অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ

রাতে কখন যে ফিরতেন, তা কোনাে দিনই জানি নিঘুম ভাঙার আগে আগেই চলে গেছেনকোনাে কোনাে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি, গুনগুন করে কী পড়ছেন

অচিনপুর

যেদিন মেজাজ ভালাে থাকত, সেদিন খুশিখুশি গলায় বলতেন, রজু, শােন তাে দেখি, কেমন হচ্ছে বলবিআমি হঠাৎ ঘুমভাঙা অবস্থায় কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি নামামা দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলা শুরু করেছেন 

রাজ্যপার্ট যায় যাক, কোনাে ক্ষতি নাই কিন্তু ত্রিদিব তুমি 

কোথা যাবে? ভরাট গলা ছিল তাঁর, সমস্ত ঘর কেঁপে কেঁপে উঠতমাঝপথে থেমে গিয়ে বলতেন, দাঁড়া, পােশাকটা পরে নিই, পােশাক ছাড়া ভালাে হয় নাতােল, নবুকে ঘুম থেকে তােলনবু মামার ঘুম ভাঙালেই প্রথম কিছুক্ষণ নাকী সুরে কাঁদতবাদশা মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন, গাধা! দেখ না কি করছিতারপর দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি বাদশা মামার দিকেআলমারি খুলে তিনি মুকুট বের করেছেন, জরিদার পােশাক পরেছেনতারপর একা একাই অভিনয় করে চলেছেনআমরা দুই শিশু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। 

বাদশা মামা প্রথম থেকেই আমাদের কাছে দূরের মানুষযিনি জরির পােশাক পরে রাত দুপুরে আমাদের অভিনয় দেখান, তিনি কাছের মানুষ হতে পারেন নাবাড়ির মানুষের কাছেও তিনি দলছাড়াখুব ছােটবেলায় নানাজান তাঁকে এক বার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেনযেছেলে স্কুল পালিয়ে যাত্রাদলে চলে যায়, নানাজানের মতাে লােক তাকে ঘরে রাখতে পারেন নাখবর শুনে ছােট নানিজান খাওয়াদাওয়া ছাড়লেনমমেরাে অবস্থানানাজান লােক পাঠিয়ে বাদশা মামাকে ফিরিয়ে আনলেনসেই থেকে তিনি বাদশা মামাকে ঘাঁটান নাবাদশা মামাও আছেন আপন মনে

অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ 

বাদশা মামা আমার শিশুচিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিলেনশিল্পীরা সব সময়ই শিশুদের আকর্ষণ করেহয়তাে শিশুরাই প্রতিভার খবর পায় সবার আগে, কিন্তু বাদশা মামা দারুণ অসুখী ছিলেনযেসামাজিক পদমর্যাদা তাঁর ছিল, তা নিয়ে যাত্রাদলের মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন নাঅথচ তাঁর চিন্তা ভাবনার সমস্ত জগৎ যাত্রাদলকে ঘিরেমাঝে মাঝেই তাঁকে দেখেছি বারান্দায় চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছেনযদি গিয়ে বলেছি, মামা, কী করেন

কিছু না। 

সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়েছে, মামা তেমনি বসেই আছেনকেউ যদি গিয়ে বলেছে, বাদশা তাের কী হয়েছে রে

কিছু না। 

মাঝে মাঝেই রকম ত তাঁরনানাজান তখন ক্ষেপে যেতেনঘােট নানিজানকে ডেকে বলতেন, ভাং ধরেছে নাকি? শক্ত মুগুর দিয়ে পেটালে ঠিক হয়, বুঝেছ? নানিজান মিনমিন করে কী কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করেনতারপর একসময় দেখা যায়, তিনি বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন। 

নানাজানকে সবাই ভয় করতাম আমরাদোতলা থেকে একতলায় তিনি নেমে এলে একতলা নীরব হয়ে যেতখুব কমবয়সী শিশু, যাদের এখনাে বিচারবুদ্ধিও হয় নি, তারাও নানাজানকে দেখলে ফ্যাকাসে হয়ে যেতভয়টাও বহুলাংশেসংক্রামক| ভােরবেলায় ঘুম ভাঙত নানাজানের কোরানপাঠের শব্দেমােটা গলা, টেনে টেনে একটু অনুনাসিক সুরে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেনতখন মাথায় থাকত লাল রংয়ের ঝুটিওয়ালা একটা ফেজ টুপিখালি গা, পরনে সিল্কের ধবধবে সাদা লুঙ্গিহাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ঝুকে ঝুঁকে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেনপড়া শেষ হয়েগেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেনছােট নানিজান এই সময়ে জামবাটিতে বড়াে এক বাটি চা তৈরি করে নিয়ে যেতেননানাজান চুকচুক করে অনেকটা সময় নিয়ে চা খেতেনতারপর নিজের হাতে হাঁসের খোঁয়াড় খুলে দিতেনপাশেই মুরগির খোঁয়াড়, সেটিতে হাতও দিতেন নাহাঁসগুলি ছাড়া পেয়ে দৌড়ে যেত পুকুরের ।

অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ 

দিকেতিনিও যেতেন পিছু পিছুসমস্তই রুটিনবাঁধা, এক চুলও এদিকওদিক হবার জো নেই। 

কিছু কিছু মানুষ ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে, আবার কারাে কারো কাছে ভাগ্য আপনি এসে ধরা দেয়নানাজান দুটির কোনােটির মধ্যেই পড়েন নাপূর্বপুরুষের গড়েযাওয়া সম্পদ সম্মানে লালিত হয়েছেনকিন্তু অসংযমী হন নিঅহংকার ছিল খুব, সেঅহংকার প্রকাশ পেত বিনয়েহয়তাে কোনাে আত্মীয় কুটুষ এসেছে বেড়াতে, নানাজান ব্যস্ত হয়ে উঠেছেনবারবার বলছেন, গরিবের ঘরে এসেছেন, কী দিয়ে খেদমত করি, বড়াে সরমিন্দায় পড়লাম, বড়াে কষ্ট হল আপনারওরে তামুক আন, আর খাসি ধর দেখি একটা ভালাে দেখেযিনি এসেছেন, আয়ােজনের বাহুল্য দেখে তিনি লজ্জায় পড়ে যেতেন। 

পয়ত্রিশ বছর আগের দেখা চিত্রস্মৃতি থেকে লিখছিসেস্মৃতিকে বিশ্বাস কর চলে। 

আমরা যারা ছেলেছােকড়ার দলে, তাদের প্রতি নানাজানের কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল !

একা একা থাকতেন সারাক্ষণইবড়াে নানিজান তাে কিছু পরিমাণে অপ্রকৃতিস্থই ছিলেনতিনি দোতলা থেকে নামতেন কালেভদ্রেছােট নানিজানও যে কখনাে হালকা সুরে নানাজানের সঙ্গে আলাপ করছেন, এমন দেখি নি কখনােখালারাও আমাদের মতাে দূরে দূরে থাকতেনক্ষমতাবান লােকরা সব সময়ই এমন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে যায়। 

কেন জানি না, আমার নিজের খুব ইচ্ছে হত, নানাজানের সঙ্গে ভাব করিঘুমাতে যাবার আগে কত দিন ভেবেছি, নানাজান যেন এসে আমাকে বলছেনআয় রঞ্জু, বেড়াতে যাইআমি তাঁর হাত ধরে চলেছি বেড়াতেকত দিন ভেবেছি, আজ ঘুম থেকে উঠেই নানাজানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব

অচিনপুর পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ 

কিন্তু সে আর হয়ে ওঠে নিঘুম ভাঙতেই তাড়া পড়েছে, ওজু করে পড়তে যা, ওজু করে পড়তে যামৌলভী সাহেব বসে আছেন বাইরের ঘরেআমরা সবাই আমপারা হাতে করে একে একে হাজির হচ্ছিমেয়েরা ডান পাশে, ছেলেরা বাঁ পাশেসমবেত কণ্ঠে আওয়াজ উঠছে, আলিফ দুই পেশ উন, বে দুই পেশ বুননাশতা তৈরি হওয়ামাত্র আরবি পড়া শেষতারপর ইংরেজি, বাংলা আর অঙ্কের পড়াপড়াতে আসতেন রাম মাষ্টারভারি ভালাে মাষ্টারখুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতেননবু মামা ছাড়া বানিয়েছিলেন– 

রাম মাষ্টার বুড়া 

এক পা তার খোঁড়া স্কুলে যাবার আগে পর্যন্ত পড়াতেন তিনিতাঁর কাছে পড়ত শুধু ছেলেরাইমেয়েদের 

আরবি ছাড়া অন্য কিছু পড়বার প্রয়ােজন ছিল নাতারা ঘরের কাজ করত, জরি দিয়ে লতাপাতা ফুল বানাত, বালিশের ওয়াড়ে নকশা তুলে লিখত, ভূল না আমায়রাম মাষ্টার চলে যেতে যেতে স্কুলের বেলা হয়ে যেত। স্কুল শেষ হয়ে গেলে তাে খেলারই পাটসূর্য ডুবে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত চলত হৈহৈফুরসত ফেলার সময় নেইএর মধ্যেই লিলি এসে আমাকে নিয়ে যেত বাড়ির ভেতরসে নিজেকে সব সময় ভাবত আমার এক জন অভিভাবক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *