এক রাতে ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। আমি লিলিকে স্বপ্নে দেখলাম।
সে ঠিক আগেকার মতাে অভিভাবকসুলভ ভঙ্গি করে বলছে, ‘রঞ্জ, তাের একটুও যত্ন হচ্ছে না এখানে। তুই আমার কাছে চলে আয়।‘
আমি লিলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কত দিন হয়েছে সে চলে গেছে। এ দীর্ঘদিনেও তার কথা কেন যে মনে পড়ল না! স্বপ্ন ভেঙে গেলে আমার খুব অবাক লাগল। লিলি যে দেখতে কেমন ছিল, তা পর্যন্ত আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তার চিবুকটা লম্বাটে ধরনের ছিল। সেখানে একটা লাল রঙের তিল ছিল। লিলি ছােটবেলায় আমাকে এই তিল দেখিয়ে বলত, রঞ্জু, এই তিলটা যদি কপালে থাকত, তাহলে আমি রাজরানী হতাম।
দীঘদিন পর লিলিকে স্বপ্নে নিখুঁতভাবে দেখলাম। এবং সে–রাতেই ঠিক করলাম ঘুম ভাঙতেই নানাজানের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে লিলিকে আমি চিঠি দেব। এই মনে করে আমার খুব ভালাে লাগতে লাগল। মনে হল শরীর সেরে গেছে, একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাই।।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই জোছনা দেখে চোখ ছলছলিয়ে উঠল। এমন উথালপাথাল আলাে দেখলে মানুষের মনে এত দুঃখ আসে কেন কে জানে?
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। পা যখন ধরে এল, তখন দেয়াল ঘেসে বসে রইলাম। হঠাৎ শুনি পাশের ঘরে লাল মামী কাঁদছেন।
অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ
কোনাে ভুল নেই, স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মামাও যেন নিচু গলায় কী একটা বললেন। মামী কান্না থামিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘কোনাে কথা শুনব না আমি।
বাইরের এই অপূর্ব জোছনার সঙ্গে এই ঘটনা কেমন যেন মিশ খায় না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
নানাজান বললেন, ‘ঠিকানা নিয়ে কী করবি?
‘চিঠি লিখব। ‘এত দিন পর চিঠি লেখার কথা মনে পড়ল?
আমি চুপ করে রইলাম। নানাজান একটু কেশে বললেন, ‘শরীরের হাল কেমন? জ্বর আছে?‘
“জ্বি না।‘ ‘নবু তাের কাছে চিঠিফিটি লেখে? ‘জ্বি, লেখো
পূজার বন্ধে বাড়ি আসবে বলে চিঠি লিখেছে আমার কাছে। বলতে বলতে নানাজান হঠাৎ কথা থামিয়ে বলেন, ‘লিলিরা আগে যেখানে থাকত, এখন সেখানে
নাই। নতুন ঠিকানা তাে আমার জানা নাই। আচ্ছা, আমি খোঁজ নিয়ে বলব।
‘লিলি আপনার কাছে চিঠি লেখে নানাজান? নানাজান একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘কম লেখে।
আশ্বিনের গােড়াতেই নবু মামা এসে পড়লেন।
তাঁকে দেখে আমার চোখে পলক পড়ে না। লম্বায় বেড়েছেন, স্বাস্থ্য ভালাে হয়েছে। ঠোঁটের উপর হালকা নীল গোঁফের রেখা। নবু মামা আমাকে দেখে হৈহৈ করে উঠলেন, ‘তাের একি হাল রঞ্জু।
‘অসুখ করেছিল আমার। আপনাকে আর চেনা যায় না মামা। | ‘স্বাস্থ্য দেখেছিস? দেখ, হাতের মাস টিপে দেখা।
মাসূল টিপে দেখার দরকার পড়ে না। নবু মামার স্বাস্থ্য সৌন্দর্য দেখে ঈর্ষা হয় আমার। লাল মামী তাে নবু মামাকে চিনতেই পারে না, কে এসেছে ভেবে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অমনি নবু মামা খপ করে তাঁর হাত চেপে ধরলেন। মামী বললেন, ‘নবু নাকি? তুমি তাে বদলে গেছ।‘
অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ
মামী নবু মামাকে আজ প্রথম তুমি করে বললেন। নবু মামা হেসেই কূল পান না। হাসি থামিয়ে কোনােমতে বললেন, ‘ভাবী, তুমি আগের মতােই আছ। না, আগের মতাে নয়, আগের চেয়ে সুন্দর।
অনেক দিন পর নবু মামাকে দেখে কী যে ভালাে লাগল! তাছাড়া মামা এত বেশি বদলে গেছেন কী করে, সেও এক বিস্ময়। ছােটবেলায় দু‘ জনকে তাে একই রকম দেখাত। আমি পরম বিস্ময় নিয়ে নবু মামার পিছু পিছু ফিরতে লাগলাম। নবু মামার গল্প আর ফুরােয় না। স্কুলের গল্প, স্কুলের বন্ধুদের গল্প। রাজশাহীর গল্প। এর মধ্যে রাজশাহী থেকে নাটোর রাজবাড়িতে গিয়েছিলেন––তার গল্প। আমি শুনি, আর অবাক হই।
নবু মামা ক্লান্ত হয়ে এসেছিলেন। দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমিও পাশে শুয়ে আছি, কখন নবু মামা জাগবেন সেই আশায়। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ছােট নানিজান এসে ডেকে তুললেন। দু জনে চলে গেলাম লাল মামীর ঘরে। মামীর প্রতি নবু মামার শৈশবের যে–টান ছিল তা দেখলাম এত দিনের অদর্শনে এতটুকুও কমে নি, বরং বেড়েছে।
লাল মামী বললেন, ‘নবু, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, পরে গল্প করব তােমার সাথে।‘ নবু মামা হাে হাে করে হাসেন, না, গল্প এখনি করতে হবে। আর আগের মতাে তুই করে ডাকতে হবে।‘
এই বলে নবু মামা দরজায় খিল এঁটে দিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নবু মামা রহস্যময় ভঙ্গিতে তাঁর প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছেন, তােমার জন্যে কী এনেছি, দে ভাবী।
‘কী?‘ ‘বল তাে দেখি কী? আন্দাজ কর।‘
লাল মামী ভূ কুঞ্চিত করলেন। নবু মামা বললেন, ছােটবেলায় আমাদের সিগারেট খাইয়েছিলে। আজ আমি সিগারেট নিয়ে এসেছি। আজকে আবার খেতে
‘তুমি কি এর মধ্যেই সিগারেট ধরেছ নাকি?” ‘না, ধরি নি। তােমার জন্যে এনেছি।‘
অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ
বলেই নবু মামা নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে লাল মামীর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন।
লাল মামী বললেন, “আমি সিগারেট খাব না।
খেতেই হবে।‘
নতু মামা জোর করে মামীর মুখে সিগারেট গুজে দিলেন। থুথু করে ফেলে দিয়ে মামী শুকননা গলায় বললেন, ‘তুমি বড়াে বেয়াড়া হয়ে গেছ নবু।‘
নবু মামা ভূক্ষেপ করলেন না। কায়দা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন। এক সময় বললেন, ভাবী, তােমার কাছে আমি এত চিঠি লিখলাম, জবাব দাও নি কেন?
একটা তাে দিয়েছি। ‘না, এবার থেকে সব চিঠির জবাব দিতে হবে।