অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

অত্যন্ত আনন্দের কথা। এই তরুণীর নাম ইলােনামটিও কি মধুর নয় ? ‘খুবই মধুর। এখন তুমি বিদেয় হওঅনন্ত নক্ষত্র বীথি

বিদেয় হচ্ছি। আমি ক্ষুদ্র একটা অন্যায় করেছি, এটা বলেই বিদায় নেব। অন্যায়টা হচ্ছে আমি ইনােকে বলেছি যে তুমি তার সঙ্গে কথা বলবার জন্যে বেশ আগ্রহী । সাহস সঞ্চয় করতে পারছ না বলে কথা বলতে পারছ না। 

‘এ রকম বলার মানে কী

‘যােগাযােগ করিয়ে দেয়ামেয়েটা খুবই ভালো কথা বললে তােমার চমৎকার লাগবে। ও আবার চমৎকার সির গল্পও জানে। 

“তুমি বিদেয় হও। 

‘হচ্ছি। আমার সঙ্গে এত উঁচু গলায় কথা বলার কিন্তু কোনাে দরকার নেই। একজন রােবটের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলা যা, নিছু গলায় কখা বলাও তা। আমি তাে আর তােমাদের মতাে মানুষ না যে উঁচু গলায় কথা বললে আমার মন খারাপ হবে।’ 

প্রচণ্ড ধমক দিয়ে তিশকে বিদায় করলাম। এবং বলে দিলাম এক্ষণি যেন ইনো নামের মেয়েটিকে সত্যি কথাটা বলে পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী তরুণীর সঙ্গেও আমি কথা বলতে আগ্রহী নই| তিশ আমার সব কথা শােনে না। অনেক কাজ সে তার নিজের লজিক খাটিয়ে করে। কাজেই সে ইনােকে কিছুই বলল নাএবং ইনাে নামের অত্যন্ত রূপবতী ৰালিকা-বালিকা চেহারার মেয়েটি এক সময় আমার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বলল, আসব?’

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

এই জাতীয় একটি মেয়ের মুখের ওপর না’ বলা খুব মুশকিল। আমি হা-না কিছুই বললাম না। | তিশ আমাকে বলল, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান । সাহসের অভাবে বলতে পারছেন না। 

তিশ সত্যি কথা বলে নি। বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। আপনার সঙ্গেই শুধু নয়, কারাে সঙ্গেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। 

‘কেন করে না?’ 

জানি না কেন । মানুষের সঙ্গ আমার কাছে অসহ্য বলে মনে হয়।’ ‘আমার সঙ্গও অসহ্য বােধ হচ্ছে ? 

হ্যা, হচ্ছে।’ সত্যি বলছেন ?’ ‘হা, সত্যি বলছি। আপনি চলে গেলেই আমি খুশি হব‘ 

মেয়েটি চলে গেল নাঘরে ঢুকলচেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আপনি আমাকে তাড়াবার জন্য এইসব বলছেনকিন্তু আমি এত সহজে যাচ্ছি না। আমার বয়স একত্রিশ । গত পঁচিশ বছরের কথা আমার মনে আছে। এই পঁচিশ বছরে কেউ আমাকে বলে নি যে আমার সঙ্গ তার পছন্দ নয়। যদিও আমি অনেকের সঙ্গ পছন্দ করি না। তবে পছন্দ না করলেও কাউকে মুখের ওপর সে-কথা বলতে পারি না। এত সাহস আমার নেই। আমি বােধ হয় একটু বেশি কথা বলছি, তাই না? 

যা ভাই।’ ‘বিশ্বাস করুন আমি এত কথা বলি না। কিন্তু মহাকাশযানে ওঠবার পর থেকে কেন জানি ক্রমাগত কথা বলছি। এটা বােধ হয়, হচ্ছে ভয় পাওয়ার কারণে। ভীত মানুষ দু’ধরনের কাণ্ড করে হয় আমার মতাে বেশি কথা বলে, নয় আপনার মতাে কথা বলা পুরােপুরি বন্ধ করে দেয়। আপনি নিশ্চয়ই আমার মতাে, তাই না? 

না।’ 

বলেন কী ! হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে যাচ্ছেন, এটা ভেবেও কি আপনার ভয় বা রােমাঞ্চ বােধ হচ্ছে না? 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

না, আমি কিছু ভাবি না।’ সে কি ! কেন ? ‘ভাবতে ইচ্ছা করে না।’ 

ইএসপি ক্ষমতাধর সব মানুষই কি আপনার মতাে হয় ? তাও আমি জানি না। এরকম কারাে সঙ্গে আমার এখনাে দেখা হয় নি। 

ইনাে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, এখানে আসার পেছনে আমার অন্য একটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে উদ্দেশাটা বলব। 

 ইনাে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তরল চোখ। কিছু কিছু চোখ আছে তাকালে মনে হয় জল-ভরা চোখ যেন চোখের ভেতরের টলটল জল দেখা যাচ্ছে। | আমি কিছুই বললাম না। ইনে বলল, আমি এসেছি আপনার ইএসপি ক্ষমতা কী রকম তা পরীক্ষা করে দেখতে। ‘আমার কোনাে ক্ষমতা নেই।আপনি অস্বীকার করলে তো হবে না । আমাদের বলা হয়েছে আপনার ক্ষমতা অসাধারণ । প্রতিটি জেনার টেস্টে আপনি একশ’ করে পেয়েছেন। কেউ তা পায় না।‘ 

‘জেনার টেস্টের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। 

‘বেশ, না জানলে ক্ষতি নেই। এখন মন দিয়ে শুনুন আমি কি বলছি। আমার জ্যাকেটের পকেটে এক খণ্ড কাগজে আমি তিন লাইনের একটা কবিতা লিখে এনেছি। কী লিখেছি আপনি কি বলতে পারবেন? 

কাগজটা না দেখে কী করে বলব ? কী লেখা আছে তা জানতে হলে লেখাগুলি আমাকে পড়তে হবে। 

লেখা পড়ে তা যে-কেউ বলতে পারবে। তাহলে আপনার বিশেষ কোথায় ? 

বিশেষতু কিছুই নেই। এখন আপনি যদি দয়া করে উঠে যান এবং আমাকে একা থাকতে দেন তাহলে খুব খুশি হব। 

ইনো উঠে দাড়াল। অপমানে মেয়েটির মুখ কালাে হয়ে গেছে। তার অপমানিত মুখ দেখতে আমার একটু যেন খারাপই লাগছে। সে আমাকে কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। মুখ নামিয়ে নিল । আর ঠিক তখন বিদ্যুৎচমকের মতাে তার জ্যাকেটের পকেটে রাখা কাগজটির লেখাগুলি আমি পড়তে পারলাম। ব্যাপারটা কী করে হল আমি নিজেও জানি না। প্রতিটি লাইন জুলজুল করছে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

“রাত্রি কখনাে সূর্যকে পায় না। 

তাতে ক্ষতি নেই। 

কারণ সে পেয়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি।” একবার ইচ্ছা হল, কাগজটায় কী লেখা ইনােকে বলি। তারপরই ভাবলাম কী দরকার ? কী হবে বলে ? 

ইনো নরম গলায় বলল, আপনি যে সত্যি সত্যি বিরক্ত হচ্ছিলেন তা বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলে আমি এতক্ষণ বসে থাকতাম না। আমি খুবই লজ্জি, আমাকে ক্ষমা করবেন| সে মাথা নিছু করে চলে যাচ্ছে। পা ফেলছে এলােমেলাে গবে। প্রচুর মদ্যপানের পর মানুষ ঠিক এই ভঙ্গিতেই হাঁটে। আমি এত কঠিন না হলেও পারতাম। 

তিশ যখন খাবার নিয়ে এল তখন তাকে বললাম, “তিশ, তুমি জীববিজ্ঞানী ইনােকে একটা কথা বলে আসতে পারবে ? 

তিশ উৎফুল্ল গলায় বলল, অবশ্যই পারব। কী কথা ? | কবিতার তিনটি লাইন—রাত্রি কখনাে সূর্যকে পায় না/তাতে ক্ষতি নেই। কারণ সে পেয়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। 

তিশ অবাক হয়ে বলল, এর মানে তাে কিছু বুঝতে পারছি না। সূর্য যা, নক্ষত্রও তাে তাই। নাম ভিন্ন কিন্তু জিনিস তাে একই। 

‘তােমার বােঝার দরকার নেই। ইনােকে বললেই তিনি বুঝবেন।” 

আর যদি বুঝতে না পারে ? যদি আমাকে বুঝিয়ে দিণ্ঠে বলে, তা হলে তো মুশকিলে পড়ব।’ 

তোমাকে যা করতে বলছি তাই কর।‘ 

‘বেশ, করব। আমাকে শুধু একটা কথা বল—এটা কি কোনাে প্রেম-বিষয়ক কবিতা ? 

‘জানি না।’ “ঠিক আছে আমি যাচ্ছি । প্রেম-বিষয়ক কবিতা বলেই তাে মনে হচ্ছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *