টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছে। উচ্চকণ্ঠে কী যেন ঘােষণা করা হচ্ছে।
কৌতুহলী হয়ে দাঁড়াতেই দেখি বাদশা মামা বিব্রত মুখে সারা গায়ে চাদর এ}}}ড়া ইট। তার আগে আরেক জনকে টিনে বাড়ি দিয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে কী বলছে। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার, মামা?‘ ‘কিছু না, কিছু না।‘
ঢােল দিচ্ছে কে, আপনি নাকি?
কিসের জন্যে?‘
বাদশা মামা দাঁড়িয়ে পড়লেন। জড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘রহমত পাগলার জন্যে ঢােল দিচ্ছি। যদি কেউ পায়, তাহলে পাঁচ টাকা পুরস্কার।
কেন, কী হয়েছে?
বাদশা মামা এগিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু আমি ততক্ষণে তাঁর হাত চেপে ধরেছি। মামা অসহায়ভাবে তাকালেন আমার দিকে। আমি দৃঢ় গলায় বললাম,
বলেন কী ব্যাপার।‘
‘রঞ্জু, পাগলটাকে খেদিয়ে দেবার পর থেকে যত অশান্তি শুরু হয়েছে, ফিরিয়ে আনলে যদি সব মিটে––
মামা আমার হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।
বাদশা মামা আরাে অনেক রকম পাগলামি করতে লাগলেন। নানাজানের একটি আম–কাঁঠালের প্রকাণ্ড বাগান ছিল, জলের দরে সেটি বেচে দিলেন। বিক্রির টাকা দিয়ে নাকি মসজিদ করবেন। ছােট নানিজান কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, ‘এসব কী রে বাদশা?
অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
বাদশা মামা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন––সাদা পােশাক–পরা এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাঁকে বললেন, ‘মসজিদ কর, সব কিছু ঠিক হবে। ছােট নানিজান বললেন, ‘বাদশা, তুই মিথ্যা কথা বলছিস। বাদশা মামা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। মসজিদের জন্যে ইট পােড়ান হতে লাগল। ময়মনসিংহ থেকে রাজমিস্ত্রি এল। বিরাট এক মিলাদ মহফিলের মধ্যে মসজিদের কাজ শুরু হল।
নানাজানের দু’টি বিল ছিল। বিলের মাছ থেকে পয়সা আসত বিস্তর। সেই টাকায় সংসারখরচ গিয়েও বেশ মােটা অংশ জমত। বিল দু’টি একই সঙ্গে হাতছাড়া হয়ে গেল। কীভাবে হল, কেউ বলতে পারল না। নানিজান সারা দিন চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
রহিম শেখ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা রজু করল। সমস্তই মিথ্যা মামলা। বাদশা মামা নির্বিকার বসে আছেন মসজিদের সামনে। দেখছেন কী করে ইটের পর ইট বিছিয়ে ভিত তৈরি হচ্ছে। মামলার তদবিরের জন্য ছােট নানিজানকে নিয়ে আমিই যাওয়া–আসা করতে লাগলাম। দীর্ঘ দিন মামলা চলল। দু’টিতে জিত হল
আমাদের, একটি রহিম শেখ পেল।
অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
নানাজান হজ থেকে ফিরে এলেন এই সময়ে। সংসারের তখন ভরাডুবি ঘটেছে। রােজকার বাজারের টাকাতেও টানাটানি পড়তে শুরু করেছে। নানাজান কিছুই বললেন না। ছয় মাসেই তাঁর বয়স ছয় বছর বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে। নিষ্প্রভ, একা একা হাঁটতে পারেন না। লাঠিতে ক্স না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। চোখের সামনে সংসারকে ভেঙে পড়তে দেখলেন। তবু সকালবেলায় কোরান শরীফ ধরে বিলম্বিত সুরে পড়তে লাগলেন, ‘ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিন। অতএব তুমি আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করিবে?
বৎসর যাবার আগেই সম্পত্তির এক–তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে হল। বাদশা মামার মসজিদ ততদিনে শেষ হয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে চমৎকার নকশি কাটা গম্বুজ। ধবধবে সাদা দেয়ালে নীল হরফে লেখা কলমায়ে তৈয়ব। পাড়ার ছেলেমেয়েরা আমপারা হাতে সকালবেলাতেই মসজিদে ছবক নিতে আসে। দেখেশুনে বাদশা মামা মহাসুখী। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে মসজিদের সামনে পুকুর কাটিয়ে দিলেন। কী সুন্দর টলটলে জল পুকুরে, পাথরে বাঁধান প্রশস্ত ঘাট।
বাদশা মামাকে দেখে আমার নিজেরও ভালাে লাগে। সাদা গােলটুপি পরে চোখে সুর্মা দিয়ে কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে নামাজ পড়তে যান। এক দিন আমাকে ডেকে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘রঞ্জু, জুমার রাত্রে তাহায্যতের নামাজ পড়ে শুয়েছি, অম্নি স্বপ্নে দেখি––তাের লাল মামী যেন নৌকায় করে ফিরে আসছে। আসবে ফিরে, দেখিস তুই। বাদশা মামার চোখ আনন্দে চকচক করে।
অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
লাল মামীর কথা ভাবতে চাই না আমি। তবু বড়াে মনে পড়ে। কে জানে কোথায় সংসার পেতেছে তারা। নাকি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশময়। কোনাে দিন কি সত্যি ফিরে আসবে ধসে যাওয়া পরিবারটিকে শেষ বারের মতাে দেখে যেতে?
নিজের কথাও আজকাল খুব ভাবি। আজন্ম যে–রহস্যময়তার ভেতর বড়াে হয়েছি তা সরে সরে যায়। মনে হয় কিছুই রহস্য নয়। চাঁদের আলাে, ভােরের প্রথম সূর্য সমস্তই রহস্যের অতীত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী। যে–নিয়মের ভেতর আমরা জন্মাই, বড়াে হই, দুঃখকষ্ট পাই। দুঃখ ও সুখ কী তা নিয়েও ভাবতে চেষ্টা করি। মােহরের মা যখন তার আজীবন সঞ্চিত পোঁটলা–পুঁটলি নিয়ে অশ্রুসজল চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ও ব্যাটা রঞ্জু, যাই গো ব্যাটা। তােমার দুঃসময়ে একটা মানুষের বােঝা আর বাড়াইতাম না গাে।‘ তখন আমার কোনাে দুঃখবােধ হয়
এ যেন ঘটতই। তাহলে দুঃখ কী? নতুন করে আবার সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে শুনে ছােট নানিজান যখন উন্মাদের মতাে কাঁদেন, তখন বুঝি এই–ই দুঃখ। অথচ সফুরা
খালা যখন হাসিমুখে বলেন, গরিব মানুষ হওয়ার অনেক রকম মা আবে । তুমি ইচ্ছে মতাে ঘুরে বেড়াতে পারবে, কেউ কিছু বলবে না।‘ তখন সব ভাবনা–– চিন্তা জট পাকিয়ে যায়।
সন্ধ্যাবেলা আমি নানাজানের হাত ধরে তাঁকে বেড়াতে নিয়ে যাই। হিম লেগে তাঁর কাশি হয়, খুকখুক করে কাশেন। আমি যদি বলি চলেন ঘরে যাই, নানাজান আঁৎকে ওঠেন, না–না, আরেকটু––আরেকটু বেড়াই। পরম নির্ভরতার সঙ্গে তিনি আমার হাত ধরে হাঁটেন। বেলাশেষের সূর্যরশ্মি তাঁর সফেদ দাড়িতে চকচক করে।