দরজা খুলে দেখি সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে সফুরা খালা বৃষ্টির ছাটে ভিজছেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘এদিকে গান হচ্ছিল নাকি রঞ্জু?
‘হ্যা, নবু মামা কলের গান বাজাচ্ছিলেন। কলের গান এনেছেন নবু মামা। ‘নবু কোথায়?
‘লাল মামী আর নবু মামা গান বাজাচ্ছেন।
সফুরা খালা আরাে একটু এগিয়ে এসে বললেন, ‘কই, গান শুনছি না তাে? | আমরা দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সফুরা খালা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘রজু, আমার ভীষণ ভয় লাগছে।
সেই অপূর্ব বৃষ্টিস্নাত রাতে যে ভয় করবার মতাে কিছু একটি লুকিয়ে ছিল, তা আমি বুঝতে পারি নি। সফুরা খালা শীতে কাঁপছিলেন। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবু শুধুমাত্র তাঁর কথা শুনেই ধারণা হল, কোথাও নিশ্চয়ই ভয় লুকিয়ে আছে। | সফুরা খালা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত চলে গেলেন, যেন কোনাে হিংস্র জন্তু তাঁকে তাড়া করছে। মাতালের মতাে বেসামাল পদক্ষেপ। আমি এসে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। মেঘ কেটে গেছে, রােদ উঠেছে ঝকঝকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আরাে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব কিনা ভাবছি, তখন নবু মামা এসে ডাকলেন, ‘আয়, মাছ মারতে যাই। নতুন পানিতে মেলা মাছ এসেছে।
অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
ছিপ, কানিজাল ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে নৌকা করে চললাম দু‘ জনে হলদাপােতা। কিন্তু নবু মামার মাছ মারার মন ছিল না। অপ্রাসঙ্গিক নানা কথা বলতে লাগলেন। দুপুর পর্যন্ত আমরা ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম। নবু মামার ভাবভঙ্গি আমার কাছে কেমন কেমন লাগল। তিনি যেন বিশেষ কোনাে কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিয়ের কথা হলে কিশােরী মেয়েরা যেমন পালিয়ে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়, অনেকটা
সে–রকম। নবু মামা বললেন, ‘রঞ্জু, আমি আর পড়াশুনা করব না।
কেন? ‘ভালাে লাগে না।‘
কী করবেন তবে? ‘ব্যবসা করব। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব।
নানাজান মানবে না। ‘আমি কারাে ধার ধারি নাকি?
বলতে বলতে নবু মামা ঈষৎ হাসলেন। দুপুরে খাওয়ার জন্যে চিড়া আর নারিকেল আনা হয়েছিল, তাই খাওয়া হল। হলদাপােতা থেকে আমরা আরাে উত্তরে সরে গেলাম।
আমার আর ভালো লাগছিল না, রােদে গা তেতে উঠেছে। ইচ্ছে হচ্ছে ফিরে
যাই, কিন্তু নবু মামা বারবার বলছেন, ‘একটা বড়াে মাছ ধরি আগে।
সন্ধ্যার আগে আগে প্রকাণ্ড একটা কাতল মাছ ধরা পড়ল। সুগঠিত দেহ, কালচে আঁশ বেলাশেষের রােদে ঝকমক করছে। নৌকার পাটাতনে মাছটা ধড়ফড় করতে লাগল। দু‘ জনেই মহা খুশি। নবু মামা খুব যত্নে বঁড়শি খুলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
আমি বললাম, ‘চলুন ফিরে চলি।‘ ‘চল।
ভাটার টানে নৌকা ভেসে চলেছে। হঠাৎ করে নবুমামার ভাবান্তর হল। আমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, ‘মাছটা ছেড়ে দিই রঞ্জু ?
“কেন মামা? ‘না, ছেড়ে দি।
বলেই মাছটা জলে ফেললেন। আমি চুপ করে রইলাম। নবু মামা বললেন, একবার আমি একটা পাখি ধরেছিলাম। টিয়া পাখি। তারপর কী মনে করে ছেড়ে দিয়েছি। আমার খুব লাভ হয়েছিল।
অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
‘কী লাভ?‘
‘হয়েছিল। আজকে মাছটা ছেড়ে দিলাম, দেখিস মাছটা দোওয়া করবে আমার জন্যে।
নবু মামা পাটাতনে শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
বাড়ি এসে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। লাল মামীর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে সফুরা খালার। লাল মামী টেনে সফুরা খালার এক গােছা চুল তুলে ফেলেছে, গাল অাঁচড়ে দিয়েছে। সফুরা খালা বিষম দৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লাল মামী তাঁর ঘরের দরজা
বন্ধ করে রেখেছেন। কারাে সঙ্গে কথাবার্তা নেই। | বাদশা মামা আধময়লা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে। মাঝে বলছেন, সবাই যদি এলাচির সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে বেচারি কী করবে? কেউ দেখতে পারে না। ছােট নানিজান শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। এক বার ধমকে দিলেন, ‘যা তুই, খামাখা ঘ্যানঘ্যান। ভাল্লাগে না।
বাদশা মামা উঠোনে গিয়ে বসে রইলেন। বােকার মতাে তাকাতে লাগলেন এদিক–সেদিক। নবু মামাকে দেখে বললেন, ‘দেখলি নবু, সফুরা কী ঝগড়া করল? এলাচির সারা দিন খাওয়া নাই।।
রাতের খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হল। রান্নাবান্না হতে দেরি হয়েছে। সংসারযাত্রা কিছু পরিমাণে বিপর্যস্ত। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমুতে এসে দেখি সফুরা খালা বসে আছেন আমাদের ঘরে। সফুরা খালা বললেন, ‘তােমাদের জন্যে বাইরের বাংলাঘরে বিছানা হয়েছে। এ ঘরে আমি থাকব।‘ তাকিয়ে দেখি পরিপাটি করে ঘর সাজান। আমার আর নবু মামার ব্যাবহারিক জিনিসপত্র কিছুই নেই।
অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
নবু মামা বললেন, ‘তুই থাকবি কেন এখানে? তাের নিজের ঘর কী হল?”
‘আমার ঘরে পানি পড়ে, বিছানা ভিজে যায়।‘
নবু মামা কিছুক্ষণ উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হনহন করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। সফুরা খালা বললেন, ‘রজু, তুমি নবুকে চোখে চোখে রাখবে।
সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বাদশা মামার সঙ্গে দেখা। বাদশা মামা বললেন, ‘রজু, এলাচি ভাত খেয়েছে কিনা জানিস?
‘জানি না।‘ ‘মােহরের মা বলল, খেয়েছে। তুই একটু খোঁজ নিয়ে আয়।
আপনি নিজে যান না মামা। ‘আচ্ছা আচ্ছা, আমি নিজেই যাই।‘
লাল মামী সেদিন না–খেয়ে ছিলেন। রাতেও খেলেন না, দুপুরে ভাত নিয়ে গিয়ে মােহরের মা ফিরে এল। সফুরা খালা অনেক অনুনয়–বিনয় করলেন। কিন্তু লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত নানাজান এলেন। বিরক্ত ও দুঃখিত কণ্ঠে বললেন, এ সব
কী বউ ?
লাল মামী কথা বললেন না। নানাজান বললেন, ‘খাও খাও, ভাত খাও!’ ‘না, খব না।