সে যে আমার বড়াে বােন এবং নানাজানের এই প্রকাণ্ড বাড়িতে আমিই যে তার সবচেয়ে নিকটতম জন, তা জানাতে তার ভারি আগ্রহ ছিল।
শাড়ি–পরা হালকা–পাতলা শরীর কোনাে ফাঁকে আমার নজরে পড়ে গেলেই মন খারাপ হয়ে যেত। অবধারিতভাবে সে হাত ইশারা করে আমায় ডাকবে। ফিসফিস করে বলবে, ‘কাল সবাই দু‘খান করে মাছ ভাজা খেয়েছে, আর তুই যে মােটে একটা নিলি ?
‘একটাই তাে দিয়েছে আমাকে।‘ ‘বােকা কোথাকার! তুই চাইতে পারলি না? আর দুধ দেবার সময় বলতে পারিস না, আরেক হাতা দুধ দাও মােহরের মা।
‘দুধ ভালাে লাগে না আমার।‘ ‘ভালাে না লাগলে হবে? স্বাস্থ্য ভালাে করতে হবে না? বেকুব কোথাকার!‘
এই বলে সে হয়তাে কাঁচা–মিঠা গাছের আম এনে দিল আমার জন্য। আবার কোনাে দিন হয়তাে ডেকে নিয়ে গেল বাড়ির পেছনে। আগের মতাে গলা নেমে গেছে খাদে। ফিসফিস করে বলছে, কী ভাবিস তুই, আমরা কি ফ্যালনা? বড়াে নানিজানের সম্পত্তির অংশ পাব না আমরা? নিশ্চয়ই পাব। বড়াে নানিজানের মেলা সম্পত্তি। আর আমাদের মা হচ্ছে তার একমাত্র মেয়ে। আমরা দু‘ জনেই শুধু ওয়ারিসান। বুঝলি?
অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
‘হ্যা, বুঝেছি।
‘কাঁচকলাটা বুঝেছিস। হাঁদার বেহদ্দ তুই। ছি ছি, এতটুকু বুদ্ধিও নেই! নে, এটা রাখ তাের কাছে।
তাকিয়ে দেখলাম, চকচকে সিকি একটা। কই পেয়েছ?
‘আমার ছিল,‘ বলেই লিলি আবার ফিসফিস করে বলল, দেখিস, আবার গাধার মতাে সবাইকে বলে বেড়াবি না।‘
‘না, বলব না।‘
লিলির ভাবভঙ্গি থেকে বােঝা যায়, পয়সাটা অন্যভাবে যােগাড় করেছে সে। আমরা দু‘ ভাই–বােন কখনাে হাতে পয়সা পেয়েছি, এমন মনে পড়ে না। অল্প বয়সে স্নেহটাকে বন্ধন মনে হ‘ত। না চাইতেই যা পাওয়া যায় তা তাে সব সময়ই মূল্যহীন।
লিলিকে ভালাে লাগত কালেভদ্রে। যেদিন সে খেয়ালের বসে সামান্য সা করে, লজ্জা মেশান গলায় আমাকে দোতলায় ডেকে নিয়ে যেত, সেদিন তাকে আমি সত্যি সত্যি ভালােবাসতাম। কিংবা কে জানে অল্প বয়সেই হয়তাে করুণা করতে শিখে গিয়েছিলাম। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নাক মুখ অল্প লাল করে বলত–– ‘আমার বিয়ে হয়ে গেলে তােকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব, তুই থাকবি আমার সঙ্গে।
কবে বিয়ে? হবে শিগগির।
তারপরই যেন নেহায়েত একটা কথার কথা, এমনিভাবে বলে বসত, দেখ তাে রঞ্জু, শাড়িতে আমাকে কেমন মানায়।
ভালাে। কিন্তু আমার নাকটা যে একটু থ্যাবড়া। এ বাড়ির কাউকেই লিলি দেখতে পারত না। ভেবে পাই না কেমন করে এত হিংসা পুষে সে বড়াে হয়েছে। আমি ছাড়া আর একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে তার অল্পবিস্তর খাতির ছিল। তিনি আমাদের বড়াে নানিজান। বড়াে নানিজান থাকতেন দোতলায় বাঁদিকের সবচেয়ে শেষের ঘরটায়। অন্ধকার ছােট একটি কুঠুরি। জানালার সামান্য যে ফাঁক দিয়ে আলাে–বাতাস আসে, তাও গাবগাছের ঝাঁকড়া ডালপালা অন্ধকার করে রেখেছে। আলাে–বাতাসহীন সেই অল্পপরিসর ঘরে বড়াে নানিজান রাত–দিন বসে আছেন। দেখে মনে হবে নানাজানের দেড় গুণ বেশি বয়স। মাথায় সমস্ত চুল পেকে ধবধব করছে। দাঁত পড়ে গাল বসে গেছে। নিচের মাটীতে একটিমাত্র নােংরা হলুদ দাঁত।
অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
মাঝেমধ্যে তিনি রেলিং ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে নিচে নেমে আসতেন। কী ঘূর্তি তখন আমাদের! সবাই ভিড় করেছি তাঁর চারপাশে। নানিজান মস্ত একটি মাটির গামলায় দু‘ পয়সা দামের হলুদ রঙের হেনরী সাবান গুলে ফেনা তৈরি করেছেন। ফেনা তৈরি হলেই ঢালাও হুকুম––মুরগি ধইরা আন। মুরগি ধরে আনবার জন্য ছােটাছুটি পড়ে যেত আমাদের মধ্যে। সব মুরগি নয়। শুধু ধবধবে সাদা মুরগি ধরে আনবার পালা। নানিজান সেগুলিকে সাবান গােলা পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করতেন। পাশেই বালতিতে নীল রং গােলা থাকত। ধােয়া হয়ে গেলেই রং–এ চুবিয়ে ছেড়ে দেয়া। কী তুমুল উত্তেজনা আমাদের মধ্যে।
টগরের সঙ্গে যখন এ গল্প করলাম, সে নিচের ঠোঁট উল্টে দিয়ে বলল, এত মিথ্যে কথাও তােমার আসে? ছিঃ ছিঃ।
মিথ্যে নয় বলে তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। বড়াে নানিজানকে নিয়ে কত বিচিত্র সব গল্প আছে। তাঁর ভূতে পাওয়ার গল্পটিও আমি টগরকে শুনিয়েছিলাম।
বড়াে নানিজানের অভ্যেস ছিল সন্ধ্যাবেলা পুকুরে সাঁতার কেটে নাওয়া। তখন কার্তিক মাস। অল্প অল্প হিম পড়েছে। নিজান গিয়েছেন অভ্যেস মতাে গােসল সারতে। সূর্য ডুবে অন্ধকার হল, তাঁর ফেরবার নাম নেই। মােহরের মা হারিকেন জ্বালিয়ে পুকুরঘাটে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, কোমর জলে দাঁড়িয়ে তিনি থরথর করে কাঁপছেন। মােহরের মা ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে গাে?
নানিজান অস্পষ্টভাবে টেনে টেনে বললেন, ‘ও মােহরের মা, টেনে তােল আমাকে, আমি উঠতে পারি না, কত চেষ্টা করলাম উঠতে।
টগর বলল, ‘হিস্টিরিয়া ছিল তােমার নানির। ভূত–ফুত কিছু নয়। তােমার বড়াে নানিজানের ছেলেমেয়ে হয় নি নিশ্চয়ই। | না, হিস্টিরিয়া ছিল না তাঁর। আর ছেলেমেয়ে যে ছিল না তাও নয়। বড়াে নানিজানের একটিমাত্র মেয়ে ছিল। হাসিনা। সবাই ডাকত হাসনা। তিনি আমার আর লিলির মা।
অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
হাসনা তিন মাসের একটি শিশুকে কোলে করে আর চার বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে এ বাড়িতে এসে উঠেছিল। কোনাে একটি বিশেষ ঘটনার কাল্পনিক চিত্র যদি অসংখ্য বার অাঁকা যায়, তাহলে এমন একটি সময় আসে যখন সেই কাল্পনিক চিত্রকেই বাস্তব বলে ভ্রম হয়। আমি মা’র এ বাড়িতে আসার ঘটনাটি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। প্রতিটি ডিটেল অত্যন্ত সূক্ষ্ম।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হারিকেন আর কুপি মিলিয়ে পনের–বিশটি বাতি জ্বলছে এখানে–ওখানে। বিল থেকে ধরে আনা মাছের গাদার চারপাশে বসে বউ ঝিরা মাছ কুটছেন আর হাসি–তামাশা করছেন। হাসনা এল ঠিক এ সময়ে। অত্যন্ত জেদী ভঙ্গিতে সে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখতে পেয়ে সবাই অবাক হয়ে নেমে এল উঠোনে, খড়ম খটখট করে নানাজান নেমে এলেন দোতলা থেকে। আর হাসনা শুকনাে চোখে দেখতে লাগল সবাইকে।
হাসনার বিয়েতে সারা গাঁর দাওয়াত ছিল।
হিন্দুরা মুসলমান–বাড়িতে এখন ইচ্ছে করে মাংস খেতে আসেন, তখন আসতেন না। হিন্দুদের জন্যে ঢালাও মিষ্টির ব্যবস্থা। নামকরা কারিগর রমেশ ঠাকুর বিয়ের দু‘ দিন আগে বাড়িতে ভিয়েন বসালেন।
আত্মীয়–কুটুষের জায়গা হয় না ঘরে, নতুন ঘর উঠল এদিকে–ওদিকে। গাঁয়ের দারােগা খেতে এসে আৎকে উঠে বলল, “করেছেন কি খান সাহেব? এ যে রাজরাজড়ার ব্যাপার। নানাজান হাসিমুখে বললেন, প্রথম মেয়ের বিয়ে, সবাইকে
বললে খারাপ দেখায়, সবাই আত্মীয়–স্বজন।
গ্রামের নিতান্ত গরিব চাষীও মেয়ের বিয়েতে দু বিঘা জমি বিক্রি করে ফেলে, হালের গরু বেচে দেয়। আর নানাজান তাে তখন টাকার উপর শুয়ে।