কিছু না–কিছু না।‘
বলে মামা বিব্রত ভঙ্গিতে চলে গেলেন। বসে রইলেন বাইরের ঘরে একা একা। আবার হয়তাে এলেন কিছুক্ষণের জন্যে, আবার বাইরে গিয়ে বসে থাকা। নানিজান এক দিন বললেন, ‘বাদশা, কী হয়েছে রে?
বাদশা মামা কিছু বললেন না। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলেন। সবাই অবাক হল, যেদিন বাদশা মামা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে
উধাও হয়ে গেলেন। নানাজান সে দিনই প্রথম লাল মামীর ঘরে এসে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘এলাচি, বাদশার কী হয়েছে?
লাল মামী চুপ করে রইলেন। নানাজান বললেন, ‘তােমাদের মিল হয় না কেন? কী ব্যাপার? মামী চুপ করে রইলেন।
নানাজান শান্তগলায় বললেন, ‘এলাচি, সরফরাজ খানের বাড়িতে কোনাে বেচাল হয় না। খেয়াল থাকে যেন।
নানাজান বেরিয়ে এসে ছােট নানিজানকে কিছুক্ষণ অকারণে বকে নিচে নেমে গেলেন। সারা দিন বাড়ি থমথম করতে লাগল। সে–সন্ধ্যায় কানাবিবি যখন সাপ খেলান সুরে কোরান পড়তে শুরু করল, তখন––কেন জানি না––ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল।
তৃতীয় দিনের দিন সকালবেলা বাদশা মামা ফিরে এলেন। ভেতরের বাড়িতে এসে বাইরের ঘরে বসে রইলেন! নানিজান এসে তাঁকে নিয়ে গেলেন ভেতরবাড়িতে। মামা সারাক্ষণই সংকুচিত হয়ে রইলেন। যখন লাল মামীর সঙ্গে তাঁর দেখা হল তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।
অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ
সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপারটি হল রাতে। বাদশা মামা লাল মামীর ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। মামী বললেন, ‘কে?‘
বাদশা মামা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, ‘আমি।‘
এদিকে পাশের ঘরে আমি আর নবু মামা কান খাড়া করে বসে আছি। কিন্তু আর কোনাে সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাদশা মামা নিচু গলায় বললেন, “দরজাটা খােল।
লাল মামী কোনাে সাড়াশব্দ করলেন না। শেষ পর্যন্ত বাদশা মামা আমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। আমরা তিন জন একখাটে শুয়ে রইলাম। মামা বারবার বলছেন, ‘কাউকে বলবি না, খবরদার।
বললে কান ছিড়ে ফেলব দু‘ জনের, মনে থাকে যেন।
ভাদ্রমাসের প্রথম দিকে নবু মামা অসুখে পড়লেন, কালান্তক ম্যালেরিয়া। হাত–পা শুকিয়ে কাঠি, পেট পুরে ঢােল। উঠোনে ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করে বেড়ায়, নবু মামা চাদর গায়ে দিয়ে জলচৌকিতে বসে বসে দেখো ম্যালেরিয়ার তখন খুব ভালাে ওষুধ বেরিয়েছে। গাঢ় হলুদ রং–এর কুইনাইন ট্যাবলেট। সেকালের এক পয়সার মতাে বড়াে। অস্ত গেলা যায় না, গলায় আটকে থাকে। সপ্তাহে এক দিন খাবার
নিয়ম, ম্যালেরিয়া হােক আর না–হােক। ওষুধ খেলেই কানে ভোঁ ভোঁ করত, মা। হালকা হয়ে যেত।
কুইনাইন খেয়ে খেয়ে একসময় নবু মামার জ্বর সারল। শরীর খুব দুর্বল। নিতে নিজে দাঁড়াতে পারে না। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সারা দিন ঘ্যানঘ্যান করে, এটা খাবে ওটা খাবে। খিটখিটে মেজাজ। যদি কোনাে কারণে লাল মামী আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন, অম্নি তার রাগ হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসছ কেন?
অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ
আমার দিকে তাকিয়ে হাস।‘ শুনে লাল মামী নিষ্ঠুরের মতাে বলে বসেন, তাের দিকে তাকিয়ে হাসব কি রে, তুই তাে চামচিকা হয়ে গেছিস? নুব মামার আকাশ–ফাটান কান্না থামাবার জন্যে লাল মামীকে অনেকক্ষণ নবু। মামার দিকে তাকিয়ে হাসতে হয়। স্বাস্থ্যের জন্যে নবু মামার স্কুল যাওয়াও বন্ধ। রােগা শরীর পেয়ে বিভিন্ন রােগ ইচ্ছেমতাে হেঁকে ধরছে। আজ সর্দি তাে কাল জ্বর, পরশু পেট নেমেছে।
কানাবিবির দেওয়া তাবিজের বােঝা গলায় নিয়ে নবু মামা বেচারার মতাে ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলা বড়াে জ্বালাতন করে। কিছুক্ষণ পরপর পানি খেতে চায়। পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার তার পেচ্ছাবের বেগ হয়। পেচ্ছাব কানও কি কম হাঙ্গামা? হ্যারিকেন জ্বালাতে হয়, নবু মামা হাতে নেন একটা টর্চ। আমাকে গিয়ে ডেকে তুলতে হয় নানিজানকে। নানিজান আর আমি বসে থাকি বারান্দায়। নবু মামা টর্চ ফেলে ভয়ে ভয়ে যান। তাতেও রক্ষা নেই, ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছেন, ‘ওটা কি, ঐ যে গেল?
‘কিছু না, শেয়াল।
শেয়াল? তবে ছায়া পড়ল না কেন? ‘অন্ধকারে ছায়া পড়বে কি রে হাঁদা? নানিজান বিরক্ত হয়ে বলেন।
এই হল নিত্যকার রুটিন।
খাওয়া নিয়েও কি কম হাঙ্গামা? আজ ইচ্ছে হয়েছে কই মাছ ভাঙা খাবেন। কই মাছ যােগাড় না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ। সবাই অতিষ্ট হয়ে উঠল।
শেষ পর্যন্ত পীর–ফকির ধরা হল। ধর্মনগরের সুফী সাহেবের পানিপড়া আনবার জন্যে আমি আর বাদশা মামা নৌকা করে ধর্মনগর রওনা হলাম। দু‘ দিনের পথ। উজান ঠেলে যেতে হয়। সঙ্গে চাল–ডাল নিয়ে নিয়েছি। নৌকাতেই খাওয়াদাওয়া। বাদশা মামা এই দীর্ঘ সময় চুপচাপ কাটালেন। সন্ধ্যার পর নৌকার ছাদে উঠে বসেন। নেমে আসেন অনেক রাতে। সারা দিন শুয়ে শুয়ে ঘুমান। দেখলেই বােঝা যায় ভরসা–হারান মানুষ। কিন্তু কি শুন্যে ভরসা হারিয়েছেন, তা বুঝতে না পেরে আমার খারাপ লাগে।
অচিনপুর পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ
সপ্তম দিনে ফিরলাম। সুফী সাহেব খুব খাতির–যত্ন করলেন আমাদের। তার অনুরােধে বাড়িতে চার দিন থেকে যেতে হল। কথা নেই, বার্তা নেই, বাদশা মামা সুফী সাহেবের মুরিদ হয়ে গেলেন। মাথায় সব সময় টুপি, নিয়ম করে নামাজ পড়ছেন। যতই দেখি, ততই অবাক হই।
আমার অবাক হওয়ার আরাে কিছু বাকি ছিল। বাড়িতে ফিরে জানলাম, নবু। মামা খুলনা জেলার মনােহরদীপুরে চলে যাচ্ছেন। কিছু দিন সেখানে থাকবেন। খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা, শরীর ফিরলে চলে যাবেন রাজশাহী। নানাজানের খালাতাে ভাই থাকেন সেখানে। সরকারী জরিপ বিভাগের কানুনগাে। নবু মামা সেখানে থেকেই পড়াশােনা করবেন। নানাজান নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে তারই আয়ােজন চলছে। নবু মামা আগের চেয়েও মিইয়ে গিয়েছেন। আমাকে ধরা–গলায় বললেন, ‘লাল ভাবীকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।‘