নিকি নতুন নতুন জায়গায় যেতে খুব ভালােবাসে। আমার এত শখ নেই,
তবু নিকির আনন্দেই আমার আনন্দ। | টেলিফোন করতেই নিকিকে পাওয়া গেল। তার গলার স্বরে ক্লান্তি ঝরে পড়ছে। যেন আঁ-না বলতেও তার কষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম, নিকি তুমি কী করছ ?
‘কিছু করছি না। বসে বসে হাই তুলছি। এত ক্লান্ত যে মনে হচ্ছে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ব।
তুমি কি একটু আসতে পারবে? ‘কেন ? ‘আমি একটা ঝামেলায় পড়েছি। নিকির গলার স্বর থেকে ক্লান্তি মুছে গেল । সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে?
আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না।’ ‘এক্ষুণি আসছি।
এই হচ্ছে নিকি। তার যত কাজই থাকুক, যত ঝামেলাই থাকুক, আমার কোনাে সমস্যা হয়েছে শুনলে ছুটে আসবে। বাস বা ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করবে না। সাবওয়েতে লাইনে দাঁড়াবে না। ট্যাক্সি ভাড়া করবে, যাতে সবচেয়ে কম সময়ে উপস্থিত হওয়া যায়। | নিকি ঠিক রূপবতী নয়। তার ঠোট মােটা, চোখ ছােট ছােট । হাতের খাবা পুরুষদের মতো বিশাল। তবু তার দিকে তাকালেই আমার মন অন্য রকম হয়ে যায়। তাকে মনে হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে । যার পাশে বসে একটি
জীবন অনায়াসে পার করে দেয়া যায়। | নিকি আধ ঘণ্টার মধ্যে উপস্থিত হল। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ইউনিফর্ম পর্যন্ত ছুড়ে নি। চলে এসেছে।
কী হয়েছে?‘ ‘বস। স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস নিতে শুরু কর, তারপর বলছি। ‘এক্ষুণি বল।
আমি ত্রিভুজ আঁকা চিঠিটি দিলাম। নিকি নিজেও কিছু বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, ‘তােমাকে এই চিঠি দিচ্ছে কেন?
‘আমি জানি না। বড় ভয় লাগছে।
‘ভয়ের কী আছে? তুমি তাে কোনাে অন্যায় কর নি। হয়তাে তারা তোমাকে কোনাে কাজ দিতে চায়।’
‘আমাকে কাজ দেবে কেন ? ওদের কাজের আমি জানি কী ?
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
আমি লক্ষ করলাম নিকি নিজেও ভয় পাচ্ছে। ভয় পেলে নিকির খুব নাক ঘামে। এবং সে রুমাল দিয়ে একটু পরপর নাক ঘষতে থাকে। এখনো সে তাই করছে। আমি নরম গলায় বললাম, “চল যাই, বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। আমার হাতে সময় বেশি নেই।’
নিকি হঁা-না কিছু বলল না। আমি বললাম, “শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছি, আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে। সপ্তম কেন্দ্রে পৌছানমাত্র ভুল ধরা পড়বে।
আমরা দামি একটা রেস্তোরায় খাবার খেলাম। নেকগুলি টাকা বেরিয়ে গেল। এত দামি দামি খাবার, অথচ কোনােটাই ভালাে লাগছে না। নিকি মন খারাপ করে খাবারদাবার নাড়াচাড়া করছে। আমি আবার বললাম, কোথাও একটা ভুল হয়েছে। তুমি দুশ্চিন্তা করবে না। সপ্তম কেন্দ্রে পৌছেই তােমার সঙ্গে আমি কথা বলব।’
নিকি এই কথারও জবাব দিল না ।
সপ্তম কেন্দ্রে পৌঁছে আমি নিকির সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারলাম না। আমাকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হল এস, মাধুরের কামরায় ।
কামরাটি বিশাল। দিনের বেলাতেও বড় একটা ডিমলাইট জ্বলছে। দরজা জানালা বন্ধ। ঘরটা অন্য সব ঘরের চেয়ে ঠাণ্ডী। আমার শীত শীত করতে লাগল। এস, মাথুর মানুষটি বৃদ্ধ। মাথায় কোনাে চুল নেই। শুধু মাথা নয়, ভুরুতেও চুল নেই। গোলাকার মুখ কুৎসিত দেখাচ্ছে । কিন্তু গলার স্বর আশ্চর্য রকম সতেজ। তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, আপনি বসুন।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
আমি বসলাম । ক্ষীণ স্বরে বললাম, আমাকে কেন ডাকা হয়েছে বুঝতে পারছি ।
এস, মধুর কিশােরদের মত সতেজ গলায় বললেন, মহাশূন্য গবেষণা প্রকল্প থেকে প্রতি ছ’ বছর পরপর একটি বিশেষ ধরনের মহাকাশযান পাঠানাে হয়, তা কি আপনি জানেন ?
‘জি না।’
‘সাধারণ মহাকাশযানের গতিপথ সৌরমণ্ডলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই বিশেষ মহাকাশযানগুলি হাইপারভাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন। হাইপারভাইভ কী, আপনি জানেন ?
‘জি না।‘
‘সময় সংকোচক ডাইভ। আরাে সহজ করে বলি। ধরুন আপনি একটি মহাকাশযানে করে যাচ্ছেন । মহাকাশযানটির গতিবেগ আলাের গতিবেগের
কাছাকাছি। এই ক্ষেত্রে ১০ আলােকবর্ষ দূরের কোনাে জায়গায় যেতে আপনার সময় লাগবে দশ বছর। কিন্তু এই দূরত্ব হাইপার স্পেস ডাইভের কল্যাণে আপনি এক মাইক্রো সেকেন্ডে অতিক্রম করতে পারবেন। হাইপার স্পেস ডাইভের কল্যাণে আমরা আজ অকল্পনীয় দূরত্বে পৌছতে পারছি।
‘আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন বুঝতে পারছি না।’
হাইপার স্পেস ডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মহাকাশযান খুব শিগগিরই রওনা হচ্ছে। ঐ মহাকাশযানে সাতজন ক্রু আছে। এরা সবাই একেকটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়াও আছে চারছি পি এস ফোর রেটি। পি এস রােবট হচ্ছে রােবটটিকস এর বিস্ময়। টেনার জাংশানে মুক্ত কপােট্রনের রােবট।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন।
আপনাকে এত কিছু বলছি, কারণ ঐ মহাকাশযানের আপনিও একজন যাত্রী।’
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’
বড় ধরনের এক্সপিডিশনগুলিতে আমরা নিয়মিত ক্রুদের সঙ্গে অনিয়মিত একজনকে ঢুকিয়ে দিই। খুবই সাধারণ একজন। যার কোনাে রকম টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। সে চলে তার সহজাত বুদ্ধিতে। কোনাে বড় ধরনের সমস্যা সে তার নিজের মতাে করে সমাধান করতে চায়। আমরা দেখেছি শতকরা সাতানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে এই জাতীয় সহজ সমাধানই একমাত্র সমাধান। বিশেষজ্ঞরা বা অতি উন্নত রােবটরা সহজ সমাধান চট করে ধরতে পারে না।
‘কোনাে রকম সমস্যা সমাধান করবার ক্ষমতা আমার নেই। আমি খুবই নগণ্য ব্যক্তি।