মানুষের বিস্মিত হবারও একটা সীমা আছে।
সীমা অতিক্রম করবার পর সে আর কোনাে কিছুতেই বিস্মিত হয় না। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। বিস্মিত হবার ক্ষমতা অতিক্রম করেছি। চোখের সামনে যা দেখছি, তাতে আর অবাক হচ্ছি না।
আমার জীবন এখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে আছে—নিদ্রা এবং জাগরণ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকছি, আবার জেগে উঠছি। জাগছি বিশেষ বিশেষ পরিবেশে। অকল্পনীয় সব দৃশ্য দেখছি, কিন্তু এখন আর অবাক হচ্ছি না।
এই মুহুর্তে আমার জাগরণের কাল চলছে। আমি এখন আছি একটা ছােট্ট কাঠের ঘরে। পুরনো ধরনের ঘর। পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক আগের পৃথিবীর মানুষরা যে-রকম ঘর বানাত অবিকল সে-রকম লগ কেবিন। একটি জ্বলন্ত ফায়ার-প্লেস আছে। বড় বড় কাঠের গুঁড়ি ফায়ার-প্লেসে পুড়ছে। ঘরে পােড়া কাঠের ঝঝাল গন্ধ। একটিমাত্র কাচের জানালা। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বাইরের অঞ্চলটি কোনাে পার্বত্য অঞ্চল নয়। সমভূমি। দিগন্তবিস্তৃত বরফ-ঢাকা মাঠ। আকাশ ধোয়াটে। প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। তুষারঝড় শুরু হবার আগের
অবস্থা। ফায়ার-প্লেসের সামনে একটি রকিং চেয়ারে বসে আছে ইনাে। তার মুখ হাসি হাসি । মনে হচ্ছে তার আনন্দের সীমা নেই। ইনাে আমাকে দেখে চেয়ার দোলানাে বন্ধ করে রহস্যময় গলায় বলল, পরিবেশটা কেমন লাগছে বলুন তাে? চমঙ্কার না ?
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
আমি কিছু বললাম না । ইননা হালকা গলায় বলল, “আপনি মনে হচ্ছে মােটেই অবাক হচ্ছেন না। আপনার কাছে সব কিছুই মনে হয় বেশ স্বাভাবিক লাগছে।’ ( কথার পিঠে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু বললাম, ‘আপনি বেঁচে আছেন দেখে আনন্দ লাগছে। দুর্ঘটনার পর এই প্রথম সঙ্গীদের কোনাে একজনের সঙ্গে দেখা হল।
ইলাে বলল, আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না আপনি আমাকে পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়েছেন । কেমন কঠিন মুখ। বসুন আমার পাশে, গল্প করি। কে জানে এক্ষুণি হয়ত সব অদৃশ্য হয়ে যাবে। বলতে বলতে সে শব্দ করে হাসল । আমি ইনাের পাশে বেতের নিচু চেয়ারটায় বসলাম। ফায়ার–প্লেসের আগুনের আঁচ এখন একটু বেশি। সরে বসলেই হয়, কিন্তু সরে বসতে ইচ্ছে করছে না। মাঝে মাঝে নিজেকে কষ্ট দিতেই বেশি ভালাে লাগে । ইনাে আবার দোল খেতে শুরু করেছে। মাথার দু’পাশ থেকে দুটি লম্বা বেণি দুলছে। ইনাের মাথায় কখনাে বেণি দেখি নি। সে এখানে চুল বেঁধে বেণি করেছে তাও মনে হয় না ।
তার গায়ের পােশাক, সাজসজ্জা—সবই অন্য কেউ করে দিচ্ছে । ইননা কি ব্যাপারটা লক্ষ করছে ? তার ভাবভঙ্গি দেখে তা মনে হয় না । চোখ আধবােজা করে সে ক্রমাগত দোল খেয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থাতেই সে নরম গলায় বলল, “খুব ছোটবেলায় আমি একটা বই পড়েছিলাম। বইটার নাম হলুদ আকাশ’। সেই বইয়ের নায়িকা একা-একা একটা বাড়িতে থাকত। ফায়ার-প্লেসের সামনে রকিং চেয়ারে বসে দোল খেত। আমি তখন থেকেই একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
কি স্বপ্ন?
‘যেন আমি হলুদ অাকাশ’ বইটির নায়িকা । নির্জন প্রান্তরের একটি লগ কেবিনে আমি আছি। ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন। বাইরে তুষারঝড় হচ্ছে। প্রচণ্ড দুর্যোগ। ঝড়ের গর্জনে কান পাতা যাচ্ছে না। অথচ ঘরের ভেতর শান্তিময় একটা পরিবেশ। এখন যে রকম দেখছেন অবিকল সে রকম। এরা ড্রামার স্বপ্নের কথা জানতে পেরে এরকম চমৎকার একটা পরিবেশ তৈরি করেছে।
এরা মানে কারা ?
তা তাে বলতে পারব না। যারা আমাদের বাঁচিয়ে তুলেছে, তারা । খুবই উন্নত কোনাে প্রাণী। মহাশক্তিধর কেউ।’
তাদের সঙ্গে কি আপনার কোনাে কথা হয়েছে ?
না। তবে তারা আমার মনের সব কথাই জানে এবং খুব ভালােভাবেই জানে, নয়তাে এরকম চমত্তার পরিবেশ তৈরি করতে পারত না। আমি যা যা চেয়েছি সবই এখানে আছে।’
‘আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার কল্পনায় যা যা ছিল সবই এখানে পেয়েছেন। ‘, পেয়েছি।’
আপনি কি আমাকেও চেয়েছিলেন ?
তার মানে ?
‘এই ঘর তৈরি হয়েছে আপনার কল্পনাকে ভিত্তি করে। যদি তাই হয়, তাহলে আমার উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার উপায় কী? উপায় একটিই ধরে নিতে হবে যে, আপনার কল্পনায় আমিও ছিলাম।
ইনে চেয়ার দোলানাে বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল । তারপর প্রায় বরফশীতল গলায় বলল, আমার কল্পনায় আপনি ছিলেন না। আমি একা একা এ রকম একটি ঘরে খাকার কথাই ভাবতাম। এটা আমার কিশােরী বয়সের কল্পনা। একজন কিশােরীর কল্পনার সঙ্গে হয়তাে আপনার পরিচয় নেই। কিশােরীর কল্পনা সাধাণত নিঃসঙ্গ হয়। একজন কিশােরী কখনাে কল্পনা করে না ।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
যে, সে একজন পুরুষের সঙ্গে একটি নির্জন ঘরে রাত্রিযাপন করছে।
আমি লক্ষ করলাম ইনো বেশ রেগে গেছে। তার গলার স্বর কঠিন। মুখে রক্ত চলে এসেছে। এই মেয়ে মনে হচ্ছে খুব অল্পতেই অপমানিত বােধ করে। আমাদের এখন যে অবস্থা তাতে এত সহজে অপমানিত বােধ করার কথা নয়। আমি বললাম, আপনি আমার কথা ভাবেন নি, খুব ভালো কথা। রেগে যাচ্ছেন কেন ? ইনো আগের মত ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘শুরুতে আপনার কথা আমি ভাবি নি। কিন্তু পরে ভেবেছি। ভেবেছি বলেই এরা আপনাকে এখানে এনেছে।
‘কেন ভেবেছেন জানতে পারি ?
না, জানতে পারেন না।‘
আমি হেসে ফেললাম। মেয়েটি কিশােরীদের মতাে আচরণ করছে। অকারণে রাগছে। আমি বললাম, “আপনি কি অনেক দিন ধরেই এখানে আছেন ?
‘যা, অনেক দিন। তবে ঘরটা সব সময় এক রকম থাকে না। একেক সময় একেক রকম হয়। এরা আমার কল্পনা নিয়ে খেলা করে। মূল ব্যাপারটা ঠিক রেখে একেক সময় একেক রকম করে পরিবেশ তৈরি করে। চমৎকার ব্যাপার!
আপনার মনে হয় বেশ মজা লাগছে।‘