অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ

‘আমরা মহাকাশযানের গতিবেগও কমাতে পারছি না, কারণ এই মুহূর্তে মহাকাশযানের গতিবেগ ০.৬২৬C_আলাের গতিবেগের শতকরা বাষট্টি ভাগেরও বেশি। এই গতিবেগ কমিয়ে শূন্যতে নিয়ে আসতে আমাদের সময় লাগবে ১১২,৭০ ঘন্টা। এত সময় আমাদের হাতে নেই। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ম্যানােফ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, একটি হাইপার স্পেস ডাইভ দিলে কেমন হয় ? ঐ ব্যাপারে কি চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে ? 

‘হঁ্যা, হয়েছে এবং এখনাে হচ্ছে। হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে হলে গতিবেগ ০.৮২০ প্রয়ােজন। সেই গতিবেগ এই মুহুর্তে আমাদের নেই। থাকলেও আমরা হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে পারতাম না, কারণ আমাদের গ্র্যাভিট্রন ফ্লাস্ক কাজ করছে না। 

প্রসঙ্গক্রমে আপনাদের জানিয়ে রাখি যে ১.২৫ অাকর্ষণ শক্তির মধ্যেও হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়া যায় না। হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়ার মুহুর্তে মহাকাশযানকে পুরােপুরি নিরপেক্ষ বলয়ে থাকতে হয়।’

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ 

ম্যানােফ বললেন, আমি তা জানি। পরিস্থিতি আমাকে অন্যভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। আমি জানতে চাচ্ছি আমাদের পরিকল্পনা কী?‘ 

‘কোনাে পরিকল্পনা নেই।’ 

কী অদ্ভুত কথা ! পরিকল্পনা নেই মানে কী? আমরা কিছুই করব না ? 

আমাদের এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে যেসব তথ্য জোগাড় হয়েছে, সেসব পৃথিবীতে পাঠানাে। যাতে পৃথিবীর মানুষ এখানে কী ঘটল তা বুঝতে পারে। এর ফলে তারা ভবিষ্যতের মহাকাশযানগুলিকে এই পরিস্থিতি সামলাবার মতাে করে তৈরি করবে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে পৃথিবীতে তথ্য পাঠানাের ব্যাপারটি আমরা চমৎকারভাবে সম্পন্ন করছি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা করা হবে। 

ইনাে বলল, আমাদের ভবিষাৎ কী ? 

ভবিষ্যতের কথা আমরা বলি না। আমরা বলি বর্তমান। আমাদের বর্তমানটাই বাকী ? ভালাে নয়।’ ভালাে নয় মানে কী? ভালাে নয় মানে খারাপ খুবই খারাপ। উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা কত ? 

আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তার থেকে মনে হয় সম্ভাবনা ০.০৩৭, সম্ভাবনা নেই বলাই ভালাে। 

‘আমি তাকালাম জন বরগের দিকে। জন বরগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকেই দেখছেন। চোখে চোখ পড়ামাত্র তিনি অল্প হাসলেন। তারপর বললেন, একটা কাজ করলে কেমন হয় ? আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, অত্যন্ত দামি একটি শ্যাম্পেনের বােতল এই মহাকাশযানে আছে। বােতলটি নেয়া হয়েছিল অন্য গ্যালাক্সিতে পদার্পণের উৎসব উদ্যাপনের অংশ হিসেৰে । এখন দেখতে পাচ্ছি সেই সম্ভাবনা ৫,০৩৭; কাজেই আমি প্রস্তাব করছি, বােতলটি এখনি খােলা থােক। কারাে আপত্তি থাকলে হাত তুলে জানাতে পারেন।‘ 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ 

কেউ হাত তুলল না। তেমন কোনাে বাড়তি উৎসাহও কারাে মধ্যে লক্ষ করলাম না। সবাই গ্লাস হাতে নিল মােটামুটি যন্ত্রের মতাে। যেন নিয়ম রক্ষা করছে। মিশন-প্রধানের হুকুম পালন করছে। 

জুন বরগ গ্লাস হাতে উঠে দাড়ালেন এবং মােটামুটি নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, “আপনারা বােধ হয় জানেন না, একজন অসাধারণ ইএসপি ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ আমাদের মধ্যে আছেন, যিনি এই মহাবিপদের কথা প্রায় ছেষট্টি মিনিট আগে টের পেয়েছিলেন। আমি তখন তার কথায় তেমন গুরুত্ব দিই নি। এখন দিচ্ছি । এখন আমি তার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছি, আমাদের ভবিষ্যৎ কী ? তার ইএসপি ক্ষমতা কী বলছে?” 

আমি উত্তর দেবার আগেই তিন নম্বর লালবাতি জ্বলে উঠল । চরম বিপর্যয়ের শেষ সংকেত। তার পরপরই মহাকাশযানের কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম স্তরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হল। এর মধ্যেই আমি মিশন-প্রধান জন বরগের গলা শুনলাম, আসুন আমরা এই বিপর্যয়ের নামে মদ্যপান করি। | তার কথা শেষ হল না, তৃতীয় স্তরে আরেকটি বিস্ফোরণ হল। আগুনের নীল শিখা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের গ্রাস করল। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ 

এর পরের কথা আমার আর কিছু মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। 

অন্ধকার। 

গাঢ় অন্ধকার। 

আলাে ও শব্দহীন অনন্ত সময়ের জগৎ। আমার কোনাে রকম বােধ নেই। বেঁচে আছি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। এটা কি মৃত্যুর পূরের কোনাে জগৎ ? অন্য কোনাে জীবন? আমার মধ্যে সর্বশেষ স্মৃতি যা আছে, তা হচ্ছে একটি বিভীষিকার স্মৃতি। চারদিকে লেলিহান শিখা। গ্যালাক্সি-টু নামের অসাধারণ মহাকাশযানটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সব স্মৃতি তো এইখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার পরেও মনে হচ্ছে চেতনা বলে একটা কিছু এখনাে আমার মধ্যে আছে। সব শেষ হয় নি, কিংবা শেষের পরেও কিছু আছে।

আমি চিৎকার করতে চাই, কোনাে শব্দ হয় না। হাতপা নাড়তে গিয়ে মনে হয় আমার হাতপা বলে কিছু নেই। চারদিকে সীমাহীন শূন্যতা। আমার চেতনা শুধু আছে, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তা কী করে হয়! অন্ধ ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমি প্রাণপণ শক্তিতে চিঙ্কার করতে যাই, তখন মনে হয় কেউ একজন যেন আমাকে ভরসা দেয়। আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাই না, উপস্থিতি বুঝতে 

পারি না কিন্তু তবুও মনে হয় কেউ একজন পরম মমতায় আমাকে লক্ষ করছে। বলছে, ধৈর্য ধর। সহ্য কর । আমি আছি। আমি পাশেই আছি।’ 

‘কে, তুমি কে’। 

ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও। ‘আমি কি জীবিত না মৃত ? 

সহ্য কর।’ 

“কী সহ্য করব আমার তাে কোনাে শারীরিক কষ্ট হচ্ছে না। শরীর বলে কি আমার কিছু নেই ? 

ঘুমিয়ে পড়। ঘুমিয়ে পড়। ‘ঘুমিয়ে পড়তে বলছ কেন আমি কি জেগে আছি।’ ‘ঘুমিয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড়। দীর্ঘ ঘুম । নিরবচ্ছিন্ন ঘুম। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ 

তুমি কে 

আমি কোনো জৰাৰ পাই না। তখন মনে হয় সমস্তটাই কি কল্পনা। তাইবা হবে কী করে। আমি কল্পনা করছি কীভাবে। একজন মৃত মানুষ কি কল্পনা করতে পারে কীভাবে করে। কল্পনা ছাড়া সে কি অন্য কিছু করতে পারে না। আমার বাকি জীবন কি কল্পনা করে করেই কাটবে। অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বছর ধরে আমার কাজ হবে শুধু কল্পনা করানাে। অনন্ত মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ানাে। আমি কি তাই করছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি মহাশূন্যে। 

কোনো কূল-কিনারা পাই না। এক সময় যে-চেতনা অবশিষ্ট আছে, তাও লােপ পায়। গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ি। আমার মনে হয় অনন্তকাল কেটে যায় ঘুমের মধ্যে। আবার ঘুম ভাঙে। আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কে ? কোনাে শব্দ হয় না । চারদিকে দেখি, ঘন অন্ধকার। ক্ষীণ স্বরে বলি, আমি কোথায় ? 

আবার আগের মতাে কেউ আমাকে ভরসা দেয়। তার কথা শুনতে পাই না। তাকে দেখতে পাই না, কিন্তু অনুভব করি, সে বলছে, ভয় নেই। কোনাে ভয় নেই।’ 

কে তুমি কে ? ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও। আমরা তােমার পাশেই আছি।’ তােমরা কারা? সময় হলেই জানবে।’ ‘কখন সময় হবে?’ 

হবে, শিগগিরই হবে। ঘুম এবং জাগরণের আরাে কয়েকটি চক্র পার হতে হবে।“আমার সঙ্গীরা কোথায়?’ 

এর কোনাে জবাব পাওয়া যায় না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *