অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

‘যে সময় ঐ প্রােগ্রামটি চলত তখন মাত্র নয় দশমিক এক ভাগ লােক ঐ প্রোগাম দেখত। চল্লিশ দশমিক দুই ভাগ লােক কোনো প্রােগ্রামই দেখত না।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

বাকিরা দেখত অন্য চ্যানেলের প্রােগ্রাম, ঠিক না ?’ 

হ্যা, ঠিক। ‘অথচ আপনি যাদের বাসায় টেলিফোন করতেন তারা সবাই ঐ প্রােগ্রামটি দেখত। আপনি জেনেশুনে টেলিফোন করতেন না। এমনিতেই করতেন। কিন্তু দেখা যেত এ বাসায় কেউ না কেউ চ্যানেল থ্রির প্রােগ্রামটি দেখছে। খুব উঁচু ধরনের ইএসপি ক্ষমতা না থাকলে তা সম্ভব নয়। তাছাড়া...

তাছাড়া কী?’ 

“আপনাকে নিয়ে পাঁচটি জেনার টেস্ট করা হয়েছে। প্রতিটি টেস্টে আপনি এক শ’ নম্বর স্কোর করেছেন, যা অকল্পনীয় একটা ব্যাপার। 

আমার ইএসপি ক্ষমতা কী কাজে লাগবে? ‘হয়তো কোনােই কাজে লাগবে না, তবে মহাকাশযাত্রা, বিশেষ করে নিজেদের গ্যালাক্সি ছেড়ে অন্য একটি গ্যালাক্সিতে পা দেয়ার মতাে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে আপনার মতাে ইএসপি ক্ষমতাধর কাউকে দরকার।’ 

আমার ইচ্ছা করছিল আচমকা লােকটির গালে একটা চড় বসিয়ে দিই। বহু কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করলাম। কী লাভ? কী হবে হৈচৈ করে ? কিছুই হবে না। যথাসময়ে আমাকে যাত্রা করতে হবে। যেতে হবে সবকিছু পেছনে ফেলে। এই পৃথিবীকে আমার কখনাে অসাধারণ কিছু বলে মনে হয় নি, তবু পৃথিবীর জন্যে মায়া লাগছে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

আমাদের এই মিশনটির একটি নাম আছে বগ মিশন। মহাকাশযানের 

অধিনায়ক জন বরগের নাম অনুসারে মিশনের নাম। | আমি ভেবেছিলাম জন বরগ লােকটি অসাধারণ কেউ হবেন। হয়তাে তিনি অসাধারণ। কিন্তু আমার কাছে প্রথম দর্শনে তাঁকে খুব অসাধারণ মনে হল না। রোগী লম্বা একজন মানুষ। বেশিক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না কিংবা কথা বলেন না। চোখ নামিয়ে নেন। মেয়েদের মতাে পাতলা ঠোট। ঠোট টিপে হাসার অভ্যাস আছে। খুব জরুরি ধরনের কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ তাঁর দিকে তাকালে দেখা যাবে তিনি মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসছেন। যেন কথাবার্তা কিছু শুনছেন না, অন্য কিছু ভাবছেন। | সাতজন ক্রু মেম্বারদের মধ্যে অধিনায়ক জন বরগকেই আমার কাছে মনে হল সবচেয়ে সাধারণ! প্রথম দর্শনে মানুষের ওপর প্রভাব ফেলার কোনাে ক্ষমতা এই মানুষটির নেই। 

তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হবার কথা বলি। মহাকাশযান পৃখিবীর মহাকর্ষণ অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো পৃথিবী দেখার জন্যে সবাই ভিড় করেছে অবজারভেশন প্যানেলে। আমি শুধু নেই । ফেলে-আসা পৃথিবীর জন্যে আমি কোনাে রকম আকর্ষণ বােধ করছি না। নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। আমি বললাম, কে?’ নরম গলায় উত্তর এল, আমার নাম জন বরগ। 

আমি দরজা খুললাম। জন বরগ হাসিমুখে বললেন, ‘সবাই শেষ বারের মতাে পৃথিবী দেখছে। আপনি দেখছেন না ? 

ইচ্ছা করছে না।’ 

‘চমৎকার ! আমারাে ইচ্ছা করছে না। এবং আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? আমার মনে হচ্ছে আমরা আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসব।’ 

‘ামার এরকম কিছু মনে হচ্ছে না।’ 

আপনার কী রকম মনে হচ্ছে ? ‘কোনাে রকমই মনে হচ্ছে না। 

জন বরগ হাসিমুখে বললেন, আপনার কথা শুনে ভরসা পাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম বলে বসবেন, আমরা আর পৃথিবীতে ফিরে আসব না।’ 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি এ রকম বললে অসুবিধা কী ? 

আপনি হচ্ছেন একজন ইএসপি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আপনি না-সূচক কিছু বললে একটু খটকা তাে লাগবেই,‘ 

আমি জুন বরগের দিকে তাকালাম। তিনি নিচু অথচ স্পষ্ট স্বরে বললেন, ইএসপি ক্ষমতাটমতা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। যে-জিনিস আমি বুঝতে পারি ,

সে-জিনিসের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। কাজেই আপনার এই ক্ষমতা আমি কখনাে ব্যবহার করব না। আপনি হয়তাে জানেন না মহাকাশযানের অধিনায়ক হচ্ছেন দ্বিতীয় ঈশ্বর। সব কিছুই চলে তার হুকুমে।’ | আমি সহজ গলায় বললাম, “মহাকাশযানের অধিনায়ক যদি দ্বিতীয় ঈশ্বর হন, তাহলে প্রথম ঈশ্নর কে?’ 

‘প্রথম ঈশ্বর বলে কেউ নেই। এটা হচ্ছে কথার কথা। 

এই বলেই জুন বরগ মৃদু হাসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে আবার ঠোট টিপে মৃদু গলায় বললেন, ‘যাই, কেমন ? আমি কিছু বললাম না। জন বরগ লোকটিকে যতটা সাধারণ মনে হয়েছিল, ততটা সাধারণ সে নয়। আমার ঘরে তার আসার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল আমাকে জানিয়ে দেয়া যে, সে আমার ক্ষমতার ধার ধারে না। এটা সে জানিয়েছে চমৎকার ভঙ্গিতে। বরগ মিশনের বাকি দু’জন কর্মীর সঙ্গে প্রথম বাহালুর ঘণ্টায় আমার কোনাে রকম কথাবার্তা হল না। আমি নিজের ঘর থেকে বেরুলাম না। বেরুবার মতো তেমন কোনাে কারণও ঘটল না। খাবার আসে ঘরে। তিশ-২ নামের একজন রােবট খাবার দিয়ে যায়, নিয়ে যায়। 

আমি প্রায় সারাক্ষণই শুয়ে থাকি। মহাকাশযানের উড়ে চলার ধাতব শব্দ শুনি। লক্ষ কোটি ঝিঝি পোকার শব্দ। সে শব্দ বাড়ে এবং কমে। আমি কিছুই করি 

শুয়ে থাকি। আমাকে বলা হয়েছে এই মহাকাশযানে সময় কাটানাের চমৎকার সব ব্যবস্থা আছে। এদের লাইব্রেরি পৃথিবীর যে কোনাে বড় লাইব্রেরির মতােই। দুর্লভ সব সংগ্রহ এখানে আছে । ভিডিও সংগ্রহশালাটিও নাকি অসাধারণ। বিশেষ করে মানুষের মহাকাশযাত্রার ইতিহাস বিভাগ । প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে ফিল্মও এখানে আছে । প্রজেকশন রুমে বসলেই হল। এখানে আছে সব রকম খেলাধুলার ব্যবস্থা । এমনকি সাঁতারের জন্যে ছােট একটি সুইমিংপুলের মতােও নাকি আছে, যার পানিতে ইলেকট্রিক্যাল চার্জ থাকায় সাতারের ব্যাপারটি হয় স্বর্গীয় আনন্দের মতাে। আয়নিত জলকণা শরীরে ধাক্কা দেয়। প্রচণ্ড শারীরিক সুখের একটা অনুভূতি হয় ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *