অচিনপুর পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ

সে রাতে নাটক দেখে সবাই বাদশা মামার উপর মহা প্রসন্ন ছিলেনবাড়ি এসে দেখেন, ফুলের মতাে একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদশার সঙ্গে এর বিয়ে হলে কেমন হয়? এই ভাবনা চকিতে খেলে গেল সবার মনেএলাচি স্থায়ীভাবে নানাজানের বাড়িতে ঠে এলেননাম হয়ে গেল লালবউ, আমি ডাকতাম লাল মামী, নবু মামা ডাকত লাল ভাবীঅচিনপুর

টকটকে বর্ণ, পাকা ডালিমের মতাে গাল। আর কী নামেইবা ডাকা যায়

নবু মামা এবং আমি দুজনে একই সঙ্গে লাল মামীর প্রেমে পড়ে গেলামসদা ঘুরঘুর করি, একটু যদি ফুটফরমাস করতে দেন এই আশায়লাল মামী কাকে বেশি খাতির করেন, আমাকে না নবু মামাকেএই নিয়ে ঝগড়া হয়ে যায় দুজনেরস্কুলে যাবার পথে বইখাতা নামিয়ে হয় হাতাহাতি। 

লাল মামীর বরই খাবার ইচ্ছে হয়েছে, খেলা বন্ধ করে দুজনেই ছুটেছি ইন্দু সাহার বাড়ি। ইন্দু সাহার বাড়িতে দুটি বরই গাছ, মিষ্টি যেন গুড়। লাল মামীর ইচ্ছে হয়েছে কামরাঙ্গা খাবেন, ঝাল লঙ্কা মাখিয়ে। বাড়ির পেছনে বিস্তৃত বন। 

এখানেওখানে গাছ আছে লুকিয়েদুজনেই গেছি বনে। 

মেয়েরা খুব সহজেই ভালােবাসা বুঝতে পারেলাল মামী আমাদের দুজনকেই বুঝে ফেললেনপােষ বেড়ালের মতাে আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইমােহরের মা বলে, পুলা দুইটা মাইয়া স্বভাবের, এসব ভালাে না গাে। 

আমি আর নবু মামা তখন নির্বাসিত হয়েছি পাশের ঘরেকতটুকুইবা দূরে

লাল মামী হাসছেন, আমরা শুনতে পারছিলাল মামী বলছেন, উহু চুল ছিড়ে গেলআমরা উৎকর্ণ হয়ে শুনছিলাল মামী যদি কখনাে বলেছেন, এই যা, আজ খাওয়ার পানি আনি নাই, ওমনি নবু মামা তড়াক করে লাফিয়ে পড়েছে বিছানা ছেড়ে, ভাবী, পানি নিয়ে আসছি আমি। 

একঘেয়ে কোনাে আকর্ষণই আকর্ষণ থাকে নামায়ের প্রতি মানুষের অন্ধ ভালােবাসাও ফিকে হয়ে আসে একঘেয়েমির জন্যেই! ভাইবােনের ভালােবাসার ধরনও বদলাতে থাকেলাল মামীর প্রতি আমাদের ভালােবাসা ফিকে হওয়ার কোনাে ভয় ছিল নাতাঁর মতাে বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে আমি পরবর্তী জীবনে আর একটিমাত্র দেখেছিলাম। 

যেকথা বলছিলামলাল মামী আমাদের বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করলেনহয়তাে আমি আর নবু মামা দু জনে বসে আছি তাঁর ঘরেমামী হুকুম করলেন, নবু, দরজা বন্ধ করে দেখােল, এবার আলমারি খােলরাজার পােশাকটা বের কর 

আমি আৎকে উঠে বলেছি, বাদশা মামা মেরে ফেলবে| ঠোঁট উল্টে মামী তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করছেন, নে তুই, এই মুকুটটা পরে ফেলনবু, তুই কি সাজবি, সন্ন্যাসী

নবু মামা বললেন, তুমি কি সাজবে আগে বল ?আমি রানী সাজবতাহলে আমি রাজা সাজব‘ 

ততক্ষণে আমি ঢলঢলে মুকুটটা মাথায় পরে ফেলেছি। তারস্বরে চেঁচাচ্ছি, না, আমি রাজা সাজব। 

মামী বললেন, যুদ্ধ হােক দু জনার মধ্যেযে জিতবে, সেরাজাকথা শেষ না হতেই নৰু মামা ঝাঁপিয়ে পড়েন আমার উপরদু জনে ধুলােমাখা মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকিযেন এই যুদ্ধে জীবনমরণ নির্ভর করছেআল্লাহ জানেন, নবু মামা এই লিকলিকে শরীরে এত জোর পান কী করে! | জয়পরাজয় নির্ধারিত হতে দীর্ঘ সময় লাগেমুখে নখের রক্তাভ আঁচড়ে, ধূলিধূসরিত শার্ট নিয়ে যখন যুদ্ধজয়ী রাজা দাঁড়ান, তখন মামী নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আজ আর না, আজ থাক, যা তােরা আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে আয়। 

বল তো তুই, টানলে ছােট হয় কোন জিনিস

লাল মামী বিছানায় শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলেনহাজার চিন্তাতেও মাথায় সেখিনিসটার নাম আসে না, টানলে যা ছােট হতে থাকে। 

পারলি না? দেশলাই আন, আমি দেখাচ্ছিনবু মামা দৌড়ে দেশাই নিয়ে আসেনমামী আমাদের দুজনের স্তম্ভিত চোখের সামনে ফস করে একটা বার্ডসাই সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেকো ফাকে জানি বাদশা মামার কাছ থেকে যােগাড় করে রেখেছিলেনআমাদের দুজনের নিঃশ্বাস পড়ে নামামী বলেন, এই দেখ, যতই টানছি ততই ছােট হচ্ছেআমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি মামীর দিকেমামী আধখাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে ধরেন আমাদের দিকে, শান্ত গলায় বলেন, নে, এবার তােরা টানহাঁ করে দেখছিকি? কযে টান দেনইলে তাে বাড়িতে বলে দিবিমামীর মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে পানি আনতে হয়, এলাচ দানা আনতে হয়সেই সঙ্গে মামীর প্রতি আমাদেরএক নিষিদ্ধ আকর্ষণ জড়াে হতে থাকে। 

বাড়ির বউঝিরা লাল মামীকে বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগলকেমন ধারা বউ? লাজ নেই, সহবত নেই। 

কোথায় শাশুড়িকে দেখে এক হাত ঘােমটা দিয়ে জড়ােসড়াে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নয়টগবগিয়ে ঘােড়ার মতাে চলে যায়নতুন বউ রান্নাঘরে গিয়ে বসুক না দুদণ্ডননদের হাত থেকে আনাজ নিয়ে জোর করে কুটে দিক, তা নয়গলায় বাঁশ দিয়ে হাসছে হিহি হিহিমােহরের মা সময় বুঝে ছড়া কাটে– 

রূপ আর কয় দিনের

নিমতা ফুল যয়দিনেরনিমতা ফুল সকালবেলাতেই ফোটে, রােদ একটু তেতে উঠতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়েকিন্তু যার জন্যে বলা, সে শুনছে কই? শাশুড়ি মুখের উপর কিছু বলেন 

লােকে বলবে, বউকাটকী শাশুড়িকী লজ্জার কথা! | একমাত্র চাবিকাঠি বাদশা মামাসেতাে পারে বউয়ের রীতিনীতি শুধরে দিতেকিন্তু দেখেশুনে মনে হয়, বউ যাদু করেছে বাদশা মামাকে। 

বিয়ের পরপরই বাদশা মামা ভয়ানক বদলে গেছেনচালচলনে কথাবার্তায় ভয়ানক অস্থিরতা এসেছেআগে সমস্ত দিন বাইরে পড়ে থাকতেনরাতের বেলাখেতে আসতেন, বাড়ির সঙ্গে এইটুকুই যা সংযােগএখন সমস্ত দিন বাড়িতে থাকেনকিন্তু সেও অন্যরকম থাকাহয়তাে মিনিটখানিকের জন্যে লাল মামীর ঘরে এসেছেন, চোখেমুখে ব্যস্ততার ভাবযেন কোনাে দরকারী জিনিস খুঁজে পাচ্ছেন নালাল মামী ভ্ৰকুঁচকে বললেন

কী চাও?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *