অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ

ওরা আমাকে বলেছে। যে-সব মহাজ্ঞানীরা আমাদের নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে তারাই নিজেদের সম্পর্কে বলেছে “আমরা একই সঙ্গে একা এবং অনেকে।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

তাহলে তারা কি— আমার মাথায় ভেঁতা যন্ত্রণা হতে লাগল। ওদের সঙ্গে যােগাযােগের এটা হচ্ছে পূর্বাবস্থা। যােগাযােগ হল। 

‘তুমি ঠিক লাইনেই চিন্তা ভাবনা করছ।’ 

‘আমি ঠিক লাইনে চিন্তা-ভাবনা করছি কি না তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনি আমাকে বলুন, আপনাদের নতুন খেলার অর্থ কী? 

‘কোটাকে তোমরা নতুন খেলা বলছ ? ‘আমাকে দ্বিতীয় বার তৈরি করেছেন, যার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। 

অপ্রয়ােজনীয় কিছু করার মতাে সময় আমাদের নেই। যা করা হয়েছে, প্রয়ােজনেই করা হয়েছে। মানব সম্প্রদায়ের প্রধান ক্রটি কী, তা ধরতে চেষ্টা করছি। তুমি চাইলে তােমাকে ব্যাখ্যা করতে পারি।’ 

‘আমি চাই না।’ 

না চাইলেও শােন, তোমাদের প্রধান ক্রটি হচ্ছে পুরুষ এবং রমণীর ব্যাপারটি। মানুষকে অসম্পূর্ণ ভাবে তৈরি করা হয়েছে। একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে যেমন সম্পূর্ণ নয়, তেমনি একজন রমণীও নয়। দু’ জনকে একত্রিত করে একটি সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করা যেতে পারে। বংশবৃদ্ধির পদ্ধতিটি তাতে বদলাবে, নতুন ধরনের মানুষ তৈরি হবে। তাকে তুমি মুক্ত-মানুষ বলতে পার।’ 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ

মুক্তমানুষ ? ‘মুক্ত-মানুষ। সম্পূর্ণ মুক্তির জন্যে অবশ্যি তােমাদের শারীরিক প্রক্রিয়াও বদলে দিতে হবে। বিশেষ করে খাদ্যগ্রহণের প্রক্রিয়া। খাদ্য থেকে তােমরা শক্তি সংগ্রহ কর, অতি নিম্নস্তরের প্রাণী যা করে। তােমাদের সমস্ত চিন্তা-চেতনা খাদ্য-সংগ্রহকে ঘিরে। 

মেধার কী অপচয় ! শক্তিসংগ্রহের প্রক্রিয়াটাকে সহজেই বদলে দেয়া যায়। এমন করে দেয়া যায়, যাতে প্রয়ােজনীয় শক্তি তােমরা সূর্য থেকে সংগ্রহ করতে পার। 

গাছের মতাে? 

অনেকটা তাই। মানুষ হয়ে জন্মেছি, গাছ হবার ইচ্ছা নেই। 

সব কিছুই তােমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে, এমন মনে করার কোনাে কারণ নেই।’ 

সব কিছু আপনাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই হবে, এ রকম মনে করারও কোনাে কারণ নেই।’ | ‘মানুষের দ্বিতীয় টিটি হচ্ছে আবেগনির্ভর যুক্তিপ্রয়ােগ। যুক্তি এবং আবেগ দুটি ভিন্ন জিনিস । তােমরা দুটিকে মিশিয়ে অদ্ভুত একটা কিছু তৈরি কর, যা যুক্তিও নয়, আবেগও নয়।’ | ‘আপনারাও তাে তাই করেছেন, পুরুষ এবং রমণী দুটি ভিন্ন জিনিস। দুটিকে মিশিয়ে অদ্ভুত কিছু তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন যা পুরুষও হবে না, রমণীও হবে ।’ 

‘তুমি আবার একটি আবেগনির্ভর যুক্তি প্রয়ােগ করলে। তােমাদের তৃতীয় ত্রুটি হচ্ছে… 

ত্রুটির কথা শুনতে-শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সম্পর্কে ভালাে কিছু বলার থাকলে বলুন? 

সত্যি শুনতে চাও? ‘চাই।’ 

বিস্ময়কর ক্ষমতা দিয়ে তোমাদের পাঠানাে হয়েছে কিংবা বলা যেতে পারে বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন এক শ্রেণীর প্রাণের উদ্ভব হয়েছে, যারা তাদের সত্যিকার ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দুটি জগৎ আছেএকটি বস্তুজগৎ, অন্যটা পরাবস্তুজগৎ। মানুষের ক্ষমতা প্রাবস্তুজগতে। অথচ তা সে জানে না। সে মােতছে বস্তুজগৎ নিয়ে। বাধ্য হয়ে মানুষদের তা করতে হচ্ছে, কারণ শারীরিক প্রক্রিয়ার কারণে মানুষ বস্তুজগতের ওপর পুৱােপুরি নির্ভরশীল । যে জন্যে পুরা বস্তুজগতের বিপুল সম্ভাবনার কিছুই মানুষ জানে না। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ

পরাবস্তুজগৎ ব্যাপারটা কী ? বস্তুজগতের বাইরের জগৎ।’ ‘শক্তিজগৎ?’ 

না। বস্তু এবং শক্তি আলাদা কিছু নয় । পরা-বস্তুজগৎ হচ্ছে মাত্রাশূন্য জগৎ। ‘কিছু বুঝতে পারছি না।’ 

বুঝতে পারার কথা নয় । তােমরা বাস করছ তিন মাত্রার জগতে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা—এই মাত্রা যেই জগতে বিলুপ্ত তাকে পরা-বস্তুজগৎ বলতে পার। 

‘বুঝতে পারছি নাআরো সহজ করে বলুন। 

এর চেয়ে সহজ করে বলতে পারছি না। বরং তােমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিই। তােমরা একটি অভিযাত্রী দল নিয়ে রওনা হয়েছতোমাদের যাত্রা অনন্তু নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। যার জন্যে তােমরা একটা মহাকাশযান তৈরি করে। অথচ যার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। তােমরা ঘরে বসেই যা জানার জানতে পারতে, কারণ তোমরা মাত্রা ভাঙতে পার। এই জিনিসটা তােমাদের অজানা। 

আমাদের শিখিয়ে দিন। 

‘শেখানাে সম্ভব নয়আমাদের সেই ক্ষমতা নেইআমরা তুর্মাত্রিক জীব। ত্রিমাত্রিক জগতের অর্থে আমাদের ক্ষমতা তােমাদের চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু পরা-জগতে অমািদের কোনাে আধিপত্য নেই। যে কারণে তােমাদের দেখে আমরা একই সঙ্গে বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছি। অকল্পনীয় ক্ষমতা তােমাদের হাতের মুঠোয়, অথচ তোমরা কত অসহায়। সামান্য একটি ব্ল্যাকহােলের খপ্পরে তােমাদের মহাকাশযান পড়ল, তােমরা সেই ব্লাকহােলের কবল থেকে বেরুতে পারছ না। অথচ ইচ্ছা করলেই নিমিষের মধ্যে তোমরা নতুন একটি পৃথিবী তৈরি করতে পার, একটি নক্ষত্রপুঞ্জ তৈরি বা ধ্বংস করতে পার। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ

আপনি এসব কী বলছেন? 

যা সত্যি তাই বলছিআমরা পরিব্রাজক, আমাদের এক মুহূর্তের জন্যেও থেমে থাকার কথা নয়আমরা খেমে আছি তোমাদের জন্যেই। তোমাদের বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের অভিভূত করেছেএই সঙ্গে বিষাদগ্রস্তও হচ্ছি। মেধার 

কী বিপুল অপচয় । 

‘কেন জানি আপনার কথা ঠিক বিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না।’ ‘মনে না হবার কোনাে কারণ নেই। তােমাদের সঙ্গে এক জীববিজ্ঞানী আছে, যার নাম ইনাে।

 সে নিজেই তার পছন্দমতো একটি জগৎ তৈরি করেছে। অখুচ তার ধারণা আমরা তা তৈরি করেছিআমরা করি নিআমরা শুধু পরাবস্তু-ক্ষমতার প্রয়ােগের জন্যে পরিবেশ তৈরি করেছি। মেয়েটিকে সীমাহীন নিঃসঙ্গতায় ঠেলে দিয়েছি। যে কারণে সে নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচার জন্যে নিজেই নিজের একটি জগৎ 

তৈরি করেছে । তােমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি দেখেছ। 

‘সেই জগৎ কি মায়া না সত্যি

সত্যি তাে বটেইএখন কি তুমি বুঝতে পারছ কী পরিমাণ ক্ষমতা তােমাদের আছে?’ 

‘বুঝতে চেষ্টা করছি‘ 

‘তুমি বারবার তােমার পৃথিবীতে ফিরে যাবার কথা বলছ। আমাদের বলার তো কোনাে প্রয়োজন নেই। তুমি তো নিজে ইচ্ছে করলেই ফিরে যেতে পার। কিংবা অবিকল সেই পৃথিবীর মতাে পৃথিবী তৈরি করতে পার তােমার চারপাশে। 

‘আমার অন্য সঙ্গীরা কী করছে ? তারা কি এসব জানে ? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *