অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

আমার চেতনা আবার আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কী ভয়ংকর জটিলতা ! আমি কাতর কণ্ঠে বলি, অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না। আলাে চাই—মান্য কিছু আলাে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও । অপেক্ষা কর । 

আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতেই হয়তাে-বা নিযুত লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে যায়, কিংবা কে জানে এই জগতে হয়তাে সময় বলে কিছু নেই। 

হয়তাে আমার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর নতুন একটি অবস্থায় আমি আছি। এই অবস্থায় শরীর নেই, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কিছুই নেই, আছে শুধু চেতনা। এই চেতনা নিয়ে আমি ভেসে আছি অনন্ত মহাশূন্যে। আমার চারপাশে বিপুল অন্ধকার, নৈঃশব্দের ভয়াবহ মহাশূন্য... 

আমি মনে হচ্ছে বেঁচেই আছি। মনে হচ্ছে বলছি কারণ আমি পুরােপুরি নিশ্চিত নই। বড়াে রকমের একটা জট কীভাবে যেন লেগে আছে, জট খুলতে পারছি না। হয়তাে পাগল-টাগল হয়ে গেছি। কোনাে ইন্দ্রিয় ঠিকমতাে কাজ করছে না। কিংবা মৃত মানুষদেরও হয়তাে চেতনা বলে কিছু আছে। অদ্ভুত সব দৃশ্য সে দেখে এবং অদ্ভুত সুৰ শব্দ সে শোনে।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

যে-সব ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে, আমি সেসব সাজাতে পারছি না । মহাকাশযানে করে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য—এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ। একটা দুর্ঘটনা ঘটল। ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তারপআমার আর কিছু মনে নেই। দুর্ঘটনায় আমার জীবনের ইতি হয়ে যাবার কথা। তাও হল না। মনে হল খানিকটা চেতনা অবশিষ্ট আছে। মাঝেমাঝে কে যেন আমায় সান্ত্বনা দেয়, বলে, ধৈর্য ধর, আমরা আছি।’ কে বলে ? জানতে পারি না, কারণ চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। 

এখন অন্ধকার নেই, আমি সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পারছি। তবে যা দেখছি তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে, যে-জট লেগেছে তা কোনাে দিন খুলবে না। কারণ আমি চারপাশে দেখছি আমার পরিচিত জগৎ। আমার এপার্টমেন্টের সাত তলার ঘর। কেঁচকানাে বিছানার চাদরের এক কোনায় কফির দাগ লেগে গিয়েছিল। সেই দাগও আছে। বাথরুমের শাওয়ারটা নষ্ট | সব সময় ঝিরঝির করে পানি পড়ে। এখনাে পড়ছে, শব্দ শুনছি। খাটের পাশে শেলফে অনেকগুলি বই। মেঝেতে একটা পেপারব্যাক বই পড়ে আছে, নাম দি ওরিওনা’ । ভৌতিক উপন্যাস।

কিনে এনেছিলাম, কিন্তু এক পৃষ্ঠাও পড়ি নি। খুব নাকি চমৎকার বই। নিকি পড়েছে। তার ধারণা এটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বই। এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে আসবার সময় বইটি যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। আমার জন্যে এর চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখি প্রতিটি পৃষ্ঠা সাদা। | শেলফের বইয়েরও একই অবস্থা। বেশির ভাগ বইয়েরই সব পৃষ্ঠা সাদা। অবশ্যি কিছু কিছু বই পাওয়া গেল যেগুলিতে লেখা আছে। একটি বইয়ের ত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লেখা, বাকি পাতাগুলি সাদা। এর মানে কী! 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। কী অদ্ভুত কাণ্ড, জানালার ওপাশে ঘন অন্ধকার—কিছুই নেই ! আমার এই মাটি ছাড়া ব্রহ্মাণ্ডে যেন আর কিছু নেই। এর কোনাে মানে হয় না। এটা গভীর রাত হলেও বাইরে লােকজন চলাচল করবে। স্ট্রিট লাইট জ্বলবে ? কিন্তু এটা রাত নয়, কারণ আমার ঘরে বাতি জ্বলছে না, অথচ ঘরের ভেতর দিনের মতাে আলাে। আমার খাটে তেরছা করে সূর্যের আলাে পড়েছে, অথচ বাইরে কোনাে সূর্য নেই । 

আমি উঁচু গলায় বললাম, ‘এসব কী হচ্ছে? কেউ আমার কথার জবাব দেবে ভাবি নি, কিন্তু জবাব পেলাম। কোনাে শব্দ হল না, অথচ পরিষ্কার বুঝলাম কেউ একজন বলছে, ‘তােমার ঘরটি কি আমরা ঠিকমতাে তৈরি করি নি ? 

আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে ? তুমি কে? ‘আমি কে তা জানতে পারবে। তার আগে বল কেমন বােধ করছ ? ‘আমি কি বেঁচে আছি ? 

‘নিশ্চয়ই বেঁচে আছ, তােমাকে বাঁচিয়ে তুলতে খুবই কষ্ট করতে হয়েছে । তোমার বেশির ভাগ অঙ্গপ্রত্যঙ্গই নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে। এটা তেমন কোনাে জটিল ব্যাপার নয়, তবুও খুব ক্লান্তিকর দীর্ঘ ব্যাপার। 

আমি আমার চারপাশে যে সব দেখছি, তা কি আমার কল্পনা না সত্যি সত্যি দেখছি ? 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

যা দেখছ সত্যি দেখছ। এইসব জিনিসের স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কের কোষে, যাকে তােমরা বল নিওরােন-সেখানে ছিল। আমরা তা দেখে দেখেই তােমার চারপাশের পরিবেশ তৈরি করেছি। তুমি একটু আগেই লক্ষ করেছ কিছুকিছু বইয়ের সব পাতা সাদা। ঐ বইগুলি তুমি পড় নি, কাজেই তােমার মাথায় কোনাে 

স্মৃতি নেই । আমরা যে কারণে লেখা তৈরি করতে পারি নি। যে-সব বই পড়েছ, তার স্মৃতি তোমার আছে। কাজেই সে-সব তৈরি করা হয়েছে। আমি কী বলছি বুঝতে পারছ? 

না, পারছি না। 

ধীরে ধীরে বোঝাই ভালাে। তােমার মস্তিষ্ক এখনাে পুরােপুরি সবল হয় নি। আরাে কিছু সময় যাক। 

‘তােমরী কে ? 

এখনাে বুঝতে পারছ না?না।’ বুঝবে, সময় হলেই বুঝবে। ‘আমার সঙ্গীরা কোথায় ? 

সবাই ভালাে আছে। তিশ-২ নামের একটি রােবট ছিল।’ 

তাকেও ঠিকঠাক করা হয়েছে।’ 

‘তােমরা কি বুদ্ধিমান কোনাে প্রাণী

‘প্রাণী বলতে তােমরা যা বােঝ, আমরা সে-রকম নই। আমাদের জন্ম ও মৃত্যু নেই। 

“তা কী করে হয়! 

‘কেন হবে না ? একটি আঙটির কথাই ধর। আঙটিটির কোনাে শুরু নেই আবার শেষও নেই। তাই নয় কি? 

তােমরা দেখতে কেমন ? 

এই প্রশ্নের জবাব আমরা জানি না। আমরা লক্ষ করেছি দেখার ব্যাপারটিতে তোমরা খুব জোর দিচ্ছ। এই ব্যাপারটা কী, সেই সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এখন তুমি বিশ্রাম নাও। | আমার চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে পরিচিত ঘর অদৃশ্য। চারপাশে অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, কিংবা আমার চেতনা বিলুপ্ত হল। কী হল ঠিক জানি না। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *