এই বলে নবু মামা বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘রঞ্জু, চল মাঠে বেড়াই। খুব বাতাস দিচ্ছে। মাঠে হাঁটলে খিদে হবে।
মাঠে সে–রাতে প্রচুর জোছনা হয়েছে। চকচক করছে চারিদিক। ঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছে। নবু মামা চেঁচিয়ে বললেন, ‘কী জোছনা, খেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় কপকপ করে খেয়ে ফেলি। নবু মামা মুখ হাঁ করে খাবার ভঙ্গি করতে লাগলাে। বিস্মিত হয়ে আমি তাঁর আনন্দ দেখলাম।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখি, বাদশা মামা জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছেন। নবু মামাকে দেখে নির্জীব কণ্ঠে শুধালেন, ‘কখন এসেছিস?”
‘সকালে। তুমি কোথায় ছিলে?
বাদশা মামা বিড়বিড় করে কী বললেন বােঝা গেল না। নবু মামা বললেন, ‘তােমার কী হয়েছে?
বাদশা মামা এর উত্তরেও বিড়বিড় করলেন। ভাত খেতে খেতে নবু মামা বললেন, ‘বাদশা ভাইয়ের কী হয়েছে? নানিজান বললেন, ‘দু করেছে তাকে?”। ‘কে যাদু করেছে?
“কে আবার? বউ।
নবু মামা রেগে গিয়ে বলল, ‘কি সব সময় বাজে কথা বলেন। | নানিজ্জান বললেন, ‘কী যে গুণের বউ, তা কি আর এতদিনে জানতে বাকি আছে আমার? বাদশার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।
লাল মামী কখন যে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, জানতে পারি নি। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘কে যাদু করেছে, মা?”
নানিজান বললেন, ‘বউ, তুমি চোখ রাঙিয়ে কথা বল কার সঙ্গে?
‘আমি চোখ রাঙিয়েছি? | ‘তুমি কার উপর গরম দেখাও বউ, রূপের দেমাগে তাে পা মাটিতে পড়ে না। এদিকে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না আমি। বাঁজা মেয়েমানুষ বলে সারা দুনিয়ার লােকে তােমাকে ডাকে।
নবু মামা বললেন, ‘মা, আপনি চুপ করেন।
‘কেন চুপ করব? কাকে ডরাই আমি? বাদশাকে আজ বললে কাল সে তিন তালাক দেয়।
লাল মামী বললেন, ‘তাই বলেন না কেন? ঐ তাে বসে আছে চৌকিতে। যান, গিয়ে বলেন।
নবু মামা আর আমি দোতলায় উঠে দেখি মামী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। আমাদের দেখে উচু গলায় বললেন, ‘নবু, তুমি কালকে আমাকে বাবার বাড়িতে রেখে আসবে।‘
নবু মামা চুপ করে রইলেন।
নবু মামা এক মাস রইলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিদিন সেগুলি পড়া হত। লােহারামের কেচ্ছা বলে একটি বই ছিল––এমন হাসির! নবু মামা পড়তেন, আমি আর লাল মামী শুনে হেসে গড়াগড়ি। ছােট নানিজান এক–এক দিন রেগে ভূত হতেন।
‘আস্তে হাসতে পার না বউ? তােমার শ্বশুর শুনলে কী হবে? মােহরের মা আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলত––
‘যত হাসি তত কান্না
কহে গেল রাম সন্না। নবু মামা শুনতে পেলে বলতেন, ‘মােহরের মা, তােমার রাম সন্নাকে এই বইটা একটু পড়তে দিও। দেখি, ব্যাটা হাসে কি কাঁদে।
এক দিন হাসির শব্দ শুনে লাজুক পায়ে সফুরা খালা এসে হাজির। দরজার ওপাশে থেকে ফিসফিস করে বলছে, ভাবী, তােমরা কী নিয়ে হাসছ?
‘গল্প শুনে হাসছি। হাসির গল্প।
সফুরা খালা ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে মিটমিট হাসি হাসতে লাগলেন। যেন
আমাদের কোনাে গােপন অভিসন্ধি টের পেয়ে গিয়েছেন। তারপর আগের মতো ফিসফিসে গলায় বললেন, ‘হাসির গল্প আমার ভালাে লাগে না।‘
তবু তিনি অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসে বসে নবু মামার গল্প পড়া শুনলেন। তার বললেন, ‘চল না, সবাই মিলে দীঘির ঘাট থেকে বেড়িয়ে আসি, এখন তাে আর লােকজন নেই।
সেদিন থেকে আমাদের রুটিন হল, গল্পটল্প পড়ার পর দীঘির ঘাটে বেড়াতে যাওয়া। বেড়াতে বেড়াতে এক দিন নবু মামার উল্লাসের কোনাে সীমা থাকত না। স্কুল থেকে শিখে আসা একটা হিন্দি গান বেসুরাে গলায় ধরে বসতেন। প্রথম লাইনটি বােধহয় এ–রকম ছিল
‘মাটি মে পৌরণ। মাটি মে শ্রাবণ
মাটি মে তনবন যায়গা। পাখির ডানায় ভর করে সময় কাটতে লাগল। অবশ্যি বেড়াতে এসে মাঝে মধ্যে লাল মামীর ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। সেগুলি ঘটত তখনি, যখন মামী দেখতে পেতেন বাদশা মামা ঘাটের উল্টো দিকে চুপচাপ বসে আছেন। দেখে মনে হয়, যেন মানুষ নয়, উইয়ের টিবি। এতটুকু নড়চড়াও নেই।
দেখতে দেখতে নবু মামার ছুটির দিন ফুরিয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল একা একা আমার থাকতে হলে আমি আর বাচব না। যতই যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে ততই আমার কষ্ট বাড়তে থাকে। যাবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ভারি মন নিয়ে লাল মামীর ঘরে বসে আছি। নবু মামাও কথা বলছে না। এমন সময় নিচে থেকে কানাবিবি ডাকল, ‘ও এলাচি বেগম, ও এলাচি বেগম।
লাল মামী বললেন, ‘আসছি। কেমন ডাকে দেখ না। নবু মামা বললেন, ‘তােমার নাম এলাচি কেন ভাবী? ‘আমার মুখে সব সময় এলাচির গন্ধ থাকে, এই জন্যেই এলাচি নাম।
নবু মামা এগিয়ে এসেছেন, ‘আগে তাে কোনাে দিন বল নি, শুকে দেখতাম। দেখি ভাবী, মাথাটা একটু নিচু কর তাে।
কী পাগলামী কর নবু!’
বলার আগেই নবু মামা লাল মামীর মাথা জাপটে ধরেছে এবং হৈহৈ করে উঠেছে, “আরে সত্যি তাই। সত্যি এলাচির গন্ধ।
ছােট নানিজান ঢুকলেন এ সময়। শুকনাে গলায় বললেন, ‘ও বউ, তােমাকে এক ঘন্টা ধরে ডাকছে কানাবিবি। কানে শুনতেটুনতে পাও তাে?‘
লাল মামী বললেন, ‘কী জন্যে ডাকছে? | সে যে তােমাকে গলায় আর কোমরে বাঁধবার জন্যে তাবিজ দিয়েছিল, সেগুলি কী করেছ?
ফেলে দিয়েছি। ‘কেন ফেলে দিয়েছ? ‘তাবিজ দিলে কী হবে?
নানিজান রেগে আগুন হয়ে বললেন, ‘কী, এত বড় সাহস তােমার বউ ? আল্লাহর কোরান কালামকে অবিশ্বাস! রােজা নাই, নামাজ নাই। বেহায়া বেপর্দা মেয়ে।
নবু মামা বললেন, ‘মা, আপনি চুপ করেন।