অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি ভেবেই পেলাম না একা একা আমি কী করে থাকবনবু মামা আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গীতাকে ছাড়া একা একা স্কুলে যাচ্ছি, এই দৃশ্য কল্পনা করলেও চোখে পানি এসে যায়নবু মামার আমার জন্যে কোনাে মাথা ব্যথা নেই, তার মুখে শুধুই লাল ভাবীর কথাআমি বললাম, নবু মামা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। 

অচিনপুর

আমি কী করে নিয়ে যাব? তুই বাবাকে বল। 

নানাজানকে বলবার সাহস আমার নেইআমি লাল মামীকে ধরলামমামী তখন বারান্দায় বসে সুঁচসুতাে নিয়ে কী যেন করছিলেনআমি কাঁদো কাঁদো হয়ে সমস্ত খুলে বললামচুপ করে তিনি সমস্ত শুনলেনআমার কথা শেষ হতেই বললেন, যা তাে, দৌড়ে তাের ছােট খালার কাছ থেকে একটা সােনামুখী উঁচ নিয়েআয়বলবি আমি চাইছি‘ 

সুচ এনে দিয়ে আমার কাতর অনুরােধ জানালামবলবেন তাে মামী? আজই বলতে হবেআজ সন্ধ্যাবেলাতেই। 

মামী বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ঘ্যানঘ্যান করিস, পরের বাড়িতে আছিস যে হুস নেই? ইচ্ছে হয় নিজে গিয়ে বল। 

এর কিছুদিন পরই পানসি নৌকা করে নানাজান আর নবু মামা চলে গেলেনযাবার সময় নবুমামার সে কী কান্না! কিছুতেই যাবেন নালাল মামীর শাড়ি চেপে ধরেছেতারস্বরে চেচাচ্ছে 

আমি যাব না, যাব নালাল মামী শুকননা গলায় বললেন, শাড়ি ছাড়, শাড়ি ধরে চেঁচাচ্ছিস কেন

নবু মামা চলে যাবার পর আমার কিছু করবার রইল নাআমকাঁঠালের ছুটি হয়ে গেছে স্কুলে

অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ

সারাদিন বাড়িতে ঘুরে বেড়াইবিকেলবেলাটা আর কিছুতেই কাটে নারােদের তাপ একটু কমতেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সােনাখালিহেটে যেতে যেতে কত আজগুবি চিন্তা মনে আসেযেন কোনাে অপরাধ ছাড়াই দেশের রাজা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছেহুকুম হয়েছে আমার ফাঁসি হবেরাজ্যের সমস্ত লােক ফাঁসির মঞ্চের চারদিকে জড় হয়েছেআমি তাকিয়ে দেখি, এদের মধ্যে লাল রঙের পােশাক পরা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, না, ছেলে কোনাে দোষ করে নি, এর ফাঁসি হবে নাবলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছেআমি বলছি, না, হােক, আমার ফাঁসি হােকমেয়েটি অপলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকেতার মুখের গড়ন অনেকটা লাল মামীর মতাে। 

সােনাখালি পাকাপুলে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতামসেই সময়ে আমার মন থেকে ভূতের ভয় কেটে গিয়েছিলএকেক দিন নিশীথ রাত্রে একা একা ফিরেছিঅন্ধকারে একা ফিরতে ফিরতে কত বার চমকে উঠেছি নামনাজানা পাখির ডাকেকিন্তু ভয় পাই নি কখনােরান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেই মােহরের মাভাত বেড়ে দেয়, নাও, খেয়ে গুষ্টি উদ্ধার করা এই সব কথা কখনাে গায়ে মাখি। 

আমি সেসময় অনেক বড়াে দুঃখে ডুবে ছিলামছােটখাট কষ্টের ব্যাপার, যা প্রতিদিন ঘটত, এই নিয়ে সেই কারণেই কোনাে মাথাব্যথা ছিল না। 

অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ

দিন আর কাটতে চায় না কিছুতেইস্নেহ, ভালােবাসা ছাড়া কোনাে মানুষই বাঁচতে পারে নাআমি সেকারণেই হয়তাে অসুস্থ হয়ে পড়লামশুয়ে শুয়ে সময় কাটাইকেন জানি না, অসুখটাই ভালাে লাগেসকাল থেকে সন্ধ্যা শুয়ে শুয়ে ঘুমান ছাড়া অন্য কাজ নেইমাঝেমধ্যে বাদশা মামা এসে বসেননিতান্তঅপ্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা হয়মামা হয়তাে বললেন, বেশি করে দুধ খা, শরীরে জোর হবে। 

আচ্ছা মামা খাবপীরপুরে জন্মাষ্টমীর মেলা, যাবি নাকি দেখতে? অসুখ সারলে যাব‘ 

মামা থাকেন অল্পক্ষণকথা বলেন ছাড়াছাড়া ভঙ্গিতেদেখে শুনে বড়াে অবাক লাগেতার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছেগাল বসে গিয়ে কেমন প্রৌঢ় মানুষের মতাে দেখায়। 

লাল মামী বড়াে একটা আসেন নাহয়তাে দরজার বাইরে থেকে বললেন, রঞ্জুর জ্বর আবার এসেছে নাকি? না মামী, জ্বর নেই‘ 

না থাকলেই ভালােএই বলে তিনি ব্যস্তভাবে চলে যানতাঁর যাওয়ার পথে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকিসেসময়ে লাল মামীকে আমি একই সঙ্গে 

ভালােবাসি আর ঘৃণাও করিকোনাে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ধরনের দ্বৈত অনুভুতিসেই আমার প্রথমপরবর্তী সময়ে অবশ্যি আরাে অনেকের জন্যেই এমন হয়েছে। 

ঠিক সময়ে আমার সফুরা খালার সঙ্গে অল্পমাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হলতাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হবে, আমার খুব ছােটবেলাকার বাসনাতিনি আমার চেয়ে বৎসরখানেকের বড়াে হবেনখুব চুপচাপ ধরনের মেয়েছােটবেলা থেকেই দেখেছি, তিনি একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছেন বারান্দায়হাতে একটা লাঠিমাঝে মাঝে মেঝেতে ঠক করে শব্দ করছেন আর মুখে বলছেন, উড়ে গেল পাখিপ্রথম দিন রকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি তাে আকাশ থেকে পড়েছিতিনি আমাকে দেখতে পান নি, কাজেই তিনি লাঠি হাতে ঠকঠক করতে লাগলেন আর পাখি ওড়াতে লাগলেনআমি যখন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, খালা কী করেন

অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ

লজ্জায় খালার চোখে পানি এসে গেলকোনাে রকমে বললেন, কিছু না, আমি খেলি‘ 

তার পরও খালাকে এমন অদ্ভুত খেলা খেলতে দেখেছিলজ্জা পাবেন, এই জন্যে আমি তাঁর সামনে পড়ি নিতাঁর সঙ্গে ভাব করবার আমার খুব ইচ্ছে হতকিন্তু তিনি আমাকে দেখলে ভারি লজ্জা পেতেন| অসুখের সময় প্রায়ই সফুরা খালা এসে দাঁড়াতেন আমার দরজায়আমি ডাকতাম, খালা, ভেতরে আসেন। 

না, আমি এখানেই থাকি‘ 

এই বলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন দরজায়অনেক রকম কথা হত তাঁর সাথেকী ধরনের কথা, তা আজ আর মনে নেইমনে আছে, খালা সারাক্ষণই মুখ টিপে টিপে হাসতেন। 

খালা মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব গল্প করতেন। 

এক দিন এসে বললেন, কাল রাতে ভারি আশ্চর্য একটি ব্যাপার হয়েছে রঞ্জুঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেলচোখ মেলতেই দেখি একটি ফুটফুটে পরী আমার খাটে বসে আছেআমি তাে অবাকতারপর পরীটি অনেক গল্প করল আমার সঙ্গেভাের হয়ে আসছে যখন, তখন সে বললআমি যাইআমি বললামভাই পরী, তােমার পাখায় একটু হাত দেব? সে বললদাও

আমি পরীর পাখায় হাত বুলিয়ে দেখলাম, কী তুলতুলে পাখাআর সেই থেকে আমার হাতে মিষ্টি গন্ধদেখ না শুকে। 

আমি সফুরা খালার হাত শুকতেই বকুল ফুলের গন্ধ পেলামখালা হয়তাে অনেকক্ষণ বকুল ফুলের মালা হাতে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তারই গন্ধসফুরা খালা সত্যি ভারি অদ্ভুত মেয়ে ছিল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *