অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

না চাইলেও দেখতে হবে।’ 

‘আমি দেখতে চাই না, কারণ নিকি অন্যের হাত ধরে হাঁটছে, এই দৃশ্য সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

‘অন্যের হাত ধরে তাে হাঁটবে না । তােমার হাত ধরেই হাঁটবে। আমরা এই দৃশ্যটি দেখাতে চাই, যাতে তােমার মত বদলায়, তুমি পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল কর । পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া তােমার জন্যে ভয়াবহ ব্যাপার হবে। 

‘হলে হবে। 

যােগাযােগ কেটে গেল। আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার পাশে নিকি নেই । অন্য আমিও নেই। ওরা নিশ্চয়ই নতুন জীবন শুরু করেছে। করুক। আমি ফিরে যাব আমার চেনা পৃথিবীতে। ওদের জীবন গুরুর দৃশ্য দেখার আমার কোনাে ইচ্ছা নেই। 

তবু দেখতে হল । 

স্বপ্নদৃশ্যের মতাে একটি দৃশ্য। খণ্ড খণ্ড ছবি। কী অপূর্ব! অভিভূত করে দেবার মতাে সুন্দর । মন খারাপ করিয়ে দেবার মতাে সুন্দর। | বৃক্ষ লতাগুলুময় অরণ্য। নাম-না-জানা অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। বিচিত্র রূপ। হালকা বাতাসে গাছের পাতা কাঁপছে। মর্মরধ্বনির মতাে ধ্বনি। আমি গাঢ় আনন্দময় হাসির শব্দ শুনলাম। হাসতে হাসতে নিকি ছুটে যাচ্ছে, তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে— 

যে তাকে ধরবার জন্যে ছুটছে, তাকেও আমি চিনি। সে অন্য আমি। ছবি মিলিয়ে গেল । এখন অন্য ছবি। জ্যোৎস্নার ফিনিক ফুটেছে । আকাশে দুটি চাল। একটি প্রকাণ্ড, অন্যটি ছােট। নীলাভ আলাের বন্যায় অরণ্য ভেসে যাচ্ছে। দুটি চাদের কারণেই হয়লে গাছের পাতায় রামধনুর মতাে রঙ। আমি ওদের দুজনকে দেখেছি, তারা মুগ্ধ বিস্ময়ে জোৎস্না দেখছে। কী গভীর আনন্দ ওদের চোখে-মুখে ! 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

এই ছবিও মিলিয়ে গেল, এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি। বিশাল সমুদ্র। সমুদ্রের জলের রঙ গাঢ় সবুজ, কারণ আকাশের রঙ সবুজ। সমুদ্র খুব শান্ত নয়। বড়ো বড়াে ঢেউ উঠছে। ওরা দু জন ভয় এবং বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। 

অামার স্বপ্ন কেটে গেল। আমি শুনতে পেলাম, তুমি কি থেকে যেতে চাও না?’ আমি বললাম, না।’ 

ঘুম ভাঙল। | অভ্যাসবশে তাকালাম ঘড়ির দিকে নটা দশ বাজে। জানালার ভাঙা কাচ দিয়ে সূর্যের আলাে এসে পড়েছে পায়ের কাছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডারে এপ্রিল মাস, তার মানে ফিরে এসেছি পৃথিবীতে। আমার চেনা জায়গা, চেনা জগৎ। 

উঠে গিয়ে জানালা খুললাম। অস্পষ্টভাবে মনে হল বাইরের এই পৃথিবী একটু যেন অন্য রকম। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এত সূক্ষ্ম যে ঠিক ধরা যাচ্ছে না। অথচ রাস্তাঘাট আগের মতােই আছে। দোকানপাট একই রকম। তবুও কেন জানি আলাদা।প্রকৃতি তার জগতে অনিয়ম সহ্য করে না, কথাটা বোধ হয় ঠিক। দ্বিতীয় আমির দেখা পেলাম না। নিজের ঘরেই রাত এগারটা পর্যন্ত বসে রইলাম। কেউ এল না। দ্বিতীয় আমি বলে কেউ থাকলে এর মধ্যে এসে পড়তে। প্রকৃতি এই ভয়াবহ অনিয়ম হতে দেয় নি। নিজেকে কোনাে এক ভাবে বদলে ফেলছে ।রাত বারটার দিকে পুরােপুরি নিশ্চিত হয়ে নিকিকে টেলিফোন করলাম। আমি জানি মাঝরাতে টেলিফোন পেয়ে সে প্রথমে খানিকটা কপট বিরক্তি দেখালেও শেষটায় প্রচণ্ড খুশি হবে। সব সময় তাই হয় । 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

অনেকক্ষণ রিং হবার পর নিকির ঘুমন্ত গলা শোনা গেল, কে ? ‘আমি।’ ‘আমিটা কে ? ‘আমাকে চিনতে পারছ না নিকি ? 

আমি আমার নাম বললাম। নিকি কঠিন স্বরে বলল, ‘এখন চিনতে পারছি। কেন আপনি রাতদুপুরে বিরক্ত করেন ? 

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। নিকি এসব কী বলছে ! 

আলাে নিকি?’ 

আর একটি কথাও নয়। আর একটি কথা বললে আমি পুলিশে খবর দেব । শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা ? আপনার যন্ত্রণা অনেক সহ্য করেছি। 

আমি শুনলাম ঘুম জড়ানাে এক পুরুষ-কণ্ঠ বলছে, ‘কে কথা বলছে নিকি ? নিকি বলল, “ঐ বদমাশটা । আবার রাতদুপুরে ফোন।নিকি টেলিফোন নামিয়ে রাখল । আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম । প্রকৃতি তার জগতে অনিয়ম সহ্য করে না। প্রয়ােজনে পুরাে জগৎটা বদলে দেয়। তাই সে করেছে। 

সারা রাত আমার ঘুম হল না। ভাের বেলায় ত্রিভুজ চিহ্ন দেয়া চিঠি পেলাম। 

জনাব, 

আপনাকে অবিলম্বে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সপ্তম শাখায় উপস্থিত হতে বলা হচ্ছে ? অত্যন্ত জরুরি। 

বিনীত 

এস, মাধুর 

ডিরেকটর, মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্র-৭ আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।ভয়াবহ চক্রের ব্যাপারটি এখন বুঝতে পারছি। জুন মাসের ৩০ তারিখে আমি রওনা হব মহাকাশযানে। আবার ফিরে আসব এই পৃথিবীতে। এসে দেখব এপ্রিল মাস। দুমাস কাটবে, আবার আসবে জুন মাস মহাকাশযানে করে রওনা হব, আবার ফিরে আসব। অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বছর ধরে এই চক্র চলতেই থাকবে। প্রকৃতি তার জগতের নিয়ম ভঙ্গকারীকে এমনি করেই শাস্তি দেবে।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

চিঠি হাতে আমি রাস্তায় নেমে এলাম। বারবার ইচ্ছা হইে লাফিয়ে কোনাে একটা দ্রুতগামী বাসের সামনে পড়ে যাই। চক্র ভাঙার এই একটি মাত্রই পৃথ। তা অবশ্য করলাম না। হেঁটে হেঁটে উপস্থিত হলাম নিকির ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। সে এপ্রন গায়ে দিয়ে টিনের কৌটা সাজাচ্ছিল। আমাকে দেখতেই চিনতে পারল। কঠিন মুখে বলল, “আবার জ্বালাতে এসেছেন ? আপনার কাণ্ড কিছু বুঝি না, প্রতি বছর এপ্রিল মাসে রাত বারটায় একবার টেলিফোন করবেন, তার পরদিন আসবেন দেখা করতে । বাকি বছরে আর আপনার কোনাে খোঁজ নেই ? কে আপনি বলুন তাে? 

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, আমি কেউ না। তােমার সঙ্গে আগামী বছর আবার দেখা হবে। 

ফিরে যেতে যেতে মনে হল—ভয়াবহ চক্রে শুধু যে আমি একা আটকা পড়েছি তাই নয়, এই পৃথিবীর সবাই আটকা পড়েছে। অনন্তকাল ধরে নিকিকে এপ্রিল মাসের এক ব্লতে টেলিফোন পেয়ে জেগে উঠতে হবে। অনন্তকাল ধরে এই পৃথিবী থেকে একটি মহাকাশযান জুন মাসের ৩০ তারিখ যাত্রা শুরু করবে অনন্ত নক্ষত্রবীখির দিকে। কোনাে দিন যা কোথাও পৌঁছবে না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *