সে রাতে নাটক দেখে সবাই বাদশা মামার উপর মহা প্রসন্ন ছিলেন। বাড়ি এসে দেখেন, ফুলের মতাে একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদশার সঙ্গে এর বিয়ে হলে কেমন হয়? এই ভাবনা চকিতে খেলে গেল সবার মনে। এলাচি স্থায়ীভাবে নানাজানের বাড়িতে উঠে এলেন। নাম হয়ে গেল লালবউ, আমি ডাকতাম লাল মামী, নবু মামা ডাকত লাল ভাবী।
টকটকে বর্ণ, পাকা ডালিমের মতাে গাল। আর কী নামেই–বা ডাকা যায়?
নবু মামা এবং আমি দু‘ জনে একই সঙ্গে লাল মামীর প্রেমে পড়ে গেলাম। সদা ঘুরঘুর করি, একটু যদি ফুট–ফরমাস করতে দেন এই আশায়। লাল মামী কাকে বেশি খাতির করেন, আমাকে না নবু মামাকে–– এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে যায় দু‘ জনের। স্কুলে যাবার পথে বই–খাতা নামিয়ে হয় হাতাহাতি।।
লাল মামীর বরই খাবার ইচ্ছে হয়েছে, খেলা বন্ধ করে দু‘ জনেই ছুটেছি ইন্দু সাহার বাড়ি। ইন্দু সাহার বাড়িতে দু‘টি বরই গাছ, মিষ্টি যেন গুড়। লাল মামীর ইচ্ছে হয়েছে কামরাঙ্গা খাবেন, ঝাল লঙ্কা মাখিয়ে। বাড়ির পেছনে বিস্তৃত বন।
এখানে–ওখানে গাছ আছে লুকিয়ে। দু‘ জনেই গেছি বনে।
মেয়েরা খুব সহজেই ভালােবাসা বুঝতে পারে। লাল মামী আমাদের দু’ জনকেই বুঝে ফেললেন। পােষ বেড়ালের মতাে আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বেড়াই। মােহরের মা বলে, পুলা দুইটা মাইয়া স্বভাবের, এসব ভালাে না গাে।।
আমি আর নবু মামা তখন নির্বাসিত হয়েছি পাশের ঘরে। কতটুকুই–বা দূরে?
লাল মামী হাসছেন, আমরা শুনতে পারছি। লাল মামী বলছেন, উহু চুল ছিড়ে গেল। আমরা উৎকর্ণ হয়ে শুনছি। লাল মামী যদি কখনাে বলেছেন, ‘এই যা, আজ খাওয়ার পানি আনি নাই‘, ওমনি নবু মামা তড়াক করে লাফিয়ে পড়েছে বিছানা ছেড়ে, ভাবী, পানি নিয়ে আসছি আমি।
একঘেয়ে কোনাে আকর্ষণই আকর্ষণ থাকে না। মায়ের প্রতি মানুষের অন্ধ ভালােবাসাও ফিকে হয়ে আসে একঘেয়েমির জন্যেই! ভাই–বােনের ভালােবাসার ধরনও বদলাতে থাকে। লাল মামীর প্রতি আমাদের ভালােবাসা ফিকে হওয়ার কোনাে ভয় ছিল না। তাঁর মতাে বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে আমি পরবর্তী জীবনে আর একটিমাত্র দেখেছিলাম।
যে–কথা বলছিলাম––লাল মামী আমাদের বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করলেন। হয়তাে আমি আর নবু মামা দু জনে বসে আছি তাঁর ঘরে। মামী হুকুম করলেন, ‘নবু, দরজা বন্ধ করে দে। খােল, এবার আলমারি খােল। রাজার পােশাকটা বের কর
আমি আৎকে উঠে বলেছি, ‘বাদশা মামা মেরে ফেলবে। | ঠোঁট উল্টে মামী তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করছেন, ‘নে তুই, এই মুকুটটা পরে ফেল। নবু, তুই কি সাজবি, সন্ন্যাসী?
নবু মামা বললেন, তুমি কি সাজবে আগে বল ?” ‘আমি রানী সাজব। ‘তাহলে আমি রাজা সাজব।‘
ততক্ষণে আমি ঢলঢলে মুকুটটা মাথায় পরে ফেলেছি। তারস্বরে চেঁচাচ্ছি, ‘না, আমি রাজা সাজব।
মামী বললেন, ‘যুদ্ধ হােক দু জনার মধ্যে। যে জিতবে, সে–ই রাজা।‘ কথা শেষ না হতেই নৰু মামা ঝাঁপিয়ে পড়েন আমার উপর। দু জনে ধুলােমাখা মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। যেন এই যুদ্ধে জীবনমরণ নির্ভর করছে। আল্লাহ জানেন, নবু মামা এই লিকলিকে শরীরে এত জোর পান কী করে! | জয়–পরাজয় নির্ধারিত হতে দীর্ঘ সময় লাগে। মুখে নখের রক্তাভ আঁচড়ে, ধূলিধূসরিত শার্ট নিয়ে যখন যুদ্ধজয়ী রাজা দাঁড়ান, তখন মামী নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আজ আর না, আজ থাক, যা তােরা আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে আয়।
বল তো তুই, টানলে ছােট হয় কোন জিনিস ?
লাল মামী বিছানায় শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলেন। হাজার চিন্তাতেও মাথায় সে–খিনিসটার নাম আসে না, টানলে যা ছােট হতে থাকে।
পারলি না? দেশলাই আন, আমি দেখাচ্ছি। নবু মামা দৌড়ে দেশাই নিয়ে আসেন। মামী আমাদের দু‘ জনের স্তম্ভিত চোখের সামনে ফস করে একটা বার্ডসাই সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে। কো ফাকে জানি বাদশা মামার কাছ থেকে যােগাড় করে রেখেছিলেন। আমাদের দু‘ জনের নিঃশ্বাস পড়ে না। মামী বলেন, ‘এই দেখ, যতই টানছি ততই ছােট হচ্ছে। ‘ আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি মামীর দিকে। মামী আধখাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে ধরেন আমাদের দিকে, শান্ত গলায় বলেন, নে, এবার তােরা টান। হাঁ করে দেখছিস কি? কযে টান দে। নইলে তাে বাড়িতে বলে দিবি।‘ মামীর মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে পানি আনতে হয়, এলাচ দানা আনতে হয়। সেই সঙ্গে মামীর প্রতি আমাদের। এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ জড়াে হতে থাকে।
বাড়ির বউ–ঝিরা লাল মামীকে বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগল। এ কেমন ধারা বউ? লাজ নেই, সহবত নেই।
কোথায় শাশুড়িকে দেখে এক হাত ঘােমটা দিয়ে জড়ােসড়াে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নয়—টগবগিয়ে ঘােড়ার মতাে চলে যায়। নতুন বউ রান্নাঘরে গিয়ে বসুক না দু‘ দণ্ড। ননদের হাত থেকে আনাজ নিয়ে জোর করে কুটে দিক, তা নয়––গলায় বাঁশ দিয়ে হাসছে হিহি হিহি। মােহরের মা সময় বুঝে ছড়া কাটে––
‘রূপ আর কয় দিনের?
নিমতা ফুল যয়দিনের। নিমতা ফুল সকালবেলাতেই ফোটে, রােদ একটু তেতে উঠতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। কিন্তু যার জন্যে বলা, সে শুনছে কই? শাশুড়ি মুখের উপর কিছু বলেন
লােকে বলবে, ‘বউ–কাটকী শাশুড়ি’। কী লজ্জার কথা! | একমাত্র চাবিকাঠি বাদশা মামা। সে–ই তাে পারে বউয়ের রীতিনীতি শুধরে দিতে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হয়, বউ যাদু করেছে বাদশা মামাকে।
বিয়ের পরপরই বাদশা মামা ভয়ানক বদলে গেছেন। চালচলনে কথাবার্তায় ভয়ানক অস্থিরতা এসেছে। আগে সমস্ত দিন বাইরে পড়ে থাকতেন। রাতের বেলা। খেতে আসতেন, বাড়ির সঙ্গে এইটুকুই যা সংযােগ। এখন সমস্ত দিন বাড়িতে থাকেন। কিন্তু সেও অন্যরকম থাকা। হয়তাে মিনিটখানিকের জন্যে লাল মামীর ঘরে এসেছেন, চোখেমুখে ব্যস্ততার ভাব। যেন কোনাে দরকারী জিনিস খুঁজে পাচ্ছেন না। লাল মামী ভ্ৰকুঁচকে বললেন,
‘কী চাও?