অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

কিছু নাকিছু না‘ 

বলে মামা বিব্রত ভঙ্গিতে চলে গেলেনবসে রইলেন বাইরের ঘরে একা একাআবার হয়তাে এলেন কিছুক্ষণের জন্যে, আবার বাইরে গিয়ে বসে থাকানানিজান এক দিন বললেন, বাদশা, কী হয়েছে রে

অচিনপুর

বাদশা মামা কিছু বললেন নাফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলেনসবাই অবাক হল, যেদিন বাদশা মামা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে 

উধাও হয়ে গেলেননানাজান সে দিনই প্রথম লাল মামীর ঘরে এসে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এলাচি, বাদশার কী হয়েছে

লাল মামী চুপ করে রইলেননানাজান বললেন, তােমাদের মিল হয় না কেন? কী ব্যাপার? মামী চুপ করে রইলেন। 

নানাজান শান্তগলায় বললেন, এলাচি, সরফরাজ খানের বাড়িতে কোনাে বেচাল হয় নাখেয়াল থাকে যেন। 

নানাজান বেরিয়ে এসে ছােট নানিজানকে কিছুক্ষণ অকারণে বকে নিচে নেমে গেলেনসারা দিন বাড়ি থমথম করতে লাগলসেসন্ধ্যায় কানাবিবি যখন সাপ খেলান সুরে কোরান পড়তে শুরু করল, তখনকেন জানি নাভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল। 

তৃতীয় দিনের দিন সকালবেলা বাদশা মামা ফিরে এলেনভেতরের বাড়িতে এসে বাইরের ঘরে বসে রইলেন! নানিজান এসে তাঁকে নিয়ে গেলেন ভেতরবাড়িতেমামা সারাক্ষণই সংকুচিত হয়ে রইলেনযখন লাল মামীর সঙ্গে তাঁর দেখা হল তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। 

অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপারটি হল রাতেবাদশা মামা লাল মামীর ঘরের দরজায় টোকা দিলেনমামী বললেন, কে?‘ 

বাদশা মামা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, আমি‘ 

এদিকে পাশের ঘরে আমি আর নবু মামা কান খাড়া করে বসে আছিকিন্তু আর কোনাে সাড়াশব্দ পাচ্ছি নাবাদশা মামা নিচু গলায় বললেন, দরজাটা খােল। 

লাল মামী কোনাে সাড়াশব্দ করলেন নাশেষ পর্যন্ত বাদশা মামা আমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেনআমরা তিন জন একখাটে শুয়ে রইলামামা বারবার বলছেন, কাউকে বলবি না, খবরদার। 

বললে কান ছিড়ে ফেলব দুজনের, মনে থাকে যেন। 

ভাদ্রমাসের প্রথম দিকে নবু মামা অসুখে পড়লেন, কালান্তক ম্যালেরিয়াহাতপা শুকিয়ে কাঠি, পেট পুরে ঢােলউঠোনে ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করে বেড়ায়, নবু মামা চাদর গায়ে দিয়ে জলচৌকিতে বসে বসে দেখো ম্যালেরিয়ার তখন খুব ভালাে ওষুধ বেরিয়েছেগাঢ় হলুদ রংএর কুইনাইন ট্যাবলেটসেকালের এক পয়সার মতাে বড়ােঅস্ত গেলা যায় না, গলায় আটকে থাকেসপ্তাহে এক দিন খাবার 

নিয়ম, ম্যালেরিয়া হােক আর নাহােকওষুধ খেলেই কানে ভোঁ ভোঁ করত, মাহালকা হয়ে যেত। 

কুইনাইন খেয়ে খেয়ে একসময় নবু মামার জ্বর সারলশরীর খুব দুর্বলনিতে নিজে দাঁড়াতে পারে নামাথা ঘুরে পড়ে যায়সারা দিন ঘ্যানঘ্যান করে, এটা খাবে ওটা খাবেখিটখিটে মেজাজযদি কোনাে কারণে লাল মামী আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন, অম্নি তার রাগ হয়ে গেছেওর দিকে তাকিয়ে হাসছ কেন?

অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

আমার দিকে তাকিয়ে হাসশুনে লাল মামী নিষ্ঠুরের মতাে বলে বসেন, তাের দিকে তাকিয়ে হাসব কি রে, তুই তাে চামচিকা হয়ে গেছিস? নুব মামার আকাশফাটান কান্না থামাবার জন্যে লাল মামীকে অনেকক্ষণ নবুমামার দিকে তাকিয়ে হাসতে হয়স্বাস্থ্যের জন্যে নবু মামার স্কুল যাওয়াও বন্ধরােগা শরীর পেয়ে বিভিন্ন রােগ ইচ্ছেমতাে হেঁকে ধরছেআজ সর্দি তাে কাল জ্বর, পরশু পেট নেমেছে। 

কানাবিবির দেওয়া তাবিজের বােঝা গলায় নিয়ে নবু মামা বেচারার মতাে ঘুরে বেড়ায়রাতের বেলা বড়াে জ্বালাতন করেকিছুক্ষণ পরপর পানি খেতে চায়পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার তার পেচ্ছাবের বেগ হয়পেচ্ছাব কানও কি কম হাঙ্গামা? হ্যারিকেন জ্বালাতে হয়, নবু মামা হাতে নেন একটা টর্চআমাকে গিয়ে ডেকে তুলতে হয় নানিজানকেনানিজান আর আমি বসে থাকি বারান্দায়নবু মামা টর্চ ফেলে ভয়ে ভয়ে যানতাতেও রক্ষা নেই, ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছেন, ওটা কি, যে গেল

কিছু না, শেয়াল। 

শেয়াল? তবে ছায়া পড়ল না কেন? অন্ধকারে ছায়া পড়বে কি রে হাঁদা? নানিজান বিরক্ত হয়ে বলেন। 

এই হল নিত্যকার রুটিন। 

খাওয়া নিয়েও কি কম হাঙ্গামা? আজ ইচ্ছে হয়েছে কই মাছ ভাঙা খাবেনকই মাছ যােগাড় না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া বন্ধসবাই অতিষ্ট হয়ে উঠল। 

শেষ পর্যন্ত পীরফকির ধরা হলধর্মনগরের সুফী সাহেবের পানিপড়া আনবার জন্যে আমি আর বাদশা মামা নৌকা করে ধর্মনগর রওনা হলামদুদিনের পথউজান ঠেলে যেতে হয়সঙ্গে চালডাল নিয়ে নিয়েছিনৌকাতেই খাওয়াদাওয়াবাদশা মামা এই দীর্ঘ সময় চুপচাপ কাটালেনসন্ধ্যার পর নৌকার ছাদে উঠে বসেননেমে আসেন অনেক রাতেসারা দিন শুয়ে শুয়ে ঘুমানদেখলেই বােঝা যায় ভরসাহারান মানুষ। কিন্তু কি শুন্যে ভরসা হারিয়েছেন, তা বুঝতে না পেরে আমার খারাপ লাগে। 

অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

সপ্তম দিনে ফিরলামসুফী সাহেব খুব খাতিরযত্ন করলেন আমাদেরতার অনুরােধে বাড়িতে চার দিন থেকে যেতে হলকথা নেই, বার্তা নেই, বাদশা মামা সুফী সাহেবের মুরিদ হয়ে গেলেনমাথায় সব সময় টুপি, নিয়ম করে নামাজ পড়ছেনযতই দেখি, ততই অবাক হই। 

আমার অবাক হওয়ার আরাে কিছু বাকি ছিলবাড়িতে ফিরে জানলাম, নবুমামা খুলনা জেলার মনােহরদীপুরে চলে যাচ্ছেনকিছু দিন সেখানে থাকবেনখুব স্বাস্থ্যকর জায়গা, শরীর ফিরলে চলে যাবেন রাজশাহীনানাজানের খালাতাে ভাই থাকেন সেখানেসরকারী জরিপ বিভাগের কানুনগােনবু মামা সেখানে থেকেই পড়াশােনা করবেননানাজান নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেনবাড়িতে তারই আয়ােজন চলছেনবু মামা আগের চেয়েও মিইয়ে গিয়েছেনআমাকে ধরাগলায় বললেন, লাল ভাবীকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না‘ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *