অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

দরজা খুলে দেখি সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে সফুরা খালা বৃষ্টির ছাটে ভিজছেনমৃদু কণ্ঠে বললেন, এদিকে গান হচ্ছিল নাকি রঞ্জু

হ্যা, নবু মামা কলের গান বাজাচ্ছিলেনকলের গান এনেছেন নবু মামানবু কোথায়

লাল মামী আর নবু মামা গান বাজাচ্ছেন। 

অচিনপুর

সফুরা খালা আরাে একটু এগিয়ে এসে বললেন, কই, গান শুনছি না তাে? | আমরা দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলামসফুরা খালা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, রজু, আমার ভীষণ ভয় লাগছে। 

সেই অপূর্ব বৃষ্টিস্নাত রাতে যে ভয় করবার মতাে কিছু একটি লুকিয়ে ছিল, তা আমি বুঝতে পারি নিসফুরা খালা শীতে কাঁপছিলেনতাঁর মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবু শুধুমাত্র তাঁর কথা শুনেই ধারণা হল, কোথাও নিশ্চয়ই ভয় লুকিয়ে আছে| সফুরা খালা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত চলে গেলেন, যেন কোনাে হিংস্র জন্তু তাঁকে তাড়া করছেমাতালের মতাে বেসামাল পদক্ষেপআমি এসে শুয়ে পড়লাম। 

ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়মেঘ কেটে গেছে, রােদ উঠেছে ঝকঝকেজানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আরাে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব কিনা ভাবছি, তখন নবু মামা এসে ডাকলেন, আয়, মাছ মারতে যাইনতুন পানিতে মেলা মাছ এসেছে। 

অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

ছিপ, কানিজাল ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে নৌকা করে চললাম দুজনে হলদাপােতাকিন্তু নবু মামার মাছ মারার মন ছিল নাঅপ্রাসঙ্গিক নানা কথা বলতে লাগলেনদুপুর পর্যন্ত আমরা ইতস্তত ঘুরে বেড়ালামনবু মামার ভাবভঙ্গি আমার কাছে কেমন কেমন লাগলতিনি যেন বিশেষ কোনাে কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেনবিয়ের কথা হলে কিশােরী মেয়েরা যেমন পালিয়ে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়, অনেকটা 

সেরকমনবু মামা বললেন, রঞ্জু, আমি আর পড়াশুনা করব না। 

কেন? ভালাে লাগে না‘ 

কী করবেন তবে? ব্যবসা করবদেশে দেশে ঘুরে বেড়াব। 

নানাজান মানবে নাআমি কারাে ধার ধারি নাকি

বলতে বলতে নবু মামা ঈষৎ হাসলেনদুপুরে খাওয়ার জন্যে চিড়া আর নারিকেল আনা হয়েছিল, তাই খাওয়া হলহলদাপােতা থেকে আমরা আরাে উত্তরে সরে গেলাম। 

আমার আর ভালো লাগছিল না, রােদে গা তেতে উঠেছেইচ্ছে হচ্ছে ফিরে 

যাই, কিন্তু নবু মামা বারবার বলছেন, একটা বড়াে মাছ ধরি আগে। 

সন্ধ্যার আগে আগে প্রকাণ্ড একটা কাতল মাছ ধরা পড়লসুগঠিত দেহ, কালচে আঁশ বেলাশেষের রােদে ঝকমক করছেনৌকার পাটাতনে মাছটা ধড়ফড় করতে লাগলদুজনেই মহা খুশিনবু মামা খুব যত্নে বঁড়শি খুলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। 

আমি বললাম, চলুন ফিরে চলিচল। 

ভাটার টানে নৌকা ভেসে চলেছেহঠাৎ করে নবুমামার ভাবান্তর হলআমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, মাছটা ছেড়ে দিই রঞ্জু

কেন মামা? না, ছেড়ে দি। 

বলেই মাছটা জলে ফেললেনআমি চুপ করে রইলামনবু মামা বললেন, একবার আমি একটা পাখি ধরেছিলামটিয়া পাখিতারপর কী মনে করে ছেড়ে দিয়েছিআমার খুব লাভ হয়েছিল। 

অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

কী লাভ?‘ 

হয়েছিলআজকে মাছটা ছেড়ে দিলাম, দেখিস মাছটা দোওয়া করবে আমার জন্যে। 

নবু মামা পাটাতনে শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। 

বাড়ি এসে দেখি হুলস্থুল কাণ্ডলাল মামীর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে সফুরা খালারলাল মামী টেনে সফুরা খালার এক গােছা চুল তুলে ফেলেছে, গাল অাঁচড়ে দিয়েছেসফুরা খালা বিষম দৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেনলাল মামী তাঁর ঘরের দরজা 

বন্ধ করে রেখেছেনকারাে সঙ্গে কথাবার্তা নেই| বাদশা মামা আধময়লা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেনমাঝেমাঝে বলছেন, সবাই যদি এলাচির সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে বেচারি কী করবে? কেউ দেখতে পারে নাছােট নানিজান শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে পড়েছেনএক বার ধমকে দিলেন, যা তুই, খামাখা ঘ্যানঘ্যানভাল্লাগে না। 

বাদশা মামা উঠোনে গিয়ে বসে রইলেনবােকার মতাে তাকাতে লাগলেন এদিকসেদিকনবু মামাকে দেখে বললেন, দেখলি নবু, সফুরা কী ঝগড়া করল? এলাচির সারা দিন খাওয়া নাই। 

রাতের খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হলরান্নাবান্না হতে দেরি হয়েছেসংসারযাত্রা কিছু পরিমাণে বিপর্যস্তখাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমুতে এসে দেখি সফুরা খালা বসে আছেন আমাদের ঘরেসফুরা খালা বললেন, তােমাদের জন্যে বাইরের বাংলাঘরে বিছানা হয়েছেঘরে আমি থাকবতাকিয়ে দেখি পরিপাটি করে ঘর সাজানআমার আর নবু মামার ব্যাবহারিক জিনিসপত্র কিছুই নেই

অচিনপুর পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

নবু মামা বললেন, তুই থাকবি কেন এখানে? তাের নিজের ঘর কী হল?” 

আমার ঘরে পানি পড়ে, বিছানা ভিজে যায়‘ 

নবু মামা কিছুক্ষণ উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেনতারপর হনহন করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেনসফুরা খালা বললেন, রজু, তুমি নবুকে চোখে চোখে রাখবে। 

সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বাদশা মামার সঙ্গে দেখাবাদশা মামা বললেন, রজু, এলাচি ভাত খেয়েছে কিনা জানিস

জানি নামােহরের মা বলল, খেয়েছেতুই একটু খোঁজ নিয়ে আয়। 

আপনি নিজে যান না মামাআচ্ছা আচ্ছা, আমি নিজেই যাই‘ 

লাল মামী সেদিন নাখেয়ে ছিলেনরাতেও খেলেন না, দুপুরে ভাত নিয়ে গিয়ে মােহরের মা ফিরে এলসফুরা খালা অনেক অনুনয়বিনয় করলেন। কিন্তু লাভ হল নাশেষ পর্যন্ত নানাজান এলেনবিরক্ত দুঃখিত কণ্ঠে বললেন, সব 

কী বউ

লাল মামী কথা বললেন নানানাজান বললেন, খাও খাও, ভাত খাও!না, খব না। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *