লিলির যে–চিঠির জন্যে পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছিলাম, সে–চিঠি এসে গেছে। লিলি গােটা গােটা হরফে লিখেছে, আমি জানি, তুই রাগ করেছিস।
কত দিন হল গিয়েছি, কিন্তু কখনাে তাের কাছে চিঠি লিখি নি। কী করব বল? এমন খারাপ অবস্থা গেছে আমার! তাের দুলাভাইয়ের চাকরি নেই। বসতবাটিও পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। একেবারে ভিক্ষা করবার মতাে অবস্থা। কত দিন যে মাত্র এ বেলা খেয়েছি। তারপর আবার তাের দুলাভাইয়ের অসুখ হল। মরােমরাে অবস্থা! এখন অবশ্যি ঠিক হয়ে গেছে সব। তুই অতি অবশ্যি এসে যা রঞ্জু।
লিলির চিঠি পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। সবাইকে ছেড়ে যেতে বড়াে মায়া লাগে। আশৈশব পরিচিত এ বাড়িঘর। বাদশা মামা, নানাজান, লাল মামী, নবু মামা এদের সবার স্মৃতির গন্ধ নিয়ে যে–বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ছেড়ে কী করে যাই? আমি উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সােনাখালির পুলের উপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকি। নৌকা নিয়ে চলে যাই হলদেপােতা। খুব জোছনা হলে সফুরা খালাকে নিযে পুকুরঘাটে বেড়াতে যাই। সফুরা খালা বলেন, ‘তুমি কবে যাবে
‘যে–কোনাে এক দিন যাব।‘
সেই যে– কোনাে এক দিনটা কবে? ‘হবে এক দিন।
অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
একে রাতে সফুরা খালা কাঁদেন। শর গভীর বিষাদ বােঝবার ক্ষমতা আমার নেই। বুঝতে চাই না। যে–বন্ধন আমাকে এখানে আটকে রেখেছে, কবে তা কাটবে, কবে চলে যাব––তাই ভাবি। নানাজানও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন, ‘তােমার যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে?
না।‘ ‘তােমার আর লিলির নামে যে–মিজমা আছে, তার কী হবে?
যেমন আছে তেমন থাকবে। নানাজান কথা বললেন না। আমি জানি এই জমিটুকুই তাঁদের অবলম্বন।
সে রাতে ভীষণ শীত পড়েছিল। সন্ধ্যা না নামতেই ঘন কুয়াশা চারিদিক আচ্ছন্ন। করে ফেলল। রাতের খাওয়ার পর হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে আসছি, হঠাৎ দেখি বাদশা মামা দারুণ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত আসছেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।
‘র, দেখ দেখ।
আমি তাকিয়ে দেখলাম, একটু দূরে, লাল মামী একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বাদশা মামা বলে চলেছেন,‘নৌকা করে সন্ধ্যার আগেই এরা দু‘ জন এসেছে। চুপচাপ বসে ছিল। আমি মসজিদে যাব বলে ওজু করতে গিয়েছি, এমন সময়...‘।
লাল মামী বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। {যে উঠোনে অনেক অনেক দিন আগে আমার মা তাঁর দু‘টি ছেলেমেয়ের হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কেউ কোনাে কথা বলল না। নানাজান চিত্রার্পিতের মতাে দাঁড়িয়ে রইলেন। ছােট নানিজান যেন কিছুই বুঝছেন না, এমন ভঙ্গিতে তাকাতে লাগলেন। সফুরা খালা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি নিচে নেমে এলেন। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তাের গরম শালটা কোথায় সফুরা? এলাচির শীত করছে।
অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
নবু মামার কথা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। সবাই চুপ করে রইল। একসময় দেখলাম লাল মামী কাঁদছেন।
আমি চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে বসে ঝিঝির ডাক শুনতে লাগলাম। অনেক রাতে বাদশা মামা আমাকে ডেকে নিলেন। মৃদু ভৎসনার সুরে বললেন, তােরা সবাই যদি দূরে দূরে থাকিস, তাহলে এলাচি কী মনে করবে বল? চল রঞ্জু।
বাদশা মামা আমার হাত ধরলেন।
বহু দিন পর লাল মামীর ঘরে এসে ঢুকলাম। পালঙ্কে লাল মামী আধশােয়া হয়ে আছেন। তাঁর কোলের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়ে। আমি এসে বসতেই লাল মামী একটু সরে গেলেন। আমি বললাম, কেমন আছেন মামী?
মামী মাথা নাড়লেন। বাদশা মামা বললেন, ‘মােটেই ভালাে না রঞ্জু। দেখ না, স্বাস্থ্য কী খারাপ হয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে পুরনাে গ্রামােফোন খুঁজে বের করলেন।
অচিনপুর পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
আমি বললাম, ‘আজ থাক, মামা। ‘না–না শুনি। আমার শােনার ইচ্ছা হচ্ছে। লাল মামী মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘না–না থাকুক। গান বাজাতে হবে না।
তবু গান বেজে উঠল––
‘আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে
তােরে আমি কোথায় রাখি বল।” আমি চলে এলাম। এই অচিনপুরীতে থাকবার কাল আমার শেষ হয়েছে।