অচিনপুর পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ

এই বলে নবু মামা বেরিয়ে এলেনবললেন, রঞ্জু, চল মাঠে বেড়াইখুব বাতাস দিচ্ছেমাঠে হাঁটলে খিদে হবে। 

অচিনপুর

মাঠে সেরাতে প্রচুর জোছনা হয়েছেচকচক করছে চারিদিকঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছেনবু মামা চেঁচিয়ে বললেন, কী জোছনা, খেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় কপকপ করে খেয়ে ফেলিনবু মামা মুখ হাঁ করে খাবার ভঙ্গি করতে লাগলােবিস্মিত হয়ে আমি তাঁর আনন্দ দেখলাম। 

অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখি, বাদশা মামা জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছেননবু মামাকে দেখে নির্জীব কণ্ঠে শুধালেন, কখন এসেছিস?” 

সকালেতুমি কোথায় ছিলে

বাদশা মামা বিড়বিড় করে কী বললেন বােঝা গেল নানবু মামা বললেন, তােমার কী হয়েছে

বাদশা মামা এর উত্তরেও বিড়বিড় করলেনভাত খেতে খেতে নবু মামা বললেন, বাদশা ভাইয়ের কী হয়েছে? নানিজান বললেন, দু করেছে তাকে?কে যাদু করেছে

কে আবার? বউ। 

নবু মামা রেগে গিয়ে বলল, কি সব সময় বাজে কথা বলেন| নানিজ্জান বললেন, কী যে গুণের বউ, তা কি আর এতদিনে জানতে বাকি আছে আমার? বাদশার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। 

লাল মামী কখন যে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, জানতে পারি নিঠাণ্ডা গলায় বললেন, কে যাদু করেছে, মা?” 

নানিজান বললেন, বউ, তুমি চোখ রাঙিয়ে কথা বল কার সঙ্গে

আমি চোখ রাঙিয়েছি? | তুমি কার উপর গরম দেখাও বউ, রূপের দেমাগে তাে পা মাটিতে পড়ে নাএদিকে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না আমিবাঁজা মেয়েমানুষ বলে সারা দুনিয়ার লােকে তােমাকে ডাকে। 

নবু মামা বললেন, মা, আপনি চুপ করেন। 

কেন চুপ করব? কাকে ডরাই আমি? বাদশাকে আজ বললে কাল সে তিন তালাক দেয়। 

লাল মামী বললেন, তাই বলেন না কেন? তাে বসে আছে চৌকিতেযান, গিয়ে বলেন। 

নবু মামা আর আমি দোতলায় উঠে দেখি মামী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়আমাদের দেখে উচু গলায় বললেন, নবু, তুমি কালকে আমাকে বাবার বাড়িতে রেখে আসবে‘ 

নবু মামা চুপ করে রইলেন। 

নবু মামা এক মাস রইলেন আমাদের সঙ্গেতিনি অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিদিন সেগুলি পড়া হতলােহারামের কেচ্ছা বলে একটি বই ছিলএমন হাসির! নবু মামা পড়তেন, আমি আর লাল মামী শুনে হেসে গড়াগড়িছােট নানিজান একএক দিন রেগে ভূত হতেন। 

আস্তে হাসতে পার না বউ? তােমার শ্বশুর শুনলে কী হবে? মােহরের মা আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলত– 

যত হাসি তত কান্না 

কহে গেল রাম সন্নানবু মামা শুনতে পেলে বলতেন, মােহরের মা, তােমার রাম সন্নাকে এই বইটা একটু পড়তে দিওদেখি, ব্যাটা হাসে কি কাঁদে। 

এক দিন হাসির শব্দ শুনে লাজুক পায়ে সফুরা খালা এসে হাজির। দরজার ওপাশে থেকে ফিসফিস করে বলছে, ভাবী, তােমরা কী নিয়ে হাসছ

গল্প শুনে হাসছিহাসির গল্প। 

সফুরা খালা ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে মিটমিট হাসি হাসতে লাগলেনযেন 

আমাদের কোনাে গােপন অভিসন্ধি টের পেয়ে গিয়েছেনতারপর আগের মতো ফিসফিসে গলায় বললেন, হাসির গল্প আমার ভালাে লাগে না‘ 

তবু তিনি অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসে বসে নবু মামার গল্প পড়া শুনলেনতার বললেন, চল না, সবাই মিলে দীঘির ঘাট থেকে বেড়িয়ে আসি, এখন তাে আর লােকজন নেই। 

সেদিন থেকে আমাদের রুটিন হল, গল্পটল্প পড়ার পর দীঘির ঘাটে বেড়াতে যাওয়াবেড়াতে বেড়াতে এক দিন নবু মামার উল্লাসের কোনাে সীমা থাকত নাস্কুল থেকে শিখে আসা একটা হিন্দি গান বেসুরাে গলায় ধরে বসতেনপ্রথম লাইনটি বােধহয় রকম ছিল 

মাটি মে পৌরণমাটি মে শ্রাবণ 

মাটি মে তনবন যায়গাপাখির ডানায় ভর করে সময় কাটতে লাগলঅবশ্যি বেড়াতে এসে মাঝে মধ্যে লাল মামীর ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যেতসেগুলি ঘটত তখনি, যখন মামী দেখতে পেতেন বাদশা মামা ঘাটের উল্টো দিকে চুপচাপ বসে আছেনদেখে মনে হয়, যেন মানুষ নয়, উইয়ের টিবিএতটুকু নড়চড়াও নেই। 

দেখতে দেখতে নবু মামার ছুটির দিন ফুরিয়ে গেলআমার মনে হতে লাগল একা একা আমার থাকতে হলে আমি আর বাচব নাযতই যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে ততই আমার কষ্ট বাড়তে থাকেযাবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ভারি মন নিয়ে লাল মামীর ঘরে বসে আছিনবু মামাও কথা বলছে নাএমন সময় নিচে থেকে কানাবিবি ডাকল, এলাচি বেগম, এলাচি বেগম। 

লাল মামী বললেন, আসছিকেমন ডাকে দেখ নানবু মামা বললেন, তােমার নাম এলাচি কেন ভাবী? আমার মুখে সব সময় এলাচির গন্ধ থাকে, এই জন্যেই এলাচি নাম। 

নবু মামা এগিয়ে এসেছেন, আগে তাে কোনাে দিন বল নি, শুকে দেখতামদেখি ভাবী, মাথাটা একটু নিচু কর তাে। 

কী পাগলামী কর নবু!’ 

বলার আগেই নবু মামা লাল মামীর মাথা জাপটে ধরেছে এবং হৈহৈ করে উঠেছে, আরে সত্যি তাইসত্যি এলাচির গন্ধ। 

ছােট নানিজান ঢুকলেন সময়শুকনাে গলায় বললেন, বউ, তােমাকে এক ঘন্টা ধরে ডাকছে কানাবিবিকানে শুনতেটুনতে পাও তাে?‘ 

লাল মামী বললেন, কী জন্যে ডাকছে? | সে যে তােমাকে গলায় আর কোমরে বাঁধবার জন্যে তাবিজ দিয়েছিল, সেগুলি কী করেছ

ফেলে দিয়েছিকেন ফেলে দিয়েছ? তাবিজ দিলে কী হবে

নানিজান রেগে আগুন হয়ে বললেন, কী, এত বড় সাহস তােমার বউ ? আল্লাহর কোরান কালামকে অবিশ্বাস! রােজা নাই, নামাজ নাইবেহায়া বেপর্দা মেয়ে। 

নবু মামা বললেন, মা, আপনি চুপ করেন। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *