অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

 সে যে আমার বড়াে বােন এবং নানাজানের এই প্রকাণ্ড বাড়িতে আমিই যে তার সবচেয়ে নিকটতম জন, তা জানাতে তার ভারি আগ্রহ ছিল। 

অচিনপুর

শাড়িপরা হালকাপাতলা শরীর কোনাে ফাঁকে আমার নজরে পড়ে গেলেই মন খারাপ হয়ে যেতঅবধারিতভাবে সে হাত ইশারা করে আমায় ডাকবেফিসফিস করে বলবে, কাল সবাই দুখান করে মাছ ভাজা খেয়েছে, আর তুই যে মােটে একটা নিলি

একটাই তাে দিয়েছে আমাকেবােকা কোথাকার! তুই চাইতে পারলি না? আর দুধ দেবার সময় বলতে পারিস না, আরেক হাতা দুধ দাও মােহরের মা। 

দুধ ভালাে লাগে না আমারভালাে না লাগলে হবে? স্বাস্থ্য ভালাে করতে হবে না? বেকুব কোথাকার!‘ 

এই বলে সে হয়তাে কাঁচামিঠা গাছের আম এনে দিল আমার জন্যআবার কোনাে দিন হয়তাে ডেকে নিয়ে গেল বাড়ির পেছনেআগের মতাে গলা নেমে গেছে খাদেফিসফিস করে বলছে, কী ভাবিস তুই, আমরা কি ফ্যালনা? বড়াে নানিজানের সম্পত্তির অংশ পাব না আমরা? নিশ্চয়ই পাববড়াে নানিজানের মেলা সম্পত্তিআর আমাদের মা হচ্ছে তার একমাত্র মেয়েআমরা দুজনেই শুধু ওয়ারিসানবুঝলি

অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

হ্যা, বুঝেছি। 

কাঁচকলাটা বুঝেছিসহাঁদার বেহদ্দ তুইছি ছি, এতটুকু বুদ্ধিও নেই! নে, এটা রাখ তাের কাছে। 

তাকিয়ে দেখলাম, চকচকে সিকি একটাকই পেয়েছ

আমার ছিল,বলেই লিলি আবার ফিসফিস করে বলল, দেখিস, আবার গাধার মতাে সবাইকে বলে বেড়াবি না‘ 

না, বলব না‘ 

লিলির ভাবভঙ্গি থেকে বােঝা যায়, পয়সাটা অন্যভাবে যােগাড় করেছে সেআমরা দুভাইবােন কখনাে হাতে পয়সা পেয়েছি, এমন মনে পড়ে নাঅল্প বয়সে স্নেহটাকে বন্ধন মনে না চাইতেই যা পাওয়া যায় তা তাে সব সময়ই মূল্যহীন। 

লিলিকে ভালাে লাগত কালেভদ্রেযেদিন সে খেয়ালের বসে সামান্য সা করে, লজ্জা মেশান গলায় আমাকে দোতলায় ডেকে নিয়ে যেত, সেদিন তাকে আমি সত্যি সত্যি ভালােবাসতামকিংবা কে জানে অল্প বয়সেই হয়তাে করুণা করতে শিখে গিয়েছিলামসে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নাক মুখ অল্প লাল করে বলতআমার বিয়ে হয়ে গেলে তােকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব, তুই থাকবি আমার সঙ্গে। 

কবে বিয়ে? হবে শিগগির। 

তারপরই যেন নেহায়েত একটা কথার কথা, এমনিভাবে বলে বসত, দেখ তাে রঞ্জু, শাড়িতে আমাকে কেমন মানায়। 

ভালােকিন্তু আমার নাকটা যে একটু থ্যাবড়াবাড়ির কাউকেই লিলি দেখতে পারত নাভেবে পাই না কেমন করে এত হিংসা পুষে সে বড়াে হয়েছেআমি ছাড়া আর একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে তার অল্পবিস্তর খাতির ছিলতিনি আমাদের বড়াে নানিজানবড়াে নানিজান থাকতেন দোতলায় বাঁদিকের সবচেয়ে শেষের ঘরটায়অন্ধকার ছােট একটি কুঠুরিজানালার সামান্য যে ফাঁক দিয়ে আলােবাতাস আসে, তাও গাবগাছের ঝাঁকড়া ডালপালা অন্ধকার করে রেখেছেআলােবাতাসহীন সেই অল্পপরিসর ঘরে বড়াে নানিজান রাতদিন বসে আছেনদেখে মনে হবে নানাজানের দেড় গুণ বেশি বয়সমাথায় সমস্ত চুল পেকে ধবধব করছেদাঁত পড়ে গাল বসে গেছেনিচের মাটীতে একটিমাত্র নােংরা হলুদ দাঁত

অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

মাঝেমধ্যে তিনি রেলিং ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে নিচে নেমে আসতেনকী ঘূর্তি তখন আমাদের! সবাই ভিড় করেছি তাঁর চারপাশেনানিজান মস্ত একটি মাটির গামলায় দুপয়সা দামের হলুদ রঙের হেনরী সাবান গুলে ফেনা তৈরি করেছেনফেনা তৈরি হলেই ঢালাও হুকুমমুরগি ধইরা আনমুরগি ধরে আনবার জন্য ছােটাছুটি পড়ে যেত আমাদের মধ্যেসব মুরগি নয়শুধু ধবধবে সাদা মুরগি ধরে আনবার পালানানিজান সেগুলিকে সাবান গােলা পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করতেনপাশেই বালতিতে নীল রং গােলা থাকতধােয়া হয়ে গেলেই রংচুবিয়ে ছেড়ে দেয়াকী তুমুউত্তেজনা আমাদের মধ্যে। 

টগরের সঙ্গে যখন গল্প করলাম, সে নিচের ঠোঁট উল্টে দিয়ে বলল, এত মিথ্যে কথাও তােমার আসে? ছিঃ ছিঃ। 

মিথ্যে নয় বলে তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম নাবড়াে নানিজানকে নিয়ে কত বিচিত্র সব গল্প আছেতাঁর ভূতে পাওয়ার গল্পটিও আমি টগরকে শুনিয়েছিলাম।  

বড়াে নানিজানের অভ্যেস ছিল সন্ধ্যাবেলা পুকুরে সাঁতার কেটে নাওয়াতখন কার্তিক মাসঅল্প অল্প হিম পড়েছেনিজান গিয়েছেন অভ্যেস মতাে গােসল সারতেসূর্য ডুবে অন্ধকার হল, তাঁর ফেরবার নাম নেইমােহরের মা হারিকেন জ্বালিয়ে পুকুরঘাটে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, কোমর জলে দাঁড়িয়ে তিনি থরথর করে কাঁপছেনমােহরের মা ভয় পেয়ে বলল, কী হয়েছে গাে

নানিজান অস্পষ্টভাবে টেনে টেনে বললেন, মােহরের মা, টেনে তােল আমাকে, আমি উঠতে পারি না, কত চেষ্টা করলাম উঠতে। 

টগর বলল, হিস্টিরিয়া ছিল তােমার নানিরভূতফুত কিছু নয়তােমার বড়াে নানিজানের ছেলেমেয়ে হয় নি নিশ্চয়ই| না, হিস্টিরিয়া ছিল না তাঁরআর ছেলেমেয়ে যে ছিল না তাও নয়। বড়াে নানিজানের একটিমাত্র মেয়ে ছিলহাসিনাসবাই ডাকত হাসনাতিনি আমার আর লিলির মা

অচিনপুর পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

হাসনা তিন মাসের একটি শিশুকে কোলে করে আর চার বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে বাড়িতে এসে উঠেছিলকোনাে একটি বিশেষ ঘটনার কাল্পনিক চিত্র যদি অসংখ্য বার অাঁকা যায়, তাহলে এমন একটি সময় আসে যখন সেই কাল্পনিক চিত্রকেই বাস্তব বলে ভ্রম হয়আমি মাবাড়িতে আসার ঘটনাটি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাইপ্রতিটি ডিটেল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। 

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছেহারিকেন আর কুপি মিলিয়ে পনেরবিশটি বাতি জ্বলছে এখানেওখানেবিল থেকে ধরে আনা মাছের গাদার চারপাশে বসে বউ ঝিরা মাছ কুটছেন আর হাসিতামাশা করছেনহাসনা এল ঠিক সময়েঅত্যন্ত জেদী ভঙ্গিতে সে উঠোনে এসে দাঁড়ালতাকে দেখতে পেয়ে সবাই অবাক হয়ে নেমে এল উঠোনে, খড়ম খটখট করে নানাজান নেমে এলেন দোতলা থেকেআর হাসনা শুকনাে চোখে দেখতে লাগল সবাইকে। 

হাসনার বিয়েতে সারা গাঁর দাওয়াত ছিল। 

হিন্দুরা মুসলমানবাড়িতে এখন ইচ্ছে করে মাংস খেতে আসেন, তখন আসতেন নাহিন্দুদের জন্যে ঢালাও মিষ্টির ব্যবস্থানামকরা কারিগর রমেশ ঠাকুর বিয়ের দুদিন আগে বাড়িতে ভিয়েন বসালেন। 

আত্মীয়কুটুষের জায়গা হয় না ঘরে, নতুন ঘর উঠল এদিকেওদিকেগাঁয়ের দারােগা খেতে এসে আৎকে উঠে বলল, করেছেন কি খান সাহেব? যে রাজরাজড়ার ব্যাপারনানাজান হাসিমুখে বললেন, প্রথম মেয়ের বিয়ে, সবাইকে 

বললে খারাপ দেখায়, সবাই আত্মীয়স্বজন। 

গ্রামের নিতান্ত গরিব চাষীও মেয়ের বিয়েতে দু বিঘা জমি বিক্রি করে ফেলে, হালের গরু বেচে দেয়আর নানাজান তাে তখন টাকার উপর শুয়ে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *