লাগৱই তাে কথা। যেখানে মরতে বসেছিলাম, সেখানে দিব্যি বেঁচে আছি। যারা আমাদের বাঁচিয়েছে, তাদের খুব খারাপ প্রাণী বলেও আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমাদের মােটামুটি সুখেই রেখেছে। আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতেও রাখবে।
ইনাে বেশ শব্দ করে হাসল । তার সঙ্গে এর আগে একবার মাত্র আমার কথা হয়েছে। অল্প কিছু সময় কথা বলে একজন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। মানুষ অত্যন্ত রহস্যময় প্রাণী, তাকে বুঝতে হলে দীর্ঘদিন তার পাশাপাশি থাকতে হয়। ইনাের পাশাপাশি থাকার মতো সুযােগ আমার হয় নি । তবু আমার মনে হল এই ইনাে ঠিক আগেকার ইনাে নয়। সুক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন তার মধ্যে হয়েছে, যা আমি ধরতে পারছি না। তারা নানান রকম পরিবেশ তৈরি করেছে। পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। যদি তাই হয় তাহাল মানুষ নিয়েও কি পরীক্ষানিরীক্ষা
করছে না ? হয়তাে একেক বার একেক ধরনের ইনাে তৈরি করছে। নষ্ট করে ফেলছে, আবার তৈরি করছে।
আমি হালকা গলায় বললাম, ‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এরা আমাদের তৈরি করেছে। ভ্রাপনি নিজে একজন জীববিজ্ঞানী। জীববিজ্ঞানী হিসেবে আপনি বলুন, তৈরি করার কাজটিতে তারা কেমন সফল ?
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’
‘আপনাকে এর নতুন করে তৈরি করেছে। কারণ ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর আপনি এবং আমরা সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাই নয় কি ?
যা, তাই।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আমাদের আবার তৈরি কব্রার মতাে জটিল কাজটি এরা চমৎকার ভাবে করেছে। তবু আমার মনে হচ্ছে আমরা ঠিক আগের মতাে নই। আপনার কি তা মনে হয় না ?
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
ইনাে হেসে ফেলে বলল, “আগে হচ্ছিল না, এখন হচ্ছে। আপনার বকবকানি শুনে মনে হচ্ছে। আপনার এ রকম বকবকানি স্বভাব আগে ছিল না।’
ইনাে খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসি আর থামতেই চায় না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। সেই পানি সে মুছল না। চমকার ছবি। মুগ্ধ হয়ে থাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ইনাে বলল, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ?
আমি বললাম, আপনাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি ?
অবশ্যই পারেন। তবে প্রশ্নের উত্তর দেব কি দেব না তা আমার ইচ্ছা। কী প্রশ্ন ?‘ | ‘কিশােরী বয়সে আপনি একটি উপন্যাস পড়েছিলেন। যে উপন্যাসের নায়িকা
এ রকম একটা লগ কেবিনে একা-একা থাকত, তাই না?
‘হ্যা।
‘সেও কি মাঝে–মাঝে খুব হাসত ? হাসতে–হাসতে তার চোখে পানি এসে যেত কি ?
কেন জিজ্ঞেস করছেন?
আপনিও অবিকল সে রকম করেছেন। আপনার মানসিকতা ঐ মেয়েটির মতো হয়ে গেছে। অর্থাৎ এরা আপনাকে বদলে ফেলেছে।‘
তাতে অসুবিধা কী ?
‘কোনাে অসুবিধা নেই। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এরা আমাদের নিয়ে খেলছে একজন শিশুকে খানিকটা কাদা দিলে শিশুটি কী করে? একেক সময় একেক রকম খেলনা বানায়। কোনােটাই তার পছন্দ হয় না | ভাঙে এবং তৈরি করে।
এরা শিশু
, তা নিশ্চয়ই নয়। এরা অতি উন্নত কোনাে প্রাণী । তবে উন্নত প্রাণীর মধ্যে শিশুসুলভ কিছু থাকে।
তাতে অসুবিধা কী? আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমরা যে বেঁচে আছি আমি তা সম্ভব হয়েছে এদের জন্যেই।
সত্যিই কি আমরা বেঁচে আছি ? ‘তার মানে ?
‘আপনি একজন জীববিজ্ঞানী, আমরা বেঁচে আছি কিনা তা একমাত্র আপনার পক্ষেই বলা সম্ভব । বেঁচে থাকার একটি শর্ত হচ্ছে খাদ্য গ্রহণ। আপনি কখনাে খাদ্য গ্রহণ করেছেন বলে কি আপনার মনে পড়ে ?
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
ইনাে জবাব দিল না। তার ঐ কুঞ্চিত হল। আমি বললাম, আমার তাে মনে হয় চারপাশে যা দেখছি সবই মায়া, এক ধরনের বিভ্রম।
‘এ রকম মনে হবার কারণ কী?
“আপনি রকিং–চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন, তাই না? আপনার গায়ে কী পােশাক ?
“বিশেষ কোনাে পােশাক নয়। সাধারণ স্কার্ট ।
‘কিন্তু আমি আপনার গায়ে কিছু দেখছি না। আমি দেখছি অত্যন্ত রূপবতী একজন তরুণী নগ্ন গায়ে রকিং–চেয়ারে দোল খাচ্ছে ।
ইনাে হকচকিয়ে গেল। আমি বললাম, এরা এইসব ছবি আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি করছে। আমার তো মনে হয় আমরা দুজন পাশাপাশিও নেই। হয়ত ওদের ল্যাবরেটরির এক কোনায় আপনার মস্তিষ্ক পড়ে আছে। অন্য প্রান্তে আমারটা।
ওরা আমাদের মস্তিষ্কের নিওরােন নিয়ে খেলা করছে ।
ইনাে চাপা গলায় বলল, ‘আপনি কি সত্যি সত্যি আমার গায়ে কোনাে কাপড় দেখতে পাচ্ছেন না ?
নী।’
“আমার তাে মনে হয় আপনি সত্যি কথা বলছেন না। আমাকে ধাধায় ফেলে দেবার জন্যে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।
আমি যে সত্যি কথা বলছি তা এক্ষুণি প্রমাণ করতে পারি।’ প্রমাণ করুন। | ‘আপনার শরীরের একজায়গায় লালরঙের এক বর্গ সেন্টিমিটার আয়তনের একটা জন্মদাগ আছে। জায়গাটা হচ্ছে...।
‘থাক আর বলতে হবে না। প্লিজ আপনি এখন আর আমার দিকে তাকাবেন না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকুন।
“আপনার দিকে তাকালেও কোনাে ক্ষতি নেই। কারণ আমরা যা দেখছি সবই মায়া বিভ্রম। কোনােটাই সত্যি নয়।’
‘সত্যি হােক আর না হােক, আপনি আমার দিকে তাকাবেন না।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ফায়ার–প্লেসের আগুন নিভে আসছে। ‘কাঠের বড় বড় গুঁড়ি পুড়ে শেষ হয়েছে। শীত শীত লাগছে। বাইরে তুষারঝড়ের মাতামাতি । দমকা হাওয়ায় জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইনাের রক্কিং-চেয়ার থেকে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ আর শােনা যাচ্ছে না।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
অর্থাৎ তার দুলুনি বন্ধ হয়েছে। ঘরের আলাে কমে আসতে শুরু করেছে। এটা কি শুধু আমার জন্যেই, নাকি ইনাের কাছেও এ রকম মনে হচ্ছে ? আমি ডাকলাম, ‘ইনাে।
বলুন শুনছি।’
‘আমি দেখছি ঘরের আলাে কমে আসছে। আপনার কাছেও কি সে-রকম মনে হচ্ছে
না। আপনার কাছে কি আলাে ঠিকই আছে ?
হা, সবই ঠিক আছে।’
তার মানে এরা আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। এখন হয়তাে আমার বদলে অন্য কেউ আসবে।‘
হয়তাে-বা।’