অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

না, চুপ করব কেন? বউ, শেষ কথা আমার, তাবিজ দিবা কি না কও। 

অচিনপুর

লাল মামী বললেন, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেনসে যদি বলে তাবিজ দিলেই আমার ছেলেমেয়ে হবে, তাহলে দেব‘ 

এমন সময় নিচে প্রচণ্ড হৈচৈ শােনা গেলআমি আর নবু মামা দৌড়ে গিয়ে দেখি রহমত মিয়া শিকল খুলে কীভাবে যেন বেরিয়ে পড়েছেহাতের শিকল নাচাচ্ছে, আর বলছে, কাঁচা খাইয়া ফেলামুকাঁচা খাইয়া ফেলামু| লােকজন ঘিরে ফেলেছে তাকেকাছে যেতে সাহস পাচ্ছে নাদুএক জন লম্বা বাঁশ বাগিয়ে ধরে আছেনানাজান বললেন, কেউ ওরে মারবে না, খবরদারসাবধানে ধর। 

বহু কসরত করতে হল ধরতে গিয়ে। শিকলের বাড়ি খেয়ে হারিস সর্দার তাে প্রায় মরােমরােনানাজান বললেন, যাও, নৌকায় করে পাগল হারামজাদাটাকে এক্ষুণি নান্দিপুরের বাজারে ছেড়ে দিয়ে আস। এঁটো কাঁটা খেয়ে বেশ বেঁচে থাকবে। 

ঘাটে নৌকা তৈরিই ছিলবহু উৎসাহী সহযাত্রী তৈরি হয়ে পড়লএকটি জ্বলজ্যান্ত পাগলকে অন্য গ্রামের বাজারে ছেড়ে দিয়ে আসা এ্যাডভেঞ্চারের মতাে। 

অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

পাগল তাে কিছুতেই নৌকায় উঠবে নাচেচামেচি চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলেছেকিন্তু নৌকায় উঠেই তার ভাবান্তর হলহাত ডুবিয়ে দিল নদীর পানিতে, তারপর খুশিতে হেসে ফেলল। 

আহা, পাগলটার কারবার দেখে বড় মায়া লাগে রে” 

তাকিয়ে দেখি ঘাটের উপর বসে থেকে বাদশা মামা আফসােস করছেনতাঁর চোখ স্নেহ মমতায় চকচক করছে। 

পরবর্তী দুদিন বাড়ির আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত রইলনবু মামা যেসকালে চলে যাবেন, সেসকালে লাল মামীর সঙ্গে কানাবিবির একটা ছােটখাট সংঘর্ষ হয়ে গেলঘুম ভেঙেই শুনি লাল মামী বলছেন, কানাবিবির কাজকানাবিবি, তােমার এমন সাহস। 

কানাৰিবি বলছে, বাড়ির বউ মানুষ কেমন গলায় কথা কয় গাে! বিষয় আর কিছু নয়লাল মামী ঘুমুতে গিয়ে দেখেছেন, তাঁর বালিশের নিচে 

শাড়ির পাড়ের টুকরাে, মাথার চুল, একখণ্ড ছােট হাড়এই (িনিস সুতাে দিয়ে বেঁধে রেখে দেওয়াবশীকরণের জিনিসপত্র হয়তােসেই থেকেই বিপত্তি। 

নবু মামাকে স্টেশনে দিয়ে আসতে আমি সঙ্গে চলেছিরাত দুটোয় টেনসন্ধ্যাবেলা খেয়েদেয়ে রওয়ানা হয়েছিহারিকেন দুলিয়ে একটি কামলা যাচ্ছে আগে আগেঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হুহু করেনবু মামা আর আমি গল্প করতে করতে যাচ্ছিহঠাৎ মামা বললেন, , তােকে বলা হয় নি, লিলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমারশান্তাহার স্টেশনেস্নাটফরমে বসে ছিল, আমি তাকে চিনতে পারি নিহঠাৎ ডাকলনবু মামা না?‘ 

অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

নবু মামা কিছুক্ষণ থেমে বললেন, খুব গরিব হয়ে গেছে। রােগা হয়েছে খুবময়লা কাপড়চোপড়এমন খারাপ লাগল দেখে। 

লিলির বরের সঙ্গে দেখা হয় নিনালিলি বলল, আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে নাকি লুকিয়ে আছে কোথায়। 

আর কিছু বলে নি

তাের কথা জিজ্ঞেস করলতার অবস্থা একটু ভালাে হলেই তােকে নাকি তার কাছে নিয়ে যাবে‘ 

নবু মামা বললেন, তাের মন খারাপ হয়েছে? হ্যাআমারাে হয়েছেবিয়ের পর যখন লিলির শ্বশুরবাড়ি গেল, মনে আছে রঞ্জু? আছেট্রেনে উঠে কী কাঁদাটাই না কাঁদল। নবু মামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। 

সেবার আমি খুব অর্থকষ্টে পড়লাম। 

স্কুলের বেতন দিতে হয়মাঝেমধ্যে চাঁদা দিতে হয়আগে নবু মামা যখন দিতেন, সেই সঙ্গে আমারটাও দিয়ে দিতেনএখন আমি একলা পড়েছিনিজ থেকে কারাে কাছে কিছু চাইতে পারি নাপােশাকের বেলায়ও তাইনবু মামার কাপড় জামা বরাবর পরে এসেছিলিলিও প্রায়ই বানিয়ে দিয়েছেঅসুবিধে হয় নি কিছুএখন অসুবিধে হতে লাগলকী করব ভেবে পাই নাবাদশা মামার কাছে কিছু চাইতে লজ্জা করেমি খুব মুশকিলে পড়ে গেলামনিজেকে অবাঞ্ছিত ভাবা খুব কষ্ট লজ্জার ব্যাপারআমার ভারি কষ্ট হতে লাগলখুব ইচ্ছে হতে লাগল লিলির 

কাছে চলে যাইকিন্তু তার কাছে চিঠি লিখে জবাব পাই নাপুরনাে জায়গা ছেড়ে তারা নতুন যেখানে গিয়েছে, তার ঠিকানাও জানায় নি কাউকে। 

অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

তাছাড়া নানাজানের সংসারেও নানা রকম অশান্তি শুরু হয়েছেতাঁর জন্মশত্রু হালিম শেখ জমি নিয়ে মামলা শুরু করেছেটাকা খরচ হচ্ছে জলের মতােবৃদ্ধ বয়সে নানাজানকে কোর্টকাচারিতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছেবাদশা মামাকে দিয়ে তাে কোনাে কাজ করাবার উপায় নেইতিনি জড় পদার্থের মতাে হয়ে গিয়েছেনসুফী সাহেবের বাড়ি থেকে ফেরবার পর বেশ কিছুদিন ধর্মকর্ম নিয়ে ছিলেনলােকে ভালােই বলেছেএখন সেসব ছেড়েছেননেশাভাংও নাকি করেন আজকাল। 

সফুরা খালাকে নিয়েও অনেক রকম অশান্তি হচ্ছেকখন তিনি দেখতে | দেখতে বড়াে হয়ে উঠেছিলেনতাঁর বিয়ের কথাবার্তাও হচ্ছেএক বার সব ঠিকঠাক হয়ে গেলছেলের বাবা মেয়ে দেখে মহা খুশিএমন ভালাে স্বভাবের মেয়ে সে নাকি তার সমস্ত জীবনে দেখে নি। কিন্তু বিয়ে হল না

সফুরা খালাকে নিয়ে তখন নানা রকম রটনাতার নাকি মাথা খারাপরাতেবিরেতে মেয়ে নাকি পুকুরঘাটে একা একা হেঁটে বেড়ায়এক বার কোনাে মেয়ে সম্পর্কে জাতীয় কথা ছড়িয়ে পড়াটা খুব খারাপ লক্ষণনিয়ে ঘরেও অশান্তির শেষ নেইনানিজান বিনিয়ে বিনিয়ে গানের মতাে সুরে কাঁদেনমাঝে মাঝে আপন মনে বলেন, আমার নসীব। বিয়ে করালাম ছেলে, বউটা বাঁজামেয়েটাও আধপাগল। 

অচিনপুর পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

কিন্তু যাকে নিয়ে এত অশান্তি, সেই সফুরা খালা নির্বিকারআমি এক দিন সফুরা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা, আপনি নাকি রাতবিরেতে একা একা ঘুরে বেড়ান

খালা মৃদু গলায় বলেন, একা একা পুকুরঘাটে বসে থাকতে এত ভালাে লাগে। 

তাঁকে নিয়ে চারিদিকে যে এত অশান্তি, সেদিকে কিছুমাত্র খেয়াল নেইআছেন আপন মনেতাঁর জন্যে আমার খুব কষ্ট হতে শুরু করলখালাকে আমি তখন ভালােবেসে ফেলেছি। 

আসলে খালাকে আমি একটুও বুঝে উঠতে পারি নিযাবতীয় দুর্বোধ্য বস্তুর জন্যে মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকেসেই জন্যেই তাঁর প্রতি আমার প্রবল ভালােবাসা গড়ে উঠল। আমার ইচ্ছে হল তাঁর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠুক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *