আমি ভেবেই পেলাম না একা একা আমি কী করে থাকব। নবু মামা আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া একা একা স্কুলে যাচ্ছি, এই দৃশ্য কল্পনা করলেও চোখে পানি এসে যায়। নবু মামার আমার জন্যে কোনাে মাথা ব্যথা নেই, তার মুখে শুধুই লাল ভাবীর কথা। আমি বললাম, ‘নবু মামা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।
‘আমি কী করে নিয়ে যাব? তুই বাবাকে বল।
নানাজানকে বলবার সাহস আমার নেই। আমি লাল মামীকে ধরলাম। মামী তখন বারান্দায় বসে সুঁচ–সুতাে নিয়ে কী যেন করছিলেন। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে সমস্ত খুলে বললাম। চুপ করে তিনি সমস্ত শুনলেন। আমার কথা শেষ হতেই বললেন, ‘যা তাে, দৌড়ে তাের ছােট খালার কাছ থেকে একটা সােনামুখী উঁচ নিয়ে। আয়। বলবি আমি চাইছি।‘
সুচ এনে দিয়ে আমার কাতর অনুরােধ জানালাম। ‘বলবেন তাে মামী? আজই বলতে হবে। আজ সন্ধ্যাবেলাতেই।
মামী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কি ঘ্যানঘ্যান করিস, পরের বাড়িতে আছিস যে হুস নেই? ইচ্ছে হয় নিজে গিয়ে বল।
এর কিছুদিন পরই পানসি নৌকা করে নানাজান আর নবু মামা চলে গেলেন। যাবার সময় নবুমামার সে কী কান্না! কিছুতেই যাবেন না। লাল মামীর শাড়ি চেপে ধরেছে। তারস্বরে চেচাচ্ছে
‘আমি যাব না, যাব না।‘ লাল মামী শুকননা গলায় বললেন, ‘শাড়ি ছাড়, শাড়ি ধরে চেঁচাচ্ছিস কেন?
নবু মামা চলে যাবার পর আমার কিছু করবার রইল না। আম–কাঁঠালের ছুটি হয়ে গেছে স্কুলে।
অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ
সারাদিন বাড়িতে ঘুরে বেড়াই। বিকেলবেলাটা আর কিছুতেই কাটে না। রােদের তাপ একটু কমতেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সােনাখালি। হেটে যেতে যেতে কত আজগুবি চিন্তা মনে আসে। যেন কোনাে অপরাধ ছাড়াই দেশের রাজা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। হুকুম হয়েছে আমার ফাঁসি হবে। রাজ্যের সমস্ত লােক ফাঁসির মঞ্চের চারদিকে জড় হয়েছে। আমি তাকিয়ে দেখি, এদের মধ্যে লাল রঙের পােশাক পরা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘না, এ ছেলে কোনাে দোষ করে নি, এর ফাঁসি হবে না।‘ বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছে। আমি বলছি, ‘না, হােক, আমার ফাঁসি হােক। মেয়েটি অপলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মুখের গড়ন অনেকটা লাল মামীর মতাে।
সােনাখালি পাকাপুলে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতাম। সেই সময়ে আমার মন থেকে ভূতের ভয় কেটে গিয়েছিল। একেক দিন নিশীথ রাত্রে একা একা ফিরেছি। অন্ধকারে একা ফিরতে ফিরতে কত বার চমকে উঠেছি নাম–না–জানা পাখির ডাকে। কিন্তু ভয় পাই নি কখনাে। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেই মােহরের মা। ভাত বেড়ে দেয়, নাও, খেয়ে গুষ্টি উদ্ধার করা এই সব কথা কখনাে গায়ে মাখি।
আমি সে–সময় অনেক বড়াে দুঃখে ডুবে ছিলাম। ছােটখাট কষ্টের ব্যাপার, যা প্রতিদিন ঘটত, এই নিয়ে সেই কারণেই কোনাে মাথাব্যথা ছিল না।
অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ
দিন আর কাটতে চায় না কিছুতেই। স্নেহ, ভালােবাসা ছাড়া কোনাে মানুষই বাঁচতে পারে না। আমি সে–কারণেই হয়তাে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে সময় কাটাই। কেন জানি না, অসুখটাই ভালাে লাগে। সকাল থেকে সন্ধ্যা শুয়ে শুয়ে ঘুমান ছাড়া অন্য কাজ নেই। মাঝেমধ্যে বাদশা মামা এসে বসেন। নিতান্ত। অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা হয়। মামা হয়তাে বললেন, ‘বেশি করে দুধ খা, শরীরে জোর হবে।
“আচ্ছা মামা খাব। ‘পীরপুরে জন্মাষ্টমীর মেলা, যাবি নাকি দেখতে? ‘অসুখ সারলে যাব।‘
মামা থাকেন অল্পক্ষণ। কথা বলেন ছাড়া–ছাড়া ভঙ্গিতে। দেখে শুনে বড়াে অবাক লাগে। তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। গাল বসে গিয়ে কেমন প্রৌঢ় মানুষের মতাে দেখায়।
লাল মামী বড়াে একটা আসেন না। হয়তাে দরজার বাইরে থেকে বললেন, রঞ্জুর জ্বর আবার এসেছে নাকি? “না মামী, জ্বর নেই।‘
না থাকলেই ভালাে। এই বলে তিনি ব্যস্তভাবে চলে যান। তাঁর যাওয়ার পথে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। সে–সময়ে লাল মামীকে আমি একই সঙ্গে
ভালােবাসি আর ঘৃণাও করি। কোনাে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি এ ধরনের দ্বৈত অনুভুতি––সেই আমার প্রথম। পরবর্তী সময়ে অবশ্যি আরাে অনেকের জন্যেই এমন হয়েছে।
ঠিক এ সময়ে আমার সফুরা খালার সঙ্গে অল্পমাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হল। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হবে, এ আমার খুব ছােটবেলাকার বাসনা। তিনি আমার চেয়ে বৎসরখানেকের বড়াে হবেন। খুব চুপচাপ ধরনের মেয়ে। ছােটবেলা থেকেই দেখেছি, তিনি একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছেন বারান্দায়। হাতে একটা লাঠি। মাঝে মাঝে মেঝেতে ঠক করে শব্দ করছেন আর মুখে বলছেন, ‘উড়ে গেল পাখি। প্রথম দিন এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি তাে আকাশ থেকে পড়েছি। তিনি আমাকে দেখতে পান নি, কাজেই তিনি লাঠি হাতে ঠকঠক করতে লাগলেন আর পাখি ওড়াতে লাগলেন। আমি যখন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খালা কী করেন?
অচিনপুর পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ
লজ্জায় খালার চোখে পানি এসে গেল। কোনাে রকমে বললেন, কিছু না, আমি খেলি।‘
তার পরও খালাকে এমন অদ্ভুত খেলা খেলতে দেখেছি। লজ্জা পাবেন, এই জন্যে আমি তাঁর সামনে পড়ি নি। তাঁর সঙ্গে ভাব করবার আমার খুব ইচ্ছে হত।। কিন্তু তিনি আমাকে দেখলে ভারি লজ্জা পেতেন। | অসুখের সময় প্রায়ই সফুরা খালা এসে দাঁড়াতেন আমার দরজায়। আমি ডাকতাম, খালা, ভেতরে আসেন।
‘না, আমি এখানেই থাকি।‘
এই বলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন দরজায়। অনেক রকম কথা হত তাঁর সাথে। কী ধরনের কথা, তা আজ আর মনে নেই। মনে আছে, খালা সারাক্ষণই মুখ টিপে টিপে হাসতেন।
খালা মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব গল্প করতেন।
এক দিন এসে বললেন, ‘কাল রাতে ভারি আশ্চর্য একটি ব্যাপার হয়েছে রঞ্জু। ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই দেখি একটি ফুটফুটে পরী আমার খাটে বসে আছে। আমি তাে অবাক। তারপর পরীটি অনেক গল্প করল আমার সঙ্গে। ভাের হয়ে আসছে যখন, তখন সে বলল––আমি যাই। আমি বললাম––ও ভাই পরী, তােমার পাখায় একটু হাত দেব? সে বলল––দাও।
আমি পরীর পাখায় হাত বুলিয়ে দেখলাম, কী তুলতুলে পাখা। আর সেই থেকে আমার হাতে মিষ্টি গন্ধ। দেখ না শুকে।
আমি সফুরা খালার হাত শুকতেই বকুল ফুলের গন্ধ পেলাম। খালা হয়তাে অনেকক্ষণ বকুল ফুলের মালা হাতে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তারই গন্ধ। সফুরা খালা সত্যি ভারি অদ্ভুত মেয়ে ছিল।