক্ষা করবার মতাে অবস্থাকত দিন যে মাত্র বেলা খেয়েছিতারপর আবার তাের দুলাভাইয়ের অসুখ হলমরােমরাে অবস্থা! এখন অবশ্যি ঠিক হয়ে গেছে সবতুই অতি অবশ্যি এসে যা রঞ্জু। 

লিলির চিঠি পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াইসবাইকে ছেড়ে যেতে বড়াে মায়া লাগেআশৈশব পরিচিত এ বাড়িঘরবাদশা মামা, নানাজান, লাল মামী, নবু মামা এদের সবার স্মৃতির গন্ধ নিয়ে যেবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ছেড়ে কী করে যাই? আমি উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়াতে লাগলামসােনাখালির পুলের উপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকিনৌকা নিয়ে চলে যাই হলদেপােতাখুব জোছনা হলে সফুরা খালাকে নিযে পুকুরঘাটে বেড়াতে যাইসফুরা খালা বলেন, তুমি কবে যাবে 

যেকোনাে এক দিন যাব‘ 

সেই যেকোনাে এক দিনটা কবে? ‘হবে এক দিন। 

অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

একে রাতে সফুরা খালা কাঁদেনশর গভীর বিষাদ বােঝবার ক্ষমতা আমার নেইবুঝতে চাই নাযেবন্ধন আমাকে এখানে আটকে রেখেছে, কবে তা কাটবে, কবে চলে যাবতাই ভাবিনানাজানও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন, তােমার যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে

নাতােমার আর লিলির নামে যেমিজমা আছে, তার কী হবে

যেমন আছে তেমন থাকবেনানাজান কথা বললেন নাআমি জানি এই জমিটুকুই তাঁদের অবলম্বন। 

সে রাতে ভীষণ শীত পড়েছিলসন্ধ্যা না নামতেই ঘন কুয়াশা চারিদিক আচ্ছন্নকরে ফেললরাতের খাওয়ার পর হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে আসছি, হঠাৎ দেখি বাদশা মামা দারুণ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত আসছেনআমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। 

, দেখ দেখ। 

আমি তাকিয়ে দেখলাম, একটু দূরে, লাল মামী একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেনবাদশা মামা বলে চলেছেন,নৌকা করে সন্ধ্যার আগেই এরা দুজন এসেছে। চুপচাপ বসে ছিলআমি মসজিদে যাব বলে ওজু করতে গিয়েছি, এমন সময়...। 

লাল মামী বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন{যে উঠোনে অনেক অনেক দিন আগে আমার মা তাঁদুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছিলেনকেউ কোনাে কথা বলল নানানাজান চিত্রার্পিতের মতাে দাঁড়িয়ে রইলেনছােট নানিজান যেন কিছুই বুঝছেন না, এমন ভঙ্গিতে তাকাতে লাগলেনসফুরা খালা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি নিচে নেমে এলেনবাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তাের গরম শালটা কোথায় সফুরা? এলাচির শীত করছে। 

অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

নবু মামার কথা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল নাসবাই চুপ করে রইলএকসময় দেখলাম লাল মামী কাঁদছেন। 

আমি চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে বসে ঝিঝির ডাক শুনতে লাগলামঅনেক রাতে বাদশা মামা আমাকে ডেকে নিলেনমৃদু ভৎসনার সুরে বললেন, তােরা সবাই যদি দূরে দূরে থাকিস, তাহলে এলাচি কী মনে করবে বল? চল রঞ্জু। 

বাদশা মামা আমার হাত ধরলেন। 

বহু দিন পর লাল মামীর ঘরে এসে ঢুকলামপালঙ্কে লাল মামী আধশােয়া হয়ে আছেনতাঁর কোলের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়েআমি এসে বসতেই লাল মামী একটু সরে গেলেনআমি বললাম, কেমন আছেন মামী

মামী মাথা নাড়লেনবাদশা মামা বললেন, মােটেই ভালাে না রঞ্জুদেখ না, স্বাস্থ্য কী খারাপ হয়ে গেছেআমি চুপচাপ বসে রইলামবাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে পুরনাে গ্রামােফোন খুঁজে বের করলেন। 

অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, আজ থাক, মামানানা শুনিআমার শােনার ইচ্ছা হচ্ছেলাল মামী মৃদু কণ্ঠে বললেন, নানা থাকুকগান বাজাতে হবে না। 

তবু গান বেজে উঠল– 

আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে 

তােরে আমি কোথায় রাখি বলআমি চলে এলামএই অচিনপুরীতে থাকবার কাল আমার শেষ হয়েছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *