রাতে কখন যে ফিরতেন, তা কোনাে দিনই জানি নি। ঘুম ভাঙার আগে আগেই চলে গেছেন। কোনাে কোনাে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি, গুনগুন করে কী পড়ছেন।
যেদিন মেজাজ ভালাে থাকত, সেদিন খুশিখুশি গলায় বলতেন, ‘রজু, শােন তাে দেখি, কেমন হচ্ছে বলবি।” আমি হঠাৎ ঘুমভাঙা অবস্থায় কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। মামা দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলা শুরু করেছেন
এ রাজ্যপার্ট যায় যাক, কোনাে ক্ষতি নাই কিন্তু ত্রিদিব তুমি
কোথা যাবে? ভরাট গলা ছিল তাঁর, সমস্ত ঘর কেঁপে কেঁপে উঠত। মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতেন, ‘দাঁড়া, পােশাকটা পরে নিই, পােশাক ছাড়া ভালাে হয় না। তােল, নবুকে ঘুম থেকে তােল। নবু মামার ঘুম ভাঙালেই প্রথম কিছুক্ষণ নাকী সুরে কাঁদত। বাদশা মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘গাধা! দেখ না কি করছি। তারপর দু‘ জনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি বাদশা মামার দিকে। আলমারি খুলে তিনি মুকুট বের করেছেন, জরিদার পােশাক পরেছেন। তারপর একা একাই অভিনয় করে চলেছেন। আমরা দুই শিশু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
বাদশা মামা প্রথম থেকেই আমাদের কাছে দূরের মানুষ। যিনি জরির পােশাক পরে রাত দুপুরে আমাদের অভিনয় দেখান, তিনি কাছের মানুষ হতে পারেন না। বাড়ির মানুষের কাছেও তিনি দলছাড়া। খুব ছােটবেলায় নানাজান তাঁকে এক বার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। যে– ছেলে স্কুল পালিয়ে যাত্রাদলে চলে যায়, নানাজানের মতাে লােক তাকে ঘরে রাখতে পারেন না। খবর শুনে ছােট নানিজান খাওয়াদাওয়া ছাড়লেন। মমেরাে অবস্থা। নানাজান লােক পাঠিয়ে বাদশা মামাকে ফিরিয়ে আনলেন। সেই থেকে তিনি বাদশা মামাকে ঘাঁটান না। বাদশা মামাও আছেন আপন মনে।
অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
বাদশা মামা আমার শিশুচিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিলেন। শিল্পীরা সব সময়ই শিশুদের আকর্ষণ করে। হয়তাে শিশুরাই প্রতিভার খবর পায় সবার আগে, কিন্তু বাদশা মামা দারুণ অসুখী ছিলেন। যে–সামাজিক পদমর্যাদা তাঁর ছিল, তা নিয়ে যাত্রাদলের মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন না। অথচ তাঁর চিন্তা ভাবনার সমস্ত জগৎ যাত্রাদলকে ঘিরে। মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখেছি বারান্দায় চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছেন। যদি গিয়ে বলেছি, মামা, কী করেন?
‘কিছু না।
সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়েছে, মামা তেমনি বসেই আছেন। কেউ যদি গিয়ে বলেছে, ‘বাদশা তাের কী হয়েছে রে?
‘কিছু না।
মাঝে মাঝেই এ রকম হ‘ত তাঁর। নানাজান তখন ক্ষেপে যেতেন। ঘােট নানিজানকে ডেকে বলতেন, ‘ভাং ধরেছে নাকি? শক্ত মুগুর দিয়ে পেটালে ঠিক হয়, বুঝেছ? নানিজান মিনমিন করে কী কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করেন। তারপর একসময় দেখা যায়, তিনি বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন।
নানাজানকে সবাই ভয় করতাম আমরা। দোতলা থেকে একতলায় তিনি নেমে এলে একতলা নীরব হয়ে যেত। খুব কমবয়সী শিশু, যাদের এখনাে বিচারবুদ্ধিও হয় নি, তারাও নানাজানকে দেখলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত। ভয়টাও বহুলাংশে। সংক্রামক। | ভােরবেলায় ঘুম ভাঙত নানাজানের কোরানপাঠের শব্দে। মােটা গলা, টেনে টেনে একটু অনুনাসিক সুরে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। তখন মাথায় থাকত লাল রংয়ের ঝুটিওয়ালা একটা ফেজ টুপি। খালি গা, পরনে সিল্কের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ঝুকে ঝুঁকে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। পড়া শেষ হয়ে। গেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেন। ছােট নানিজান এই সময়ে জামবাটিতে বড়াে এক বাটি চা তৈরি করে নিয়ে যেতেন। নানাজান চুকচুক করে অনেকটা সময় নিয়ে চা খেতেন। তারপর নিজের হাতে হাঁসের খোঁয়াড় খুলে দিতেন। পাশেই মুরগির খোঁয়াড়, সেটিতে হাতও দিতেন না। হাঁসগুলি ছাড়া পেয়ে দৌড়ে যেত পুকুরের ।
অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
দিকে। তিনিও যেতেন পিছু পিছু। সমস্তই রুটিন–বাঁধা, এক চুলও এদিক–ওদিক হবার জো নেই।
কিছু কিছু মানুষ ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে, আবার কারাে কারো কাছে ভাগ্য আপনি এসে ধরা দেয়। নানাজান এ দু‘টির কোনােটির মধ্যেই পড়েন না। পূর্বপুরুষের গড়ে–যাওয়া সম্পদ ও সম্মানে লালিত হয়েছেন। কিন্তু অসংযমী হন নি। অহংকার ছিল খুব, সে–অহংকার প্রকাশ পেত বিনয়ে। হয়তাে কোনাে আত্মীয় কুটুষ এসেছে বেড়াতে, নানাজান ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বারবার বলছেন, গরিবের ঘরে এসেছেন, কী দিয়ে খেদমত করি, বড়াে সরমিন্দায় পড়লাম, বড়াে কষ্ট হল আপনার। ওরে তামুক আন, আর খাসি ধর দেখি একটা ভালাে দেখে। যিনি এসেছেন, আয়ােজনের বাহুল্য দেখে তিনি লজ্জায় পড়ে যেতেন।
পয়ত্রিশ বছর আগের দেখা চিত্র। স্মৃতি থেকে লিখছি। সে–স্মৃতিকে বিশ্বাস কর চলে।
আমরা যারা ছেলে–ছােকড়ার দলে, তাদের প্রতি নানাজানের কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল !
একা একা থাকতেন সারাক্ষণই। বড়াে নানিজান তাে কিছু পরিমাণে অপ্রকৃতিস্থই ছিলেন। তিনি দোতলা থেকে নামতেন কালেভদ্রে। ছােট নানিজানও যে কখনাে হালকা সুরে নানাজানের সঙ্গে আলাপ করছেন, এমন দেখি নি কখনাে। খালারাও আমাদের মতাে দূরে দূরে থাকতেন। ক্ষমতাবান লােকরা সব সময়ই এমন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে যায়।
কেন জানি না, আমার নিজের খুব ইচ্ছে হত, নানাজানের সঙ্গে ভাব করি। ঘুমাতে যাবার আগে কত দিন ভেবেছি, নানাজান যেন এসে আমাকে বলছেন––‘আয় রঞ্জু, বেড়াতে যাই। আমি তাঁর হাত ধরে চলেছি বেড়াতে। কত দিন ভেবেছি, আজ ঘুম থেকে উঠেই নানাজানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।
অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
কিন্তু সে আর হয়ে ওঠে নি। ঘুম ভাঙতেই তাড়া পড়েছে, ‘ওজু করে পড়তে যা, ওজু করে পড়তে যা। মৌলভী সাহেব বসে আছেন বাইরের ঘরে। আমরা সবাই আমপারা হাতে করে একে একে হাজির হচ্ছি। মেয়েরা ডান পাশে, ছেলেরা বাঁ পাশে। সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ উঠছে, ‘আলিফ দুই পেশ উন, বে দুই পেশ বুন। নাশতা তৈরি হওয়ামাত্র আরবি পড়া শেষ। তারপর ইংরেজি, বাংলা আর অঙ্কের পড়া। পড়াতে আসতেন রাম মাষ্টার। ভারি ভালাে মাষ্টার। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতেন। নবু মামা ছাড়া বানিয়েছিলেন––
‘রাম মাষ্টার বুড়া
এক পা তার খোঁড়া স্কুলে যাবার আগে পর্যন্ত পড়াতেন তিনি। তাঁর কাছে পড়ত শুধু ছেলেরাই। মেয়েদের
আরবি ছাড়া অন্য কিছু পড়বার প্রয়ােজন ছিল না। তারা ঘরের কাজ করত, জরি দিয়ে লতাপাতা ফুল বানাত, বালিশের ওয়াড়ে নকশা তুলে লিখত, ‘ভূল না আমায়‘। রাম মাষ্টার চলে যেতে যেতে স্কুলের বেলা হয়ে যেত। স্কুল শেষ হয়ে গেলে তাে খেলারই পাট। সূর্য ডুবে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত চলত হৈহৈ। ফুরসত ফেলার সময় নেই। এর মধ্যেই লিলি এসে আমাকে নিয়ে যেত বাড়ির ভেতর। সে নিজেকে সব সময় ভাবত আমার এক জন অভিভাবক।