অন্যদিন -পর্ব -৪- হুমায়ুন আহমেদ

অন্যদিন পর্ব -৪

শীতের শুরুতে বাবা এসে হাজির।

খোঁচা খোঁচা দাড়ি সারা মুখে। গায়ে একটা ময়লা কোট। স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে গেছে। চেনা যায় না এমন।

মায়ের চিঠিতে স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা যে এতটা কল্পনাও করিনি। নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে গিয়ে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে!

ও রঞ্জু কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখলাম।

আমি অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলাম না। বার বার মনে হল বাবার মাথার দোষটা হয়তো সেরে গেছে। না। সারলে এত দূরে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এলেন কী করে? তবু সন্দেহ যায় না। বার বার জিজ্ঞেস করি, মাকে বলে এসেছেন তো বাবা? না বলে আসিনি তো?

বাবা পরিষ্কার কোন উত্তর দেন না। একবার বলেন, হ্যাঁ বলেছি তো। আবার বলেন, বলব কি করে? তোর মা কথা বলে না। আমার সঙ্গে। ভাত খাওয়ার সময় আমি সামনে থাকলেও বলে, পারুল তোর বাবাকে খেতে বল।

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাবাকে লক্ষ্য করি। কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক। আমার পরীক্ষা কবে, পড়াশুনা কি রকম করছি, এইসব খুব আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করলেন।

রাতে হোটেলে ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। সারাপথ গল্প করতে করতে চললেন। এখন আর গল্পের ধরন সে রকম স্বাভাবিক মনে হল না। যেন নিজের মনেই কথা বলছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ির সবাই ভাল আছেন। বাবা? বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ সবাই ভাল। স্টেশন মাস্টারের ছোট ছেলেটার হুঁপিং কফ হয়েছে।

পারুল, পারুল কেমন আছে? তার পরীক্ষা কবে?

জানি না তো। ভাল আছে নিশ্চয়ই।

আমি অবাক হয়ে বলি, পারুল কেমন আছে জানেন না বাবা? কী বলছেন এসব?

কী করে জানব, বোকার মত কথা বলিস? পারুলের বিয়ে হয়ে গেছে না?

আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকি। এসব কী শুনছি?

কী বলছেন। আপনি? কিসের বিয়ে?

গত শুক্রবার পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। তোর মার এমন ভ্যাজর ভ্যাজার–পুলিশে খবর দাও, পুলিশে খবর দাও। মেয়েছেলেদের বুদ্ধি তো।

আমি বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। ভাবতেও পারছিলাম না তারা আমাকে একটা খবর জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করল না।

ছেলেটা ভাল। বেশ ভাল। পারুলকে নেত্রকোনায় নিয়ে গেছে। আমি ওদের কেন সঙ্গে গৌরীপুর পর্যন্ত গেলাম। আমার টিকিট লাগে না। ট্রেনের চেকাররা সবাই আমাকে চিনে। খুব খাতির করে।

বাবার কথাবার্তা শুনে চোখে পানি এসে গেল আমার। পারুলের মত মেয়ে এই করবে? পনের বছর যার বয়স! খবর দিলেন না কেন বাবা? একটা টেলিগ্রাম তো করতে পারতেন।

বাবা শান্ত স্বরে বললেন, তোর মা বলল, টেলিগ্রাম করলে শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা হবে। আমি চিঠি লিখব। মেয়ে মানুষের এরচে বেশি বুদ্ধি কী হবে? হলে তো আর মেয়েছেলে থাকত না। পুরুষই হয়ে যেত।

মায়ের চিঠি পৌঁছবার আগেই পারুলের চিঠি এল। নেত্রকোনা থেকে লিখেছে। লম্বা চিঠি। কিন্তু কোথাও নিজের বিয়ের কথা কিছু নেই। একবারও লিখেনি যে সে একটা ভুল করে ফেলেছে। তার দীর্ঘ চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে, বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। মামারা টাকা পয়সা দেয়া বন্ধ করেছেন। আমি যেন যে ভাবেই হোক প্রতি মাসে মাকে টাকা পাঠাই। প্রয়োজন হলে কলেজ ছেড়ে দিয়েও যেন একটা চাকরি জোগাড় করি। বড় ডাক্তার দেখিয়ে যেন অতি অবশ্যি বাবার ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে লেখা, দাদা দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকে আমার ওপর রাগ হলেও— সেদিন আর রাগ থাকবে না।

মায়ের চিঠিটি পাঁচ পাতার। ব্যাপারটি কি ভাবে ঘটল তা নিখুঁতভাবে লেখা। বৃহস্পতিবার সারাদিন পারুল নাকি শুয়ে শুয়ে কেন্দেছে। মাকে বলেছে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। শুক্রবার সকালে পরিষ্কার দেখে একটা শাড়ি পরে অঞ্জকে পুকুর ঘাটে নিয়ে একটি টাকা দিয়ে বলেছে ইচ্ছেমত খরচ করতে। মা একবার খুব ধমক দিলেন। পরিষ্কার শাড়িটা নষ্ট করছে সেই জন্যে। পারুল কিছু বলে নাই। দুপুরে খাওয়ার পর মাকে গিয়ে বলেছে, মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে বডড মাথা ধরেছে। মা ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। তারপর বিকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন পারুল ঘরে নেই …

সফিক সব কিছু শুনে বলল, তোর বোনটার তাহলে বুদ্ধি আছে দেখি?

বুদ্ধির কী আছে। এর মধ্যে?

বিয়ে করে নিজে বেঁচেছে তোদেরও রিলিফ দিয়েছে।

পরীক্ষণেই সে পারুল প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, প্রতি মাসে তোর মাকে টাকা পাঠাতে হবে। এইটি খুবই জরুরি। আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথেকে পাঠাব? টাকা কোথায়?

সবাই মিলে একটা চায়ের সন্টল দিয়ে ফেলি। আয়। খোঁজ নিয়েছি ভাল লাভ হবে। ম্যানেজার করে দেব নিশানাথকে। নিশানাথের দাড়ি গোফ দেখেই দেখবি হুঁড় হুঁড় করে কাস্টমার আসবে। চা বানিয়ে কুল পাওয়া যাবে না।

বলে কী সফিক। নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব চায়ের দোকান দেবে? সফিককে দেখে মনে হল তার মাথার প্ল্যান খুব পাকা।

কাটা কাপড়ের ব্যবসাটা মাঠে মারা গেছে। ভাত খাওয়ার পয়সা নাই লোকে কাপড় কিনবে কী?

আমি বললাম, জ্যোতির্ষিণব বুঝি চায়ের দোকান খুলবে তোর সাথে?

না খুলে যাবে কোথায়? একটা লোক আসে না তার কাছে। ব্যাটার এখন ধূপ কেনার পয়সা নাই। সফিক ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। যেন খুব একটা হাসির ব্যাপার হয়ে গেছে। জ্যোতির্ষিণবের এমন দুর্দিন যায়নি কখনো। সঞ্চয় যা ছিল উড়ে গেছে। সখের টেবিল ফ্যানটি বিক্রি করেছেন করিম সাহেবের কাছে। আমাকে গম্ভীর হয়ে বললেন, সাধু সন্ন্যাসী মানুষদের জন্যে এই সব কিছু দরকার নাই। আমাদের কাছে হিমালয়ের গুহাও যা আবার সাহারা মরুভূমিও তা, ফ্যানের কোন প্রয়োজন নাই।

মিল চার্জ বাকি পড়ায় গত শনিবার থেকে খাওয়া বন্ধ। পরশু দুপুবে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি একটা শুকনো পাউরুটি চিবোচ্ছেন। আমাকে দেখে দারুণ লজ্জা পেয়ে গেলেন। কান টান লাল করে বললেন, আমিষ বর্জন করলাম, রঞ্জু। জ্যোতিষ শাস্ত্রের মত গূঢ় বিদ্যার চর্চা করলে মাছ মাংস সমস্ত বর্জন করতে হয়। আমার ঠাকুর দা শ্ৰী শ্ৰী তারানাথত চক্রবতী সমস্ত দিনে এক মুঠি আলো চালের ভাত আর একবাটি দুধ খেতেন। কি বিশ্বাস হয়? আমিষ একবার বর্জন করে দেখ শরীর ঝর ঝরে হয়ে যাবে।

রশীদ মিয়া উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। নিশানাথ বাবুর নাকি তিন মাসের সিট রেন্ট বাকি। জ্যোতির্ষিণব শুনলাম অতি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলছেন, আর একটি মাস রশীদ মিয়া। এর মধ্যেই আমার মঙ্গল হোরায় প্রবেশ করবে। রবির ক্ষেত্র আবার…

আরে রাখেন। সাহেব মঙ্গল আর রবি। পনেরো দিন সময়। এর মধ্যে পারেন দিবেন না পারেন বিসমিল্লাহ বিদায়। তিন মাসের সিট রেন্ট আপনার দেওয়া লাগবে না।

জ্যোতির্ষিণবের এমন খারাপ সময় যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করা যারে না। দান এবং ঋণ গ্রহণ, এই দুই জিনিস নাকি তার জন্যে নিষিদ্ধ। সফিক সবার সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলা দৈনিক সব কটিতে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিল। একদিন পর পর সে বিজ্ঞাপন ছাপা হল এক সপ্তাহ পর্যন্ত।

‘পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত জ্যোতিষ–শ্ৰী নিশানাথ চক্রবর্তী, জ্যোতির্ষিণব। এম. এ. (ফলিত গণিত) বহু রাজা মহারাজার প্রশংসাপত্র আছে। আসুন পরীক্ষা করুন। দর্শনী নামমাত্র।’

নিশানাথ বাবু বিজ্ঞাপন দেখে খুবই রেগে গেলেন। সফিককে গিয়ে বললেন, এম. এ. (ফলিত গণিত) এটা কোথায় পেলে? মিথ্যাচার করা হল। উফ কী তঞ্চকতা।

সফিক বলল, সবটাই তো তঞ্চকতা নিশানাথ বাবু। সবটাই যখন মিথ্যার ওপর কাজেই মিথ্যাটাকে আরেকটু বাড়ানো হল।

হাজার বৎসরের পণ্ডিতের সাধনালব্ধ জ্ঞান সবই মিথ্যা?

নিতান্ত মূঢ়ের মত কথাবার্তা। জ্ঞানহীন মুখের বাচালতা।

হিম কুন্দ মৃণালাভং দৈত্যাং পরং গুরু, সৰ্ব্ব শাস্ত্র প্রবক্তা ভার্গবং।

অংবং করে লাভ কিছু নাই নিশানাথ বাবু। এসব এখন ছাড়ার সময় এসে পড়েছে।

এত করেও নিশানাথ বাবুর অবস্থা ফেরানো গেল না। ঢাকা শহরের সব লোক হঠাৎ হাত দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে কী না কে জানে। এমন খারাপ অবস্থা হবে জ্যোতির্ষাণবের স্বপ্নেও ভাবিনি। একদিন অনেক ভনিতা করে সফিককে বললেন, আমার একটা ভাল ঘড়ি আছে। এক ভক্ত দিয়েছিল। শুধু শুধু পড়ে আছে কোন কাজে লাগে না।

কাজে লাগে না কেন?

এই সব কলকব্জার ঘড়িতে কী আমাদের হয়? আমাদের দরকার বালি ঘড়ি কিংবা সূর্যঘড়ি। সেই সব ঘড়িতে পল অনুপল এই সব হিসাবও সূক্ষ্ম ভাবে করা যায়। পল বুঝা তো? পল হচ্ছে এক দণ্ডের ষাট ভাগের এক ভাগ।

সফিক নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। জ্যোতির্ষিণব হাসি মুখে বলে চলেন– তাই ভাবলাম কাজে যখন লাগে না তখন আর ঘড়ি রেখে লাভ কী? রোজ চাবি দেয়া যন্ত্রণার এক শেষ। সফিক তুমি ঘড়িটা নিয়ে বিক্রি করে ফেল। সফিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

বিক্রি করে ফেলব?

হ্যাঁ। সাধু সন্ন্যাসী মানুষ আমি, এই সব বিলাস সামগ্ৰী দুই চোখে দেখতে পারি না। তান্ত্রিক সাধনাতে মোহ মুক্তির প্রয়োজন সবচে বেশি। তোমরা এই সব বুঝবে না। বিষয়ী লোকদের বোঝা খুব মুশকিল।

জ্যোতির্ষিণব পকেট থেকে ভেলভেটের বাক্সে সযত্নে রাখা হাত ঘড়িটি বের করে টেবিলে রেখেই দ্রুত চলে গেলেন। বেশ ভাল ঘড়ি সেটি। সফিক ঘড়ির বাক্স হাতে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, ব্যাটার তো খুবই খারাপ অবস্থা রঞ্জু। ঘড়িটা তার খুব সখের। সফিক চিন্তিত মুখে ঘড়ি হাতে বেরিয়ে গেল।

জ্যোতির্ষিণবের ভাগ্য বদলাল দুপুরের একটু পর। সম্ভবত মঙ্গল হোরায় প্রবেশ করেছে, রবির ক্ষেত্র আবার ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম প্রকাণ্ড একটি সাদা রঙের গাড়ি এসে থামল পান্থনিবাসের সামনে। গাঢ় নীল রঙ্গের শাড়ি পরা একটি মেয়ে সেই গাড়ি থেকে নেমে সোজা উঠে এসেছে পান্থনিবাসের দোতলায়। সাধুজী নিশানাথ জ্যোতির্ষিণবের খোঁজ করছে সেই মেয়ে। আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। রশীদ মিয়া পর্যন্ত একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল। অনেকদিন পর জ্যোতির্ষিণবের ভারী গলা পাওয়া গেল, অতি সুলক্ষণা মেয়ে মা তুমি, অতি সুলক্ষণা। চন্দ্র ও রবির মিলিত প্রভাব, কেতুর মঙ্গলে অবস্থান। এরকম হয় না, খুব কম দেখা যায়। হুঁ হুঁ। বিদ্যা ও ধান। লক্ষ্মী-স্বরস্বতী এক মালায় গাঁথা। বড় ভাগ্যবতী তুমি।

যাবার সময় সেই মেয়ে একশ টাকার দুটি নোট দিয়ে জ্যোতির্ষাণবের কণ্ঠরোধ করে দিল। নিশানাথ বাবু দুমাসের সিট রেন্ট মিটিয়ে দিলেন। সন্ধ্যাবেলা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ধূপ কিনে আনলেন। অনেক দিন পর তাঁর ঘরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বললো, ধূপ পুড়তে লাগল। করিম সাহেব একবার অবাক হয়ে বললেন, এককথায় দুশো টাকা দিয়ে দিল। পাগল নাকি মেয়েটা?

নিশানাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, দুশো টাকা খুব বেশি লাগল। আপনার কাছে? হাজার টাকা নিয়েও মানুষ একদিন আমাদের সাধা সাধি করেছে। টাকা অতি তুচ্ছ জিনিস মশাই আমাদের কাছে।

অনেক দিন পর জ্যোতির্ষিণব মেসের এক তলায় সবার সঙ্গে খেতে গেলেন। মাছের তরকারীতে নুন কম হয়েছে কেন তাই নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু করলেন কাদেরের সঙ্গে।

সফিক সন্ধ্যাবেলা এসে জিজ্ঞেস করল, আভাকে আসতে বলেছিলাম–এসেছিল?

আমি অবাক হয়ে বললাম, আভা কে?

ঐ যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম, চাকরি দিয়েছিল আমাকে। আসে নাই?

এসেছিল।

বলেছিলাম আজকেই আসতে। টাকা পয়সা কত দিয়েছে জানিস নাকি? একশো টাকা দিতে বলেছিলাম।

দুশো টাকা দিয়েছে।

মেয়েটার নজর খুব উঁচু। সাধু ব্যাটা কিছু বুঝতে পারে নাই নিশ্চয়ই।

আমি কিছু বললাম না। সফিক হাসি মুখে বলল, যাক ঘড়িটি বিক্রি করতে হয় নাই। নিশানাথের খুব সখের ঘড়ি। সফিক ঘড়ি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া বাঁধিয়ে বসল। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া। নিশানাথ বাবু সফিককে হাসতে হাসতে বলছেন, আমার কেতু এবং মঙ্গলের যে দোষটা ছিল সেটা কেটে গেছে। সফিক। হুঁড় হুঁড় করে টাকা আসা শুরু হয়েছে। তোমার দরকার হলে বলবে লজ্জার কিছু নাই।

সফিক বলেছে, এইসব ধান্ধাবাজী এখন ছাড়েন নিশানাথ বাবু। অনেক তো করলেন।

নিশানাথ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, পুত্রবৎ জ্ঞান করি তোমাকে আর তোমার মুখে এত বড় কথা। রাগের মাথায় ব্রহ্মশাপ দিয়ে ফেলব সফিক।

এ আমার দুর্বাশা মুণি! ব্রহ্মশাপ দেবেন।

খবরদার বলছি। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে।

হাতাহাতি হয়ে যাবার মত অবস্থা।

গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনি চুক চুক শব্দ হচ্ছে। অন্ধকারে বসে তিনমূর্তি চা খাচ্ছে। সফিক, জ্যোতির্ষিণব আর আমার বাবা। ফিসফিস করে তাদের কি সব কথাবার্তাও হচ্ছে। বাবা এখানেই আছেন, কিছুতেই ফিরে যেতে চাচ্ছেন না। রাত্রে জ্যোতির্ষাণবের ঘরে গিয়ে ঘুমান। দিনের বেলাটা কাটান সফিকের ঘরে। আমি দেশে ফেরানোর কথা বলে বলে হার মেনেছি। সফিক অবিশ্য বলছে, থাকুক না। তিনি। মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থাটা করি আগে।

মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা অনেক কথাবার্তা বলেও কোনো অসুখ-বিসুখ ধরতে পারলেন না। রাগী চেহারার একজন বুড়ো মত ডাক্তার শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন,

অসুবিধাটা কি আপনার বুঝতে পারছিনা তো।

বাবা বললেন, অসুবিধা তো কিছু নাই ডাক্তার সাহেব।

রাত্রে ঘুম হয়?

ঘুম হবে না কেন?

বাবা মহাসুখেই আছেন। পান্থ নিবাসের সবার সঙ্গেই তার খাতির। আজীজ সাহেব সকাল বেলা ব্যায়াম করেন। তিনি বসে থাকেন পাশে। আমাকে প্রায়ই বলেন, রঞ্জু স্বাস্থ্য হচ্ছে সমস্ত সুখের মূল। স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখা দরকার। তুই বেলের শরবত খাবি। খুব উপকারী। আজীজ বলেছে আমাকে।

বাবার সবচেয়ে বেশি খাতির সিরাজ সাহেবের সঙ্গে। সিরাজ সাহেব কোনো এক বিচিত্র কারণে বাবাকে পছন্দ করেন। অফিস থেকে এসেই তিনি বাবাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে যাবেন। তারপর দরজা বন্ধ করে গুজ গুজি করে আলাপ। এক শনিবারে বাবা সিরাজ সাহেবের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। আমি কিছু বললাম না। পরের শনিবারে দেখি আবার যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। বাবা শান্ত স্বরে বললেন, আমার জন্যে বৌটা কৈ মাছ জোগাড় করে রাখবে বলেছে।–না গেলে কেমন করে হয়?

কৈ মাছ খাওয়ার জন্য এত দূর যাবেন?

নারিকেলের চিড়া করে রাখবে। এখন না। যাই কী করে?

এইবার ফিরে এসে তিনি অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। যেন অত্যন্ত রহস্যময় একটি ব্যাপার তিনি জেনে ফেলেছেন। ব্যাপারটি দু’দিন পর আমরাও জানলাম। রাতের খাওয়ার পর বাবা আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ের ছবি সফিকের টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর হয়ে সফিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সফিক অবাক হয়ে বললো, এ ছবি কার? আর এই মেয়েটিই বা কে?

বাবা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, রেবার ছবি।

রেবা? রেবা কে?

যেই হোক তোমার পছন্দ হয়েছে তো?

সফিক এবং আমি দুজনেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। বাবা নিজেই খোলসা করেন, রেবা হচ্ছে সিরাজ সাহেবের বোন। ওর সঙ্গেই তোমার বিয়ে ঠিক করে এসেছি। পাকা কথা দিয়ে ফেলেছি।

সফিকের চেয়ে বেশি হকচাকিয়ে যাই আমি। বাবার যে কি সব লোক হাসানো কাণ্ড কারখানা।

সফিক কিন্তু সহজ ভাবেই বলে, পাকা কথা দিয়ে ফেলেছেন চাচা?

হ্যাঁ তা বলতে গেলে দিয়েই ফেলেছি। তোমার বাবা বেঁচে নাই। আমাকেই তো দেখতে হবে সব। ঠিক কিনা তুমিই বল?

তা ঠিক।

বাবা মহা উৎসাহী হয়ে ওঠেন। হাসি হাসি মুখ। তোমাকেও ওদের খুব পছন্দ। সিরাজের বৌ এখানে এসে দেখে গেছে তোমাকে। বড় ভাল মেয়ে বড় ভাল। সফিক চুপ করে থাকে। বাবা উৎসাহ এবং উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকেন।

তোমাদের বিয়ের পর আমি কিন্তু তোমাদের বাসাতেই থাকব। রেবাকেও বললাম এই কথা।

সফিক আঁতকে উঠে বলে, তাকেও বলেছেন এই কথা?

বলব না কেন? সংসারের মাথা তো মেয়েরাই হয়। হয় না?

তা হয়।

আমার ধারণা ছিল সফিক রেগে মেগে একটা কাণ্ড করবে। বাবাকে নিয়ে আমি মহা লজ্জায় পড়ব। সে রকম কিছু হল না। সে যেন লজ্জায় পড়েই উঠে গেল সামনে থেকে।

আমি পরের সপ্তাহেই বাবাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলাম। ঢাকায় রেখে চিকিৎসাও কিছু হচ্ছে না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। মা একটির পর একটি উদ্বিগ্ন চিঠি পাঠাচ্ছেন। ট্রেন ছাড়বার আগে আগে দেখি সিরাজ, সাহেব আজীজ সাহেব। আর আমাদের জ্যোতির্ষিণর এসে হাজির। তারা বিদায় জানাতে এসেছেন। আজীজ সাহেবের হাতে আবার প্রকাণ্ড একটা খাবারের ঠোঙ্গা। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ছেলে মানুষের মত ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কী যে অস্বস্তিকব অবস্থা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *