অচিনপুর পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

মরবার পর কী হয়

আটবছর বয়সে এর উত্তর জানবার ইচ্ছে হলকোনাে গৃঢ় তত্ত্ব নিয়ে চিন্তার বয়স সেটি ছিল না, কিন্তু সত্যি সত্যি সেই সময়ে আমি মৃত্যুরহস্য নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েছিলাম| সন্ধ্যাবেলা নবু মামাকে নিয়ে গা ধুতে গিয়েছি পুকুরেচারিদিক ঝাপসা করে অন্ধকার নামছে

অচিনপুর

এমন সময়ে হঠাৎ করেই আমার জানবার ইচ্ছে হল, মরবার পর কী হয়? আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, নবু মামা, নবু মামা। 

নবু মামা সাঁতরে মাঝপুকুরে চলে গিয়েছিলেনতিনি আমার কথা শুনতে পেলেন নাআমি আবার ডাকলাম, নবু মামা, রাত হয়ে যাচ্ছে। 

আর একটুভয় লাগছে আমার‘ 

একা একা পাড়ে বসে থাকতে সত্যি আমার ভয় লাগছিলনবু মামা উঠে আসতেই বললাম, মরবার পর কী হয় মামা?নবু মামা রেগে গিয়ে বললেন, সন্ধ্যা বেলা কী বাজে কথা বলিস?নবু মামা ভীষণ ভীতু ছিলেন, আমার কথা শুনে তাঁর ভয় ধরে গেলসে সন্ধ্যায় দুজনে চুপি চুপি ফিরে চলেছিরইসুদ্দিন চাচার কবরের পাশ দিয়ে আসবার সময় দেখি, সেখানে কে দুটি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রেখে গেছেদুটি লিকলিকে ধোঁয়ার শিখা উড়ছে সেখানে থেকেভয় পেয়ে নবু মামা আমার হাত চেপে ধরলেন। 

অচিনপুর পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

শৈশবের এই অতি সামান্য ঘটনাটি আমার খুব স্পষ্ট মনে আছেপরিণত বয়সে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছিছােট একটি ছেলে মৃত্যুর কথা মনে করে একা কষ্ট পাচ্ছেভাবতেও আমার খারাপ লাগত। 

সত্যি তাে, সামান্য কোনাে ব্যাপার নিয়ে ভাববার মতাে মানসিক প্রস্তুতি যার নেই, সে কেন কবরে ধূপের শিখা দেখে আবেগে টলমল করবে? কেন সে একা একা চলে যাবে সােনাখালি? সােনাখালি খালের বাঁধান পুলের উপর বসে থাকতে থাকতে এক সময় তার কাঁদতে ইচ্ছে হবে

আসলে আমি মানুষ হয়েছি অদ্ভুত পরিবেশেপ্রকাণ্ড একটি বাড়ির অগুনতি রহস্যময় কোঠাবাড়ির পেছনে জড়াজড়ি করা বাঁশবনদিনমানেই শেয়াল ডাকছে চারিদিকেসন্ধ্যা হবহব সময়ে বাঁশবনের এখানেওখানে জ্বলে উঠছে ভূতের আগুনদোতলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে বিচিত্র সুরে কোরান পড়তে শুরু করেছে কানাবিবি! সমস্তই অবিমিশ্র ভয়ের। 

আবছা অন্ধকারে কানাবিবির দুলে দুলে কোরানপাঠ শুনলেই বুকের ভেতর ধক্ করে উঠতনানিজান বলতেন, কানার কাছে এখন কেউ যেও না গােশুধু কানাবিবির কাছেই নয়, মােহরের মা পা ধােয়াতে এসে বলত, পুলাপান কুয়াতলায় কেউ যেও নাকুয়াতলায় সন্ধ্যাবেলায় কেউ যেতাম নাসেখানে খুব একটা ভয়ের ব্যাপার ছিলওখানে সন্ধ্যাবেলায় যেতে নেই। 

অচিনপুর পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

 চারিদিকেই ভয়ের আবহাওয়ানানিজানের মেজাজ ভালাে থাকলে গল্প ফাঁদতেনসেও ভূতের গল্প ও হাট থেকে শােল মাছ কিনে ফিরছেন তাঁর চাচাচারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছেশ্রাবণ মাস, বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপডিসট্রিক্ট বাের্ডের সড়ক ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছেন, ওমনি পেছন থেকে নাকী সুরে কে চেচিয়ে উঠল, মাছটা আঁমারে দিয়ে যা। 

রাতের বেলা ঘুমিয়েপড়া ছেলেমেয়েদের জাগিয়ে এনে ভাত খাওয়াত মােহরের মালম্বা পাটিতে সারি সারি থালা পড়তঘুমঘুম চোখে ভাত মাখাচ্ছি, এমন সময় হয়তাে ঝুপ করে শব্দ হল বাড়ির পেছনেমােহরের মা খসখসে গলায় চেচিয়ে উঠল, পেততুনি নাকি? পেততুনি নাকি রে

নবু মামা প্রায় আমার গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে চাপা সুরে বলত, ‘ভয় পাচ্ছি, মােহরের মা, আমার ভয় লাগছে| নানাজানের সেই প্রাচীন বাড়িতে যা ছিল, সমস্তই রক্ত জমাটকরা ভয়েরকানাবিবি তার একটিমাত্র তীক্ষ্ণ চোখে কেমন করেই না তাকাত আমাদের দিকেনবু মামা বলত, বুড়ি, আমার দিকে তাকালে কঞ্চি দিয়ে চোখ গেলে দেবকানাবিবি কিছু না বলে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসতমাঝেমধ্যে বলত, পুলাপান উরাও কেন? আমি কিতা? পেত্নী?পেত্নী না হয়েও সে আমাদের কাছে অনেক বেশি ভয়াবহ ছিলশুধু আমরা নই, বড়ােরাও তাকে সমীহ করে চলতেন। আর সমীহ করবে নাইবা কেন? বড়াে নানিজানের নিজের মুখ থেকে শােনা গল্প

অচিনপুর পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

তাঁর বাপের দেশের মেয়ে কানাবিবিবিয়ের সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেনফাইফরমাস খাটেহেসেখেলে বেড়ায়এক দিন দুপুরে সে পেটের ব্যথায় মরােমরােকিছুতেই কিছু হয় না, এখন যায় তখন যায় অবস্থানানাজান লােক পাঠিয়েছেন আশু কবিরাজকে আনতেআশু কবিরাজ এসে দেখে সব শেষবরফের মতাে ঠাণ্ডা শরীরখাটিয়ায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁশ কাটতে লােক গেলনানিজান মড়ার মাথার কাছে বসে কোরান পড়তে লাগলেনঅদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটলঠিক তখনই

আমার নানিজান ভয়ে ফিট হয়ে গেলেননানাজান আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ, কারণ কানাবিবি সেসময়ে ভালাে মানুষের মতাে উঠে বসে পানি খেতে চাচ্ছেএর পর থেকে স্বভাবচরিত্রে আমূল পরিবর্তন হল তারদিনরাত নামাজ রােজাআমরা যখন কিছু কিছু জিনিস বুঝতে শিখেছি তখন থেকে দেখছি, সে পাড়ার মেয়েদের ভাবিজকবজ দিচ্ছেসন্ধ্যা হতে হতেই দোতলার বারান্দায় কুপি জ্বালিয়ে বিচিত্র সুরে কোরান পড়ছেভয় তােকে পাবে না কেন?

অচিনপুর পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

তাে গেল রাতের ব্যাপারদিনের বেলাও কি নিস্তার আছে? গােল্লাছুট খেলতে গিয়ে যদি ভুলে কখনাে পুবের ঘরের কাছাকাছি চলে গিয়েছি, ওমনি রহমত মিয়া বাঘের মতাে গর্জন করে উঠেছে, খাইয়া ফেলুমপােলা, কাঁচা খাইয়া ফেলামুকচ কচ কচভয়ানক জোয়ান একটা পুরুষ শিকল দিয়ে বাঁধাব্যাপারটাই ভয়াবহ! বদ্ধ পাগল ছিল রহমত মিয়া, নানাজানের নৌকার মাঝিতিনি রহমতকে স্নেহ করতেন খুব, সারিয়ে তুলতে চেষ্টাও করেছিলেনলাভ হয় নি। 

সমস্ত মিলিয়ে তৈরি হয়েছে আমার শৈশবগাঢ় রহস্যের মতাে ঘিরে রয়েছে আমার চারিদিকআমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অল্প বয়সের ভয়কাতর একটি ছেলে তার নিত্যসঙ্গী নবুমামার হাত ধরে ঘুমুতে যাচ্ছে দোতলার ঘরেনবু মামা বলছেন, তুই ভিতরের জানালা দুটি বন্ধ করে আয়, আমি দাঁড়াচ্ছি বাইরেআমি বলছি, আমার ভয় করছে, আপনিও আসেনমামা মুখ ভেংচে বলছেন, এতেই ভয় ধরে গেল

টেবিলে রাখা হ্যারিকেন থেকে আবছা আলাে আসছেআমি আর নবু মামা কুকুরকুণ্ডলী হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছিনবু মামা শুতেনাশুতেই ঘুমএকা একা ভয়ে আমার কান্না আসছেএমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে হৈচৈ শােনা গেলশুনলাম, খড়ম পায়ে খটখট করে কে যেন এদিকে আসছেমােহরের মা মিহি সুরে কাঁদছে, আমি অনেকক্ষণ সেই কান্না শুনে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। জানতেও পারি নি সেরাতে আমার মা মারা গিয়েছিলেন

অচিনপুর পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

সেরাতে আমার ঘুম ভেঙেছিল ফজরের নামাজের সময়জেগে দেখি বাদশা মামা চুপচাপ বসে আছেন চেয়ারেআমাকে বললেন, আর ঘুমিয়ে কি করবি, আয় বেড়াতে যাইআমরা সােনাখালির খাল পর্যন্ত চলে গেলামসেখানে পাকা পুলের উপর দু জনে বসে বসে সূর্যোদয় দেখলামপ্রচণ্ড শীত পড়েছিল সেবারকুয়াশার চাদরে গাছপালা ঢাকাসূর্যের আলাে পড়ে শিশিরভেজা পাতা চকচক করছেকেমন অচেনা লাগছে সবকিছুমামা অন্যমনস্কভাবে বললেন, রজু, আজ তাের খুব দুঃখের দিন! দুঃখের দিনে কী করতে হয়, জানিস

হা হা করে হাসতে হয়হাসলেই আল্লা বলেন, একে দুঃখ দিয়ে কোনাে লাভ নেইএকে সুখ দিতে হবেবুঝেছিস

বুঝেছিবেশ, তাহলে হাসি দে আমার সঙ্গে। 

এই বলে তিনি হাে হাে করে হেসে উঠলেনবাদশা মামার খুব মােটা গলা ছিলতাঁর হাসিতে চারিদিক গমগম করতে লাগলআমিও তাঁর সঙ্গে গলা মেলালামবাদশা মামা বললেন, আজ আর বাসায় ফিরে কাজ নেই, চল শ্রীপুর যাইসেখানে আজ যাত্রা হবেআমি মহা খুশি হয়ে তাঁর সঙ্গে চললাম। 

কত দিনকার কথা, কিন্তু সব যেন চোখের সামনে ভাসছে। 

বাদশা মামার সঙ্গে আমার কখনাে অন্তরঙ্গতা হয় নিঅথচ আমরা একই ঘরে থাকতামদোতলার সবচেয়ে দক্ষিণের ঘরে দুটো খাটের একটিতে বাদশা মামা, অন্যটিতে আমি আর নবু মামাসারা দিন বাদশা মামার দেখা নেই

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *