আপনারা কারা ? ‘তােমার এই প্রশ্নের উত্তর আগে একবার দিয়েছি। আবারাে দিচ্ছি—আমরা পরিব্রাজক।
বুঝতে পারলাম না।
‘আমাদের অনেক কিছুই বুঝতে পারবে না। বুঝতে চেষ্টা করে জটিলতা বাড়াবে ? তা কি ভালাে হবে ?
বুঝতে পারব না কেন?
“তােমরা তােমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পনা করতে পার না। তােমরা যখন একটি দৈত্যের ছবি আঁক, সেও দেখতে মানুষের মতাে হয়। তােমাদের কল্পনা সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ কল্পনায় আমাদের বােঝা মুশকিল।
‘তবু চেষ্টা করব। পরিব্রাজক ব্যাপারটা কী?
যিনি ঘুরে বেড়ান, তিনিই পরিব্রাজক। আমরা ঘুরে বেড়াই। একদিন যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখনাে চলছি। চলতেই থাকব।’
‘কোথায় ? “জানি না।’
যাত্রা শুরু হয়েছিল কবে? “তাও জানি না।’
আপনি কি একা, না আপনারা অনেকে ?” ‘আমরা একই সঙ্গে একা এবং একই সঙ্গে অনেকে।
বুঝতে পারছি না। অাগেই তাে বলেছি বুঝতে পারবে না। আপনার কি জন্ম-মৃত্যু আছে? ‘মৃত্যু বলে তাে কিছু নেই। পদার্থবিদ্যায় পড় নি, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই ?
আপনি কি এক ধরনের শক্তি ? “শুধু আমি কেন, তুমি নিজেও তে শক্তি। ‘আপনি বলছেন আপনি ভ্রমণ করেন। এতে কী লাভ হয় ? “তােমার কথা বুঝতে পারছি না। লাভ–ক্ষতির প্রশ্ন আসছে কেন?’ ‘সব কিছুরই কোনাে-না-কোনাে উদ্দেশ্য থাকে। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী ? ‘জ্ঞানলাভ। আমি শিখছি।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
কেন শিখছেন ?’ ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানবার জন্যে। ‘এই জ্ঞান দিয়ে কী করবেন?
তুমি অদ্ভুত সব প্রশ্ন করছ। ‘এই জাতীয় প্রশ্ন কি আপনি নিজেকে কখনাে করেন না?’
না। আমি দেখি । কত অপূর্ব সব রহস্য এই অনন্তু নক্ষত্রবীথিতে । বড়াে ভালাে লাগে। এই যে তোমাদের দেখা পেয়েছি, কী বিপুল রহস্য তােমাদের মধ্যে।
কী রহস্য? ‘এখনাে পুরােপুরি ধরতে পারি নি । আরাে কিছু সময় লাগবে।’
শেষ পর্যন্ত আমাদের দিয়ে কী করবেন ? ‘তােমরা যা চাও তা-ই করব। কী চাও তােমরা?
যা চাই তা-ই করতে পারবেন?
‘কেন পারব না ? ‘পথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারবেন ?
সে তাে খুবই সহজ ব্যাপার।’ “আপনি সত্যি বলছেন ?
তাই তাে মনে হয়। তুমি কি পৃথিবীতে যেতে চাও?’ ‘ ।। ‘একজন তরুণী তােমার জন্যে অপেক্ষা করছে, সেই কারণে?
খা।। ‘অবিকল ঐ তরুণীটিকে যদি তৈরি করে দিই, তাহলে কেমন হয় ?
কীভাবে তৈরি করবেন ?
একটি সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে প্রয়ােজন হয় একটি ডিএনএ এবং একটি অরএনএ অণু। তােমার ভালােবাসার মেয়েটির একগুচ্ছ চুল তােমার সঙ্গে ছিল। সেখান থেকেই তৈরি করে দেয়া যায়। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। কী অদ্ভুত সব কথা ! এসব কি সত্যি সত্যি শুনছি না ঘােরের মধ্যে কল্পনা করে নিচ্ছি ? আবার কথা শােনা গেল, ‘অৰিকল তোমাদের সূর্যের মতাে একটা নক্ষত্র আশেপাশে আছে। তার কাছাকাছি তােমাদের পৃথিবীর মতো একটি গ্রহও আছে। সেখানে তােমরা নতুন জীবন শুরু করতে পার।’
‘নতুন জীবন শুরু করবার আমার কোনাে আগ্রহ নেই। আমি আমার পুরনাে জায়গায় ফিরে যেতে চাই।’
তােমার বান্ধবীর কাছে ? হ্যা, তা-ই।
আমার মনে হল আমি হাসির শব্দ শুনলাম। কিংবা হাসির কাছাকাছি কোনাে প্রক্রিয়া ঘটল। ওরা যেন খুব মজা পাচ্ছে।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
তুমি অন্যদের মতাে নও। তােমার সঙ্গীরা কেউ পুরনো জায়গায় ফিরে যেতে চাচ্ছে না।’
‘সেটা তাদের ইচ্ছা। আমি যা চাই তা বললাম। ‘ওরা কী চায় তা জানতে চাও?
ওদের প্রসঙ্গে আমার কোনাে কৌতুহল নেই। ‘কৌতূহল না থাকার কারণ কী?
এমনিতেই আমার কৌতুহল কম।
তুমি ঠিক বলছ না। তােমার কৌতুহল যথেষ্ট আছে। আমাদের সম্পর্কে তুমি একগাদা প্রশ্ন করেছ।’
‘শুধু আমি একা নিশ্চয়ই না, আমার সঙ্গীরাও নিশ্চয়ই আপনাদের একগাদা প্রশ্ন করেছে।
‘না, করে নি। তাদের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ সম্ভব হয় নি। ‘কেন হয় নি?
‘তা বুঝতে পারছি না। তােমরা যাকে ইএসপি ক্ষমতা বল, সেই ক্ষমতা তোমার যেমন আছে তােমার সঙ্গীদেরও তেমনি আছে। কিন্তু তারা তা ব্যবহার করতে পারছে না, অথচ তুমি পারছ। এই রহস্য আমরা ভেদ করতে পারছি না।
আমাদের আর কোন্ কোন্ রহস্য আপনারা ভেদ করতে পারেন নি ? ‘অনেক কিছুই পারি নি। “অনেক কিছু না পেরেও অবিকল আমাদের মতাে প্রাণ সৃষ্টি করে ফেললেন !
‘জীন থেকে প্রাণ সৃষ্টি তেমন জটিল কিছু নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার সহজ প্রয়োগ।
‘আমাদের কোন্ ব্যাপারটি আপনারা বুঝতে পারছেন না, বলুন। আমি আপনাদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করব। তবে তার বদলে আপনারা আমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবেন।
আবার হাসির মতাে শব্দ হল। ভুল বললাম, শব্দ নয়, আমার কেন জানি ধারণা হল ওরা হাসছে। খুব মজা পাচ্ছে। শিশুদের ছেলেমানুষি অথচ ভারিক্কি ধরনের কথায় আমরা যেমন মজা পাই।
“ভয় নেই, আমরা তােমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাব।’
আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আবার সেই সঙ্গে এখানেও রেখে দেব।
তা কী করে সম্ভব ? ‘খুব কি অসম্ভব ?
‘পদার্থবিদ্যার একটি সূত্র হচ্ছে একটি বস্তু একই সঙ্গে দুটি স্থান দখল করতে পারে না।
‘পদার্থবিদ্যার সূত্র বহাল রেখেও তা করা যাবে। যখন করব তখন বুঝবে। তবে এই সঙ্গে তােমাকে বলে রাখি, তােমাদের পদার্থবিদ্যার অনেক সূত্রই কিন্তু সত্যি নয়।’
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
তাতে আমার কোনাে মাথাব্যথা নেই। আমি পদার্থবিদ নই। পদার্থবিদ্যার সমস্ত সুত্র রসাতলে যাক, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
তুমি তােমার বান্ধবীর কাছে ফিরে যেতে পারলেই খুশি ? হ্যা, তা-ই। সে কি একজন অসাধারণ মহিলা। ‘হা অসাধারণ। ‘আমাদের কাছে তাকে কিন্তু খুব অসাধারণ কিছু মনে হল না।
তার মানে ! আমরা তােমার বান্ধবীকে তৈরি করেছি।’
আমি চুপ করে রইলাম। না, আর অবাক হব না। কোনাে কিছুতেই না।
তােমার বান্ধবী সমস্ত ব্যাপারটাকে স্বপ্ন বলে ধরে নিয়েছে । আমরা তাকে তােমার কাছে পৌছে দেব। তুমি ধীরেসুস্থে তাকে সব বুঝিয়ে বল ।
তােমরা যে-নিকি তৈরি করেছ, সে পৃথিবীর নিকি নয়। “সে অবিকল পৃথিবীরই নিকি, তবে তাকে তৈরি করা হয়েছে।
তার মানে, এই মুহূর্তে দুজন নিকি আছে ?
হ্যা, দু’ জন আছে । প্রয়ােজনে আরাে অনেক বাড়ানাে যেতে পারে। কাজেই এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে একই বস্তু একই সঙ্গে দুটি স্থান দখল করতে পারে।’
পারে।‘ ‘তুমি কি তােমার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আগ্রহ বােধ করছ না?