না, চুপ করব কেন? বউ, শেষ কথা আমার, তাবিজ দিবা কি না কও।
লাল মামী বললেন, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন। সে যদি বলে তাবিজ দিলেই আমার ছেলেমেয়ে হবে, তাহলে দেব।‘
এমন সময় নিচে প্রচণ্ড হৈচৈ শােনা গেল। আমি আর নবু মামা দৌড়ে গিয়ে দেখি রহমত মিয়া শিকল খুলে কীভাবে যেন বেরিয়ে পড়েছে। হাতের শিকল নাচাচ্ছে, আর বলছে, ‘কাঁচা খাইয়া ফেলামু। কাঁচা খাইয়া ফেলামু। | লােকজন ঘিরে ফেলেছে তাকে। কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। দু–এক জন লম্বা বাঁশ বাগিয়ে ধরে আছে। নানাজান বললেন, ‘কেউ ওরে মারবে না, খবরদার। সাবধানে ধর।
বহু কসরত করতে হল ধরতে গিয়ে। শিকলের বাড়ি খেয়ে হারিস সর্দার তাে প্রায় মরােমরাে। নানাজান বললেন, ‘যাও, নৌকায় করে পাগল হারামজাদাটাকে এক্ষুণি নান্দিপুরের বাজারে ছেড়ে দিয়ে আস। এঁটো কাঁটা খেয়ে বেশ বেঁচে থাকবে।
ঘাটে নৌকা তৈরিই ছিল। বহু উৎসাহী সহযাত্রী তৈরি হয়ে পড়ল। একটি জ্বলজ্যান্ত পাগলকে অন্য গ্রামের বাজারে ছেড়ে দিয়ে আসা এ্যাডভেঞ্চারের মতাে।
অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
পাগল তাে কিছুতেই নৌকায় উঠবে না। চেচামেচি চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলেছে। কিন্তু নৌকায় উঠেই তার ভাবান্তর হল। হাত ডুবিয়ে দিল নদীর পানিতে, তারপর খুশিতে হেসে ফেলল।
‘আহা, পাগলটার কারবার দেখে বড় মায়া লাগে রে।”
তাকিয়ে দেখি ঘাটের উপর বসে থেকে বাদশা মামা আফসােস করছেন। তাঁর চোখ স্নেহ ও মমতায় চকচক করছে।
পরবর্তী দু‘ দিন বাড়ির আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত রইল। নবু মামা যে–সকালে চলে যাবেন, সে–সকালে লাল মামীর সঙ্গে কানাবিবির একটা ছােটখাট সংঘর্ষ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙেই শুনি লাল মামী বলছেন, ‘এ কানাবিবির কাজ। কানাবিবি, তােমার এমন সাহস।
কানাৰিবি বলছে, ‘বাড়ির বউ মানুষ কেমন গলায় কথা কয় গাে! বিষয় আর কিছু নয়। লাল মামী ঘুমুতে গিয়ে দেখেছেন, তাঁর বালিশের নিচে
শাড়ির পাড়ের টুকরাে, মাথার চুল, একখণ্ড ছােট হাড়––এই ২ (িনিস সুতাে দিয়ে বেঁধে রেখে দেওয়া। বশীকরণের জিনিসপত্র হয়তাে। সেই থেকেই বিপত্তি।
নবু মামাকে স্টেশনে দিয়ে আসতে আমি সঙ্গে চলেছি। রাত দুটোয় টেন। সন্ধ্যাবেলা খেয়েদেয়ে রওয়ানা হয়েছি। হারিকেন দুলিয়ে একটি কামলা যাচ্ছে আগে আগে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হু–হু করে। নবু মামা আর আমি গল্প করতে করতে যাচ্ছি। হঠাৎ মামা বললেন, ‘ও, তােকে বলা হয় নি, লিলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। শান্তাহার স্টেশনে। স্নাটফরমে বসে ছিল, আমি তাকে চিনতে পারি নি। হঠাৎ ডাকল––নবু মামা না?‘
অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
নবু মামা কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘খুব গরিব হয়ে গেছে। রােগা হয়েছে খুব। ময়লা কাপড়চোপড়। এমন খারাপ লাগল দেখে।
লিলির বরের সঙ্গে দেখা হয় নি। ‘না। লিলি বলল, আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে নাকি লুকিয়ে আছে কোথায়।
আর কিছু বলে নি ?
তাের কথা জিজ্ঞেস করল। তার অবস্থা একটু ভালাে হলেই তােকে নাকি তার কাছে নিয়ে যাবে।‘
নবু মামা বললেন, ‘তাের মন খারাপ হয়েছে? ‘হ্যা। ‘আমারাে হয়েছে। বিয়ের পর যখন লিলির শ্বশুরবাড়ি গেল, মনে আছে রঞ্জু? ‘আছে।” ‘ট্রেনে উঠে কী কাঁদাটাই না কাঁদল। নবু মামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
সেবার আমি খুব অর্থকষ্টে পড়লাম।
স্কুলের বেতন দিতে হয়। মাঝেমধ্যে চাঁদা দিতে হয়। আগে নবু মামা যখন দিতেন, সেই সঙ্গে আমারটাও দিয়ে দিতেন। এখন আমি একলা পড়েছি। নিজ থেকে কারাে কাছে কিছু চাইতে পারি না। পােশাকের বেলায়ও তাই। নবু মামার কাপড় জামা বরাবর পরে এসেছি। লিলিও প্রায়ই বানিয়ে দিয়েছে। অসুবিধে হয় নি কিছু। এখন অসুবিধে হতে লাগল। কী করব ভেবে পাই না। বাদশা মামার কাছে কিছু চাইতে লজ্জা করে। আমি খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম। নিজেকে অবাঞ্ছিত ভাবা খুব কষ্ট ও লজ্জার ব্যাপার। আমার ভারি কষ্ট হতে লাগল। খুব ইচ্ছে হতে লাগল লিলির
কাছে চলে যাই। কিন্তু তার কাছে চিঠি লিখে জবাব পাই না। পুরনাে জায়গা ছেড়ে তারা নতুন যেখানে গিয়েছে, তার ঠিকানাও জানায় নি কাউকে।
অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
তাছাড়া নানাজানের সংসারেও নানা রকম অশান্তি শুরু হয়েছে। তাঁর জন্মশত্রু হালিম শেখ জমি নিয়ে মামলা শুরু করেছে। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মতাে। বৃদ্ধ বয়সে নানাজানকে কোর্ট–কাচারিতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। বাদশা মামাকে দিয়ে তাে কোনাে কাজ করাবার উপায় নেই। তিনি জড় পদার্থের মতাে হয়ে গিয়েছেন। সুফী সাহেবের বাড়ি থেকে ফেরবার পর বেশ কিছুদিন ধর্ম–কর্ম নিয়ে ছিলেন। লােকে ভালােই বলেছে। এখন সে–সব ছেড়েছেন। নেশা–ভাংও নাকি করেন আজকাল।।
সফুরা খালাকে নিয়েও অনেক রকম অশান্তি হচ্ছে। কখন তিনি দেখতে | দেখতে বড়াে হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বিয়ের কথাবার্তাও হচ্ছে। এক বার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। ছেলের বাবা মেয়ে দেখে মহা খুশি। এমন ভালাে স্বভাবের মেয়ে সে নাকি তার সমস্ত জীবনে দেখে নি। কিন্তু বিয়ে হল না।
সফুরা খালাকে নিয়ে তখন নানা রকম রটনা। তার নাকি মাথা খারাপ। রাতেবিরেতে মেয়ে নাকি পুকুরঘাটে একা একা হেঁটে বেড়ায়। এক বার কোনাে মেয়ে সম্পর্কে এ জাতীয় কথা ছড়িয়ে পড়াটা খুব খারাপ লক্ষণ। এ নিয়ে ঘরেও অশান্তির শেষ নেই। নানিজান বিনিয়ে বিনিয়ে গানের মতাে সুরে কাঁদেন। মাঝে মাঝে আপন মনে বলেন, ‘আমার নসীব। বিয়ে করালাম ছেলে, বউটা বাঁজা–মেয়েটাও আধপাগল।
অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
কিন্তু যাকে নিয়ে এত অশান্তি, সেই সফুরা খালা নির্বিকার। আমি এক দিন সফুরা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা, আপনি নাকি রাতবিরেতে একা একা ঘুরে বেড়ান?
খালা মৃদু গলায় বলেন, একা একা পুকুরঘাটে বসে থাকতে এত ভালাে লাগে।
তাঁকে নিয়ে চারিদিকে যে এত অশান্তি, সেদিকে কিছুমাত্র খেয়াল নেই। আছেন আপন মনে। তাঁর জন্যে আমার খুব কষ্ট হতে শুরু করল। খালাকে আমি তখন ভালােবেসে ফেলেছি।
আসলে খালাকে আমি একটুও বুঝে উঠতে পারি নি। যাবতীয় দুর্বোধ্য বস্তুর জন্যে মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। সেই জন্যেই তাঁর প্রতি আমার প্রবল ভালােবাসা গড়ে উঠল। আমার ইচ্ছে হল তাঁর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠুক।