অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

এক রাতে ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেলআমি লিলিকে স্বপ্নে দেখলাম

অচিনপুর

সে ঠিক আগেকার মতাে অভিভাবকসুলভ ভঙ্গি করে বলছে, রঞ্জ, তাের একটুও যত্ন হচ্ছে না এখানেতুই আমার কাছে চলে আয়‘ 

আমি লিলির কথা ভুলেই গিয়েছিলামকত দিন হয়েছে সে চলে গেছেদীর্ঘদিনেও তার কথা কেন যে মনে পড়ল না! স্বপ্ন ভেঙে গেলে আমার খুব অবাক লাগললিলি যে দেখতে কেমন ছিল, তা পর্যন্ত আমার মনে নেইশুধু মনে আছে, তার চিবুকটা লম্বাটে ধরনের ছিলসেখানে একটা লাল রঙের তিল ছিললিলি ছােটবেলায় আমাকে এই তিল দেখিয়ে বলত, রঞ্জু, এই তিলটা যদি কপালে থাকত, তাহলে আমি রাজরানী হতাম। 

দীঘদিন পর লিলিকে স্বপ্নে নিখুঁতভাবে দেখলামএবং সেরাতেই ঠিক করলাম ঘুম ভাঙতেই নানাজানের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে লিলিকে আমি চিঠি দেবএই মনে করে আমার খুব ভালাে লাগতে লাগলমনে হল শরীর সেরে গেছে, একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাই।। 

বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই জোছনা দেখে চোখ ছলছলিয়ে উঠলএমন উথালপাথাল আলাে দেখলে মানুষের মনে এত দুঃখ আসে কেন কে জানে

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেপা যখন ধরে এল, তখন দেয়াল ঘেসে বসে রইলামহঠাৎ শুনি পাশের ঘরে লাল মামী কাঁদছেন। 

অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

কোনাে ভুল নেই, স্পষ্ট শুনতে পেলামমামাও যেন নিচু গলায় কী একটা বললেনমামী কান্না থামিয়ে ধমকে উঠলেন, কোনাে কথা শুনব না আমি। 

বাইরের এই অপূর্ব জোছনার সঙ্গে এই ঘটনা কেমন যেন মিশ খায় নাআমার মন খারাপ হয়ে গেল। 

নানাজান বললেন, ঠিকানা নিয়ে কী করবি

চিঠি লিখবএত দিন পর চিঠি লেখার কথা মনে পড়ল

আমি চুপ করে রইলামনানাজান একটু কেশে বললেন, শরীরের হাল কেমন? জ্বর আছে?‘ 

জ্বি নানবু তাের কাছে চিঠিফিটি লেখে? জ্বি, লেখো 

পূজার বন্ধে বাড়ি আসবে বলে চিঠি লিখেছে আমার কাছেবলতে বলতে নানাজান হঠাৎ কথা থামিয়ে বলেন, লিলিরা আগে যেখানে থাকত, এখন সেখানে

নাইনতুন ঠিকানা তাে আমার জানা নাইআচ্ছা, আমি খোঁজ নিয়ে বলব। 

লিলি আপনার কাছে চিঠি লেখে নানাজান? নানাজান একটু ইতস্তত করে বললেন, কম লেখে। 

আশ্বিনের গােড়াতেই নবু মামা এসে পড়লেন। 

তাঁকে দেখে আমার চোখে পলক পড়ে নালম্বায় বেড়েছেন, স্বাস্থ্য ভালাে হয়েছেঠোঁটের উপর হালকা নীল গোঁফের রেখা। নবু মামা আমাকে দেখে হৈহৈ করে উঠলেন, তাের একি হাল রঞ্জু। 

অসুখ করেছিল আমারআপনাকে আর চেনা যায় না মামা| স্বাস্থ্য দেখেছিস? দেখ, হাতের মাস টিপে দেখা। 

মাসূল টিপে দেখার দরকার পড়ে নানবু মামার স্বাস্থ্য সৌন্দর্য দেখে ঈর্ষা হয় আমারলাল মামী তাে নবু মামাকে চিনতেই পারে না, কে এসেছে ভেবে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেনঅমনি নবু মামা খপ করে তাঁর হাত চেপে ধরলেন। মামী বললেন, নবু নাকি? তুমি তাে বদলে গেছ‘ 

অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

মামী নবু মামাকে আজ প্রথম তুমি করে বললেননবু মামা হেসেই কূল পান নাহাসি থামিয়ে কোনােমতে বললেন, ভাবী, তুমি আগের মতােই আছনা, আগের মতাে নয়, আগের চেয়ে সুন্দর। 

অনেক দিন পর নবু মামাকে দেখে কী যে ভালাে লাগল! তাছাড়া মামা এত বেশি বদলে গেছেন কী করে, সেও এক বিস্ময়ছােটবেলায় দুজনকে তাে একই রকম দেখাতআমি পরম বিস্ময় নিয়ে নবু মামার পিছু পিছু ফিরতে লাগলামনবু মামার গল্প আর ফুরােয় নাস্কুলের গল্প, স্কুলের বন্ধুদের গল্পরাজশাহীর গল্পএর মধ্যে রাজশাহী থেকে নাটোর রাজবাড়িতে গিয়েছিলেনতার গল্পআমি শুনি, আর অবাক হই। 

নবু মামা ক্লান্ত হয়ে এসেছিলেনদুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেনআমিও পাশে শুয়ে আছি, কখন নবু মামা জাগবেন সেই আশায়ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাছােট নানিজান এসে ডেকে তুললেনদু জনে চলে গেলাম লাল মামীর ঘরেমামীর প্রতি নবু মামার শৈশবের যেটান ছিল তা দেখলাম এত দিনের অদর্শনে এতটুকুও কমে নি, বরং বেড়েছে। 

লাল মামী বললেন, নবু, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, পরে গল্প করব তােমার সাথেনবু মামা হাে হাে করে হাসেন, না, গল্প এখনি করতে হবে। আর আগের মতাে তুই করে ডাকতে হবে‘ 

এই বলে নবু মামা দরজায় খিল এঁটে দিলেনআমি অবাক হয়ে দেখলাম, নবু মামা রহস্যময় ভঙ্গিতে তাঁর প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছেন, তােমার জন্যে কী এনেছি, দে ভাবী। 

কী?বল তাে দেখি কী? আন্দাজ কর‘ 

লাল মামী ভূ কুঞ্চিত করলেননবু মামা বললেন, ছােটবেলায় আমাদের সিগারেট খাইয়েছিলেআজ আমি সিগারেট নিয়ে এসেছিআজকে আবার খেতে 

তুমি কি এর মধ্যেই সিগারেট ধরেছ নাকি?না, ধরি নিতােমার জন্যে এনেছি‘ 

অচিনপুর পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

বলেই নবু মামা নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে লাল মামীর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। 

লাল মামী বললেন, আমি সিগারেট খাব না। 

খেতেই হবে‘ 

নতু মামা জোর করে মামীর মুখে সিগারেট গুজে দিলেনথুথু করে ফেলে দিয়ে মামী শুকননা গলায় বললেন, তুমি বড়াে বেয়াড়া হয়ে গেছ নবু‘ 

নবু মামা ভূক্ষেপ করলেন নাকায়দা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেনএক সময় বললেন, ভাবী, তােমার কাছে আমি এত চিঠি লিখলাম, জবাব দাও নি কেন

একটা তাে দিয়েছিনা, এবার থেকে সব চিঠির জবাব দিতে হবে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *