হাতি আনতে লােক গেল হালুয়াঘাট। সেখানে কালুশেখের দু‘টি মা এত আছে। বন থেকে কাঠের বােঝা টেনে নামায়। বিয়ের আগের রাতে মাহুতকে ঘাড়ে করে মাতু এসে দাঁড়াল।
উৎসাহী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের পাহাড় বানিয়ে ফেল উঠোনে। মাহুতের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলার জন্যে কী আগ্রহ সবার। মাহুত সাহেবের কি একটু তামাক ইচ্ছে করবেন?
হাতির পিঠে চড়ে বর এসে নামল। লােকে লােকারণ্য। ভিড়ের চাপে গেট ভেঙে পড়ে, এমন অবস্থা। জরির মালায় বরের মুখ ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কলমা পড়ার আগে জরির মালা সরান হবে না। সেও রাত একটার আগে নয়। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে বর বন্ধুদের নিয়ে সিগারেট খেতে গেল বাইরে। অমনি হৈহৈ করে উঠল সবাই––দেখেছি! কী রং! যেন সাহেবদের রং। রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে যেন।
লিলিরও বিয়ে হল এই বাড়িতে। দশ–পনের জন বন্ধু নিয়ে রােগামতাে একটি ছেলে বসে রইল বাইরের ঘরে। নিতান্ত দায়সারা গােছের বিয়ে। ভালাে ছেলে পাওয়া গেছে, এই তাে ঢের। তাছাড়া গয়নায়নাও তাে নেহায়েত কম দেওয়া হয় নি। মায়ের গলার হার, হাতের ছ’গাছা চুড়ি, নানিজান দিলেন কানের দুল, ছােট নানিজান নাম লেখা আংটি। কবুল বলতে গিয়ে লিলি তবু কেঁদেকেটে অস্থির। নানাজানের প্রবল ধমকের এক ফাঁকে কখন যে কবুল বলেছে তা শুনতেই পেল না কেউ।
ন‘ মাইল পালকি করে গিয়ে ট্রেন। ট্রেন পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে আসব আমি আর নবু মামা। বেডিংপত্তর নিয়ে দু‘ জন কামলা আগে আগে চলে গিয়েছে। পাকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না, বারবার পিছিয়ে পড়ি। নবু মামা বললেন, ‘পয়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, আমি জুতা খুলে ফেললাম।
অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ
সজনেতলা এসে পাকি থামল। বেহারারা জিরােবে। পান–তামুক খাবে। লিলি পালকির ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘দুষ্টামি করবি না তাে রঞ্জু ?
‘আমার জন্য কাঁদবি না তাে? ‘না, কাঁদব না।‘
‘কাঁদবি না কিরে গাধা? বােনের জন্য না কাঁদলে কার জন্য কাঁদবি? আমার কি আর কেউ আছে?”
ট্রেন ছেড়ে দিল।
এই বাড়ি ঐ বাড়ি করে ট্রেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। নবু মামা কাঁদছেন হু–হু করে। বেহারা এসে বলল, ‘দু জনে এসে বসেন পালকিতে, ফিরিয়ে নিয়ে যাই।
লিলিকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসে আমার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। মনে হল কিছু কিছু চিরন্তন রহস্য যেন বুঝতে পরছি।
১৭১
আশ্বিন মাস আসতেই সাজ সাজ পড়ে গেল স্কুলে।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গান আবৃত্তি তাে হবেই, সেইসঙ্গে নাটক হবে স্টেজ বেঁধে। হিরণ্য রাজা‘ নাটকের নাম। হিরণ্য রাজার পার্ট করেছেন বাদশা মামা। উৎসাহের সীমা নেই আমাদের। খালারাও ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলেন নাটক দেখবার জন্যে। মেয়েদের জন্যে পর্দাঘেরা আলাদা জায়গা করা হয়েছে। এ–বাড়ির মেয়েরা আগে কখনাে নাটকফাটক কিছুই দেখে নি। দেখবার শখ খুব। ছােট নানি আর্জি নিয়ে গেলেন নানাজানের কাছে।
‘এ সব কি দেখবে? না, না।‘ বলে প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি তুললেও শেষের দিকে তাঁকে কেমন নরম মনে হল। সুযােগ বুঝে নানিজান বলে চলছেন, ‘এক দিনের মােটে ব্যাপার। আমােদ–আহ্লাদ তাে কিছু করে না।
‘না––করে না! রাত–দিনই তাে আমােদ চলছে। আচ্ছা যাক, পাকি করে যেন যায়।
স্কুলঘরে স্টেজ সাজান হয়েছে। হ্যাজারে আলােয় ঝলমল করছে চারিদিক। হ্যারিকেন হাতে নিয়ে গ্রামের লােকজন আসছে কাতারে কাতারে। পর্দায় আড়াল করা মেয়েদের জায়গায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আমি আর নবু মামা বসেছি মেয়েদের সঙ্গে। ছােট নানি আর দু‘ খালা চাদর গায়ে চুপচাপ বসে আছেন। নাটক শুরু হতে হতে রাত হয়ে গেল। বাদশা মামা সেজেছেন হিরণ্য রাজা! এমন মহান রাজা––দীন–দুঃখীদের জন্য সমস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেন। দুশ্চরিত্র মন্ত্রী ঘোঁট পাকাচ্ছে। তলে তলে। রাজা আপনভােলা মানুষ, কিছু জানতেও পারছেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে দেখছি সবাই। একসময় হিরণ্য রাজা মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। রানীও চলেছেন তাঁর পিছু পিছু। নানিজান চমকে বললেন, ‘মেয়ে কোথেকে এল। কার মেয়ে?
অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ
‘ও হচ্ছে হারু দাদা, মেয়ে সেজেছে।
ওমা, হারু নাকি! নানিজানের চোখে আর পলক পড়ে না। বিবেকের পার্ট করল আজমল। খালারা কাঁদতে কাঁদতে চাদর ভিজিয়ে ফেলল। শেষ দৃশ্যে হিরণ্য রাজা মন্ত্রীকে বলছেন––
এই রাজ্য তুমি লও ভাই। কাজ নাই রাজ্যপাটে আমি বনবাসে যাব।
সেইখানে শান্তি আপার। ছােট খালা বললেন, ‘বেকুবটা মন্ত্রীকে মেরে ফেলে না কেন? মন্ত্রী বলছে, ‘দ্বন্ধযুদ্ধ হােক রাজা, বৃথা তর্কে কোনাে ফল নাই। ঝনঝন যুদ্ধ।
শুরু হয়ে গেল। নবু মামা উত্তেজনায় দাড়িয়ে পড়লেন। নানিজান পেছনে থেকে চেচাচ্ছেন ‘ও নবু বস, দেখতে পাচ্ছি না। বসে পড়।‘ কী তীব্র উত্তেজনা। রাজার মৃত্যুতে সবার চোখে জল। বাদশা মামার জয়জয়কার। কী পার্টটাই না করলেন!
নানাজানও যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় দেখবেন, তা কেউ ভাবি নি। পাকিতে খালারা উঠতে যাবে, এমন সময় তিনি এসে হাজির। বাদশা তাে বড়াে ভালাে করেছে।‘ এই বলে পালকিতে ওঠবার তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন হেডমাষ্টার সাহেবের বাড়ি। সেখানে তাঁর রাতের দাওয়াত।
অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ
বাড়ি গেয়ে দেখি মেহমানে বাড়ি ভর্তি, নান্দিপুর থেকে নানাজানের ফুপাতাে বােন এসেছেন ছেলেমেয়ে নিয়ে। সকাল সকালই পৌছতেন, নৌকার দাঁড় ভেঙে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছে। আমি আর নবু মামা অবাক হয়ে গেলাম মেহমানদের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে। নানাজানের ফুপাতাে বােনের বড়াে মেয়ে। ডাকনাম এলাচি। এমন সুন্দর মানুষ হয়!
দু‘ মাসের ভেতর এলাচির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বাদশা মামার। আপাত কার্যকারণ ছাড়াই যে–সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটে তাই কেমন করে পরবর্তী। সময়ে মানুষের সমস্ত জীবন বদলে দেয়, ভাবতে অবাক লাগে।