অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

 টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছেউচ্চকণ্ঠে কী যেন ঘােষণা করা হচ্ছে

অচিনপুর

কৌতুহলী হয়ে দাঁড়াতেই দেখি বাদশা মামা বিব্রত মুখে সারা গায়ে চাদর }}}ড়া ইটতার আগে আরেক জনকে টিনে বাড়ি দিয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে কী বলছেআমি বললাম, কী ব্যাপার, মামা?কিছু না, কিছু না‘ 

ঢােল দিচ্ছে কে, আপনি নাকি

কিসের জন্যে?‘ 

বাদশা মামা দাঁড়িয়ে পড়লেনজড়িত কণ্ঠে বললেন, রহমত পাগলার জন্যে ঢােল দিচ্ছিযদি কেউ পায়, তাহলে পাঁচ টাকা পুরস্কার। 

কেন, কী হয়েছে

বাদশা মামা এগিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু আমি ততক্ষণে তাঁর হাত চেপে ধরেছিমামা অসহায়ভাবে তাকালেন আমার দিকেআমি দৃঢ় গলায় বললাম

বলেন কী ব্যাপার‘ 

রঞ্জু, পাগলটাকে খেদিয়ে দেবার পর থেকে যত অশান্তি শুরু হয়েছে, ফিরিয়ে আনলে যদি সব মিটে– 

মামা আমার হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। 

বাদশা মামা আরাে অনেক রকম পাগলামি করতে লাগলেননানাজানের একটি আমকাঁঠালের প্রকাণ্ড বাগান ছিল, জলের দরে সেটি বেচে দিলেনবিক্রির টাকা দিয়ে নাকি মসজিদ করবেনছােট নানিজান কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, এসব কী রে বাদশা

অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

বাদশা মামা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেনসাদা পােশাকপরা এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাঁকে বললেন, মসজিদ কর, সব কিছু ঠিক হবে। ছােট নানিজান বললেন, বাদশা, তুই মিথ্যা কথা বলছিসবাদশা মামা মাথা নিচু করে চলে গেলেনমসজিদের জন্যে ইট পােড়ান হতে লাগলময়মনসিংহ থেকে রাজমিস্ত্রি এলবিরাট এক মিলাদ মহফিলের মধ্যে মসজিদের কাজ শুরু হল। 

নানাজানের দুটি বিল ছিলবিলের মাছ থেকে পয়সা আসত বিস্তরসেই টাকায় সংসারখরচ গিয়েও বেশ মােটা অংশ জমতবিল দুটি একই সঙ্গে হাতছাড়া হয়ে গেলকীভাবে হল, কেউ বলতে পারল নানানিজান সারা দিন চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। 

রহিম শেখ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা রজু করলসমস্তই মিথ্যা মামলাবাদশা মামা নির্বিকার বসে আছেন মসজিদের সামনেদেখছেন কী করে ইটের পর ইট বিছিয়ে ভিত তৈরি হচ্ছেমামলার তদবিরের জন্য ছােট নানিজানকে নিয়ে আমিই যাওয়াআসা করতে লাগলাম। দীর্ঘ দিন মামলা চললদুটিতে জিত হল 

আমাদের, একটি রহিম শেখ পেল। 

অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

নানাজান হজ থেকে ফিরে এলেন এই সময়েসংসারের তখন ভরাডুবি ঘটেছেরােজকার বাজারের টাকাতেও টানাটানি পড়তে শুরু করেছেনানাজান কিছুই বললেন নাছয় মাসেই তাঁর বয়স ছয় বছর বেড়ে গেছেচোখের দৃষ্টি হয়েছেনিষ্প্রভ, একা একা হাঁটতে পারেন নালাঠিতে ক্স না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন নাচোখের সামনে সংসারকে ভেঙে পড়তে দেখলেনতবু সকালবেলায় কোরান শরীফ ধরে বিলম্বিত সুরে পড়তে লাগলেন, ‘ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিনঅতএব তুমি আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করিবে

বৎসর যাবার আগেই সম্পত্তির একতৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে হলবাদশা মামার মসজিদ ততদিনে শেষ হয়েছেমাথা তুলে দাঁড়িয়েছে চমৎকার নকশি কাটা গম্বুজধবধবে সাদা দেয়ালে নীল হরফে লেখা কলমায়ে তৈয়বপাড়ার ছেলেমেয়েরা আমপারা হাতে সকালবেলাতেই মসজিদে ছবক নিতে আসেদেখেশুনে বাদশা মামা মহাসুখীমহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে মসজিদের সামনে পুকুর কাটিয়ে দিলেনকী সুন্দর টলটলে জল পুকুরে, পাথরে বাঁধান প্রশস্ত ঘাট। 

বাদশা মামাকে দেখে আমার নিজেরও ভালাে লাগেসাদা গােলটুপি পরে চোখে সুর্মা দিয়ে কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে নামাজ পড়তে যানএক দিন আমাকে ডেকে একটু ইতস্তত করে বললেন, রঞ্জু, জুমার রাত্রে তাহায্যতের নামাজ পড়ে শুয়েছি, অম্নি স্বপ্নে দেখিতাের লাল মামী যেন নৌকায় করে ফিরে আসছেআসবে ফিরে, দেখিস তুই। বাদশা মামার চোখ আনন্দে চকচক করে। 

অচিনপুর পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

লাল মামীর কথা ভাবতে চাই না আমিতবু বড়াে মনে পড়েকে জানে কোথায় সংসার পেতেছে তারানাকি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশময়কোনাে দিন কি সত্যি ফিরে আসবে ধসে যাওয়া পরিবারটিকে শেষ বারের মতাে দেখে যেতে

নিজের কথাও আজকাল খুব ভাবিআজন্ম যেরহস্যময়তার ভেতর বড়াে হয়েছি তা সরে সরে যায়মনে হয় কিছুই রহস্য নয়চাঁদের আলাে, ভােরের প্রথম সূর্য সমস্তই রহস্যের অতীত প্রাকৃতিক নিয়মাবলীযেনিয়মের ভেতর আমরা জন্মাই, বড়াে হই, দুঃখকষ্ট পাইদুঃখ সুখ কী তা নিয়েও ভাবতে চেষ্টা করিমােহরের মা যখন তার আজীবন সঞ্চিত পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে অশ্রুসজল চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ব্যাটা রঞ্জু, যাই গো ব্যাটাতােমার দুঃসময়ে একটা মানুষের বােঝা আর বাড়াইতাম না গােতখন আমার কোনাে দুঃখবােধ হয় 

যেন ঘটতইতাহলে দুঃখ কী? নতুন করে আবার সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে শুনে ছােট নানিজান যখন উন্মাদের মতাে কাঁদেন, তখন বুঝি এইদুঃখঅথচ সফুরা 

খালা যখন হাসিমুখে বলেন, গরিব মানুষ হওয়ার অনেক রকম মা আবে তুমি ইচ্ছে মতাে ঘুরে বেড়াতে পারবে, কেউ কিছু বলবে নাতখন সব ভাবনাচিন্তা জট পাকিয়ে যায়। 

সন্ধ্যাবেলা আমি নানাজানের হাত ধরে তাঁকে বেড়াতে নিয়ে যাইহিম লেগে তাঁর কাশি হয়, খুকখুক করে কাশেনআমি যদি বলি চলেন ঘরে যাই, নানাজান আঁৎকে ওঠেন, নানা, আরেকটুআরেকটু বেড়াইপরম নির্ভরতার সঙ্গে তিনি আমার হাত ধরে হাঁটেনবেলাশেষের সূর্যরশ্মি তাঁর সফেদ দাড়িতে চকচক করে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *