অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে এমােফোন বের করলেন নবু মামা। বহু কষ্ট করে চোঙ ফিট করা হল। দম দিতে গিয়ে বিপত্তি––ঘ্যাসঘাস শব্দ হয়। তবে ভরসার। কথা––ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নবু মামা ফিসফিসেয়ে বললেন, কোন গানটা দিয়েছি কে জানে? একটা খুব বাজে গান আছে। এটা প্রথম এসে গেলে খারাপ হবে খুব।
আমি বললাম, ‘নবু মামা, দেরি করছ কেন? ‘দিচ্ছি। বৃষ্টিটা একটু কমুক, নয়তাে শুনবে না। বৃষ্টির বেগ একটু কমে আসতেই গান বেজে উঠল—
‘আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে তােরে আমি কোথায় রাখি বল?
লাল মামী গান শুনে মুগ্ধ হবে কি, আমি নিজেই মােহিত হয়ে গেলাম। কী অপূর্ব কিন্নরকণ্ঠে গান হচ্ছে! বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল।
নবু মামা ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, ভাবী আসে না যে, ও রঞ্জু। | আমি সে কথার জবাব দিলাম না। বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। জানালার কপাটে শব্দ হচ্ছে খটখট। নবু মামা জানালা বন্ধ করবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি লাল মামী ডাকলেন, ‘রজু, রঞ্জু।
নবু মামা ফিসফিস করে বললেন, ‘চুপ করে থাক, কথা বলবি না। আমি চুপ করে রইলাম। নবু মামা অন্য রেকর্ড চালিয়ে দিল––
‘যদি ভাল না লাগে তাে দিও না মন’ লাল মামী দরজায় ঘা দিলেন, ‘ও রঞ্জু, কী ব্যাপার, গান হয় কোথায়? নবু মামা উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে হাে হাে করে হেসে উঠলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, ভাবী, তােমার জন্য আনলাম। তােমার জন্য আনলাম। নবু মামা লাল মামীর হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এল। কী ফুর্তি তার! লাল মামী বললেন, ‘কলের গান না? ছছাটবেলায় দেখেছিলাম এক বার। চোঙ আছে? বাতি জ্বালাও না।
অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
বাতি জ্বালান হল। লাল মামীকে দেখব কী? নবু মামার দিকেই তাকিয়ে আছি। আনন্দে উত্তেজনায় নবু মামার চোখ জ্বলজ্বল করছে। মামী বললেন, ‘ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে গানটা আরেক বার দাও।
সেই অপূর্ব গান আবার বেজে উঠল। বাইরে তখন ঝড়–বৃষ্টি।
সে–রাতের কথা আমার খুব মনে আছে।
একটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে মনে রাখবার মতাে ঘটনা তাে খুব সীমিত। কত মানুষ আছে, সমস্ত জীবন কেটে যায়, কোনাে ঘটনাই মনে রাখবার মতাে আবেগ তার ভেতর সৃষ্টি করে না। আমি নিজে কত কিছুই তাে ভুলে বসে আছি। কিন্তু মনে আছে সে–রাতে গান শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই আমার চোখে পানি এসেছিল। নবু মামা আর লাল মামী যেন দেখতে না পায় সে জন্যে আমি মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। নবু মামা বললেন, ভাবী, আমার নাচতে। মন চাইছে।
নাচ না। নবু মামা বললেন, ‘রঞ্জু, তুই নাচবি আমার সঙ্গে? আমি সে–কথার জবাব দিলাম না। মামী বললেন, ‘নবু, ঐ রেকর্ডটা আবার। | ‘সারা রাত হবে আজকে, বুঝলে ভাবী।
ক্লান্তি নেই নবু মামার। লাল মামীর উৎসাহও সীমাহীন। শুনতে শুনতে আমার
ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।
নবু মামা বললেন, ‘গাধা! এত ফাইন গান, আর ঘুমায় কেমন দেখ।‘ লাল মামী বললেন, ‘আজ তাহলে থাক। ঘুমাে তােরা। ‘না–না, থাকবে না। যতক্ষণ ঝড়–বৃষ্টি হবে ততক্ষণই গান হবে।
অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
কথা শেষ হতে–না–হতেই কড়কড় করে বাজ পড়ল। ফুর্তিতে নবু মামা হাে হাে করে হেসে ফেললেন। মামী বললেন, ‘রঞ্জুর ঘুম পাচ্ছে। এগুলি নিয়ে আমার ঘরে এসে পড় নবু, আমাকে ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে গানটা শুনে শুনে লিখে দিতে পারবি কাগজে?
‘নিশ্চিয়ই পারব। নিশ্চয়ই। | জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছিল, উঠে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বড়াে নানিজানের ঘরের লাগােয়া গাবগাছটি ভেঙে পড়ে গেছে। কেমন ন্যাড়া দেখাচ্ছে জায়গাটা। ভালােই ঝড়–বৃষ্টি হয়েছে, বাতাস থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। কে জানে গত বারের মতাে এবারেও হয়তাে বান ডাকবে। গত বার এ–রকম সময়ে বাড়ি থেকে নদীর শোঁ–শোঁ শব্দ শােনা গেছে। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনি নবু মামা বলছেন, ভাবী, তুমিও গাও সঙ্গে সঙ্গে।
না না, আমি পারব না। তুই গা, মাটি মে পেীরণটা গা।‘ নবু মামা হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন
‘মাটি মে পৌরণ, মাটি মে শ্রাবণ মাটি মে তনবন যায়গা
যব মাটি সে সব মিল যায়গা। গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাল মামী বললেন, ‘দক্ষিণের জানালা বন্ধ কর নবু, ভিজে যাচ্ছি।‘
নবু মামা বললেন, ‘বাদশা ভাই কোথায়?
‘দু দিন ধরে দেখা নেই। কোথায় কে জানে। যদি ভাল না লাগে’ গানটা দে। ঘুম আসছে যে আবার। ও নবু, তাের ঘুম পায় না?
অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
শুনতে শুনতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল না। শুয়ে শুয়ে গান শুনতে কী ভালােই না লাগে! ক্রমে ক্রমে ঝড়ের মতাে বাতাসের বেগ হল। বাড়ির লম্বা থামে বাতাসের শোঁ–শোঁ শব্দ উঠতে লাগল। দড়াম দড়াম শব্দ করে দরজা নড়তে লাগল। উঠে দাঁড়িয়েছি হারিকেন জ্বালাব বলে, ওমনি সফুরা খালা ডাকলেন, রঞ্জু, ও রঞ্জু।