অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে এমােফোন বের করলেন নবু মামাবহু কষ্ট করে চোঙ ফিট করা হলদম দিতে গিয়ে বিপত্তিঘ্যাসঘাস শব্দ হয়তবে ভরসারকথাঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছেনবু মামা ফিসফিসেয়ে বললেন, কোন গানটা দিয়েছি কে জানে? একটা খুব বাজে গান আছেএটা প্রথম এসে গেলে খারাপ হবে খুব। 

অচিনপুর

আমি বললাম, নবু মামা, দেরি করছ কেন? দিচ্ছিবৃষ্টিটা একটু কমুক, নয়তাে শুনবে নাবৃষ্টির বেগ একটু কমে আসতেই গান বেজে উঠল— 

আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে তােরে আমি কোথায় রাখি বল

লাল মামী গান শুনে মুগ্ধ হবে কি, আমি নিজেই মােহিত হয়ে গেলামকী অপূর্ব কিন্নরকণ্ঠে গান হচ্ছে! বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিআবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল। 

নবু মামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কী ব্যাপার, ভাবী আসে না যে, রঞ্জু| আমি সে কথার জবাব দিলাম নাবাইরে তখন ঝড় উঠেছেজানালার কপাটে শব্দ হচ্ছে খটখটনবু মামা জানালা বন্ধ করবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি লাল মামী ডাকলেন, রজু, রঞ্জু। 

নবু মামা ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে থাক, কথা বলবি নাআমি চুপ করে রইলামনবু মামা অন্য রেকর্ড চালিয়ে দিল– 

যদি ভাল না লাগে তাে দিও না মনলাল মামী দরজায় ঘা দিলেন, রঞ্জু, কী ব্যাপার, গান হয় কোথায়? নবু মামা উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে হাে হাে করে হেসে উঠলেনচেঁচিয়ে উঠলেন, ভাবী, তােমার জন্য আনলামতােমার জন্য আনলামনবু মামা লাল মামীর হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এলকী ফুর্তি তার! লাল মামী বললেন, কলের গান না? ছছাটবেলায় দেখেছিলাম এক বারচোঙ আছে? বাতি জ্বালাও না। 

অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

বাতি জ্বালান হললাল মামীকে দেখব কী? নবু মামার দিকেই তাকিয়ে আছিআনন্দে উত্তেজনায় নবু মামার চোখ জ্বলজ্বল করছেমামী বললেন, ‘ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে গানটা আরেক বার দাও। 

সেই অপূর্ব গান আবার বেজে উঠলবাইরে তখন ঝড়বৃষ্টি। 

সেরাতের কথা আমার খুব মনে আছে। 

একটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে মনে রাখবার মতাে ঘটনা তাে খুব সীমিতকত মানুষ আছে, সমস্ত জীবন কেটে যায়, কোনাে ঘটনাই মনে রাখবার মতাে আবেগ তার ভেতর সৃষ্টি করে নাআমি নিজে কত কিছুই তাে ভুলে বসে আছিকিন্তু মনে আছে সেরাতে গান শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই আমার চোখে পানি এসেছিলনবু মামা আর লাল মামী যেন দেখতে না পায় সে জন্যে আমি মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছিনবু মামা বললেন, ভাবী, আমার নাচতেমন চাইছে। 

নাচ নানবু মামা বললেন, রঞ্জু, তুই নাচবি আমার সঙ্গে? আমি সেকথার জবাব দিলাম নামামী বললেন, নবু, রেকর্ডটা আবার| সারা রাত হবে আজকে, বুঝলে ভাবী। 

ক্লান্তি নেই নবু মামারলাল মামীর উৎসাহও সীমাহীনশুনতে শুনতে আমার 

ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। 

নবু মামা বললেন, গাধা! এত ফাইন গান, আর ঘুমায় কেমন দেখলাল মামী বললেন, আজ তাহলে থাকঘুমাে তােরানানা, থাকবে নাযতক্ষণ ঝড়বৃষ্টি হবে ততক্ষণই গান হবে। 

অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

কথা শেষ হতেনাহতেই কড়কড় করে বাজ পড়লফুর্তিতে বু মামা হাে হাে করে হেসে ফেললেনমামী বললেন, রঞ্জুর ঘুম পাচ্ছেএগুলি নিয়ে আমার ঘরে এসে পড় বু, আমাকে ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলাে গানটা শুনে শুনে লিখে দিতে পারবি কাগজে

নিশ্চিয়ই পারবনিশ্চয়ই| জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছিল, উঠে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বড়াে নানিজানের ঘরের লাগােয়া গাবগাছটি ভেঙে পড়ে গেছেকেমন ন্যাড়া দেখাচ্ছে জায়গাটাভালােই ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, বাতাস থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারেকে জানে গত বারের মতাে এবারেও হয়তাে বান ডাকবেগত বার রকম সময়ে বাড়ি থেকে নদীর শোঁশোঁ শব্দ শােনা গেছেচাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনি নবু মামা বলছেন, ভাবী, তুমিও গাও সঙ্গে সঙ্গে। 

না না, আমি পারব নাতুই গা, মাটি মে পেীরণটা গানবু মামা হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন 

মাটি মে পৌরণ, মাটি মে শ্রাবণ মাটি মে তনবন যায়গা 

যব মাটি সে সব মিল যায়গাগান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাল মামী বললেন, দক্ষিণের জানালা বন্ধ কর নবু, ভিজে যাচ্ছি‘ 

নবু মামা বললেন, বাদশা ভাই কোথায়

দু দিন ধরে দেখা নেইকোথায় কে জানেযদি ভাল না লাগেগানটা দেঘুম আসছে যে আবারনবু, তাের ঘুম পায় না

অচিনপুর পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

শুনতে শুনতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলঘুমুতে ইচ্ছে করছিল নাশুয়ে শুয়ে গান শুনতে কী ভালােই না লাগে! ক্রমে ক্রমে ঝড়ের মতাে বাতাসের বেগ হলবাড়ির লম্বা থামে বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ উঠতে লাগলদড়াম দড়াম শব্দ করে দরজা নড়তে লাগল। উঠে দাঁড়িয়েছি হারিকেন জ্বালাব বলে, ওমনি সফুরা খালা ডাকলেন, রঞ্জু, রঞ্জু। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *