অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১)- হুমায়ূন আহমেদ

দ্রুত একি ধরনের শব্দ হচ্ছে ।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

পরিচিত কোনাে শব্দের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই বলে শব্দটাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যাবে না। লক্ষ লক্ষ ঝিঝি পোকার আওয়াজকে যদি কোনাে উপায়ে কমিয়ে অতি সূক্ষ্ম পর্দায় নিয়ে আসা যায় এবং সেই আওয়াজটাকে দিয়ে ঘূর্ণির মতাে কিছু করা যায়, তাহলে বােধ হয় কিছুটা ব্যাখ্যা হয়। না, তাও হয় না। আওয়াজটার মধ্যে ধাতুব ঝংকার আছে। ঝিঝি পােকার আওয়াজে কোনাে ধাত ঝংকার নেই। শব্দটা অস্বস্তিকর। স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে । আমাকে বলা হয়েছে এই শব্দ সহ্য হয়ে যাবে। মানুষের সহ্য করবার শক্তি অসীম। কাজেই সহ্য হলেও হতে পারে। কিন্তু আমার এখনাে হচ্ছে না। কোনােদিন হবে বলেও মনে হয় না। আমি খুবই অস্থির বােধ করছি। 

 মহাশূন্যযান‘গ্যালাক্সি টু’-তে আজ আমার তৃতীয় দিন। এর আগে আমি কখনাে কোনাে মহাশুনাযানে ওঠা দূরে থাক, তার ভেতরের ছবি পর্যন্ত দেখি নি। মহাশূন্যের প্রতি আমার কোনাে আগ্রহ নেই। অযুত নিযুত লক্ষ কোটি মাইল দূরের গ্রহগুলি কেমন ? সেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে কিনা তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১)

আমি একজন টিভি প্রােগ্রাম মনিটার কার্যক্রমের অতি সামান্য কর্মচারী। আমার কাজ হচ্ছে বিশেষ বিশেষ কোনাে টিভি প্রোগ্রাম দর্শকদের কেমন লাগল তা মনিটর করে স্ট্যাটিসটিক্স তৈরি করা। যেমন টিভি চ্যানেল থ্রিতে একটা হাসির সিরিয়েল হচ্ছে, নাম ‘কথা বলা না-বলী। আমার কাজ হচ্ছে প্রােগ্রাম চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন বাড়িতে টেলিফোন করে অত্যন্ত ভদ্রভাবে জানতে চাওয়া, ম্যাডাম (বা স্যার, আপনি কি এই মুহূর্তে টিভি দেখছেন? 

 যদি উত্তর হয় যা’, তাহলে বল, ‘কোন চ্যানেল দেখছেন ? 

তার উত্তর হ্যা হলে জিজ্ঞেস করা, কথা বলা না-বলা অনুষ্ঠানটি আপনার কেমন লাগছে ? বেশির ভাগ সময়ই কোনাে উত্তর পাওয়া যায় না, আমার প্রশ্ন শুনেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখে। কেউ কেউ অত্যন্ত রাগী গলায় বলে, ‘আমাদের-এ-ভাবে বিরক্ত করার কী অধিকার আছে আপনার?’ আবার অনেকে কুৎসিত গালাগালি করে । আমি গায়ে মাখি না। গায়ে মাখলে চাকরি করা যায় না। আমি হাসিমুখে আমার কাজ করি। যথাসময়ে রিপাের্ট পাঠিয়ে দিই। আমার মতাে আরাে অনেকেই আছে। তারাও রিপাের্ট পাঠায়। এইসব রিপাের্টের ওপর ভিত্তি করে প্রােগ্রাম রেটিং করা হয়। মাস শেষ হলে একটা চেক পাই । 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১)

গত মাসে ব্যতিক্রম হল। চেকের সঙ্গে আলাদা খামে এক চিঠি এসে উপস্থিত। চিঠির ওপর সােনালি রঙের ত্রিভুজের ছাপ। এর মানে হচ্ছে, অত্যন্ত জরুরি। এক্ষুণি খাম খুলে চিঠি পড়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ অমি অবশ্যি তা করলাম । প্রথম চেকটি দেখলাম, টাকার অঙ্ক ঠিক আছে কিনা। একটি বােনাস পাওনা হয়েছিল। সেই বােনাস দেয়া হয়েছে কিনা। দেয়া হয়েছে। সব ঠিকঠাক আছে। তারপর আমি ত্রিভজ চিহ্নের খাম খুলনাম। এ কী অসম্ভব ব্যাপার! মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। জনাব, আপনাকে অবিলম্বে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সপ্তম শাখায় উপস্থিহতে বলা হচ্ছে। অত্যন্ত জরুরি। 

বিনীত 

এস, মাগুর 

ডিরেক্টর, মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্র-৭ 

নিশ্চয়ই কোথাও কোনাে ভুল হয়েছে। পাঁচ লেগে গেছে। আমার মতাে নগণ্য ব্যক্তিকে মহাশুন্য গবেষণা কেন্দ্র কেন শুধু শুধু ডাকবে? তবে ভুল হােক আর যাই হােক উপস্থিত আমাকে হতেই হবে। কারণ চিঠির উপর সােনালি রঙের ত্রিভুজ আঁকা। একে অগ্রাহ্য করা প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় অপরাধ। আমি ছুটলাম ট্রাভেল এজেন্টের কাছে বিমানের বুকিং-এর ব্যাপার আছে। কিভাবে গবেষণা কেন্দ্র-৭ এ যেতে হয় তাও জানি না। 

ট্রাভেল এজেন্টের সুন্দরী তরুণী যেন আমাকে অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলল, আগামী দু মাসের ভেতর কোনো বুকিং দেয়া যাবে না। আমি ত্রিভুজ আঁকা চিঠি তার হাতে দিতেই সে গম্ভীর মুখে বলল, ‘মিনিট দশেক অপেক্ষা করুন। দেখি কি করা যায়। | দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল না। সাত মিনিটের মাথায় সে বলল, আপনাকে একটি জরুরি বুকিং দেয়া হয়েছে। আজ রাত ন’টা কুড়ি মিনিটে আপনার ফ্লাইট। নটার সময় চলে আসবেন। কাগজপত্র রেডি করে রাখব। আপনার ভ্রমণ শুভ হােক, সুন্দর হােক।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১)

 আমি মুখ শুকনাে করে এ্যাপার্টমেন্টে চলে এলাম। রাত নটা বাজতে এখনাে পাঁচ ঘণ্টা দেরি। এই পাঁচ ঘণ্টা কাজে লাগানাে যায়। আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। এ কী সমস্যায় পড়লাম । একদল লােক আছে, দেশ-বিদেশ ঘুরতে যাদের ভালাে লাগে আমি সে-রকম না। কাজ শেষ করে নিজের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে টিভি সেট খুলে বসাতেই আমাআনন্দ। রান্নাবান্না করাতেও আমার কিছু শখ অাছে। আমার লাইব্রেরিতে বেশ কিছু রান্নার বই আছে। বইপত্র দেখে সপ্তাহে একদিন একটা নতুন রান্না করি। সেদিন নিকিকে আসতে বলি। সব দিন সে আসতে পারে 

। সে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। অকসর তার খুবই কম। সেই অবসরগুলির বেশির ভাগই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার দখল করে রাখে। এখানে ওখানে নিকিকে নিয়ে যায়। সুযােগ পেলেই গায়ে হাত দিতে চায়। নিকি 

সব সহ্য করে। কারণ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের চাকরিটা সে ছাড়তে চায় না। বোনাস-টোনাস মিলিয়ে এই চাকরিটা ভালােই। ওভারটাইম আছে। ওভারটাইমের পয়সাও ভালাে। নিকি টাকা জমাচ্ছে । আমি নিজেও জমাচ্ছিআমরা বিয়ে করতে চাই। বিয়ের জন্যে যে বিশাল অঙ্কের লাইসেন্স ফি দরকার, তা আমাদের নেই। কষ্ট করে টাকা জমানাের এই হচ্ছে রহস্য। 

আমরা ঠিক করে রেখেছি বিয়ের পর দু কামরার একটা এ্যাপার্টমেন্ট নেব। দু’জনে খুব কষ্ট করে হলেও টাকা জমাৰ। সেই টাকায় প্রতি বছর ভ্রমণপাস কিনব।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *