চায়ের দোকানি খুশিমনেই চা ছাকতে বসল। আমি কাল সকালেই দাম দিয়ে যাব।কোনাে অসুবিধা নাই। তিন কাপ চায়ের লাগিন ফতুর হইতাম না। আমরা ময়মনসিংহ-এর লােক। আমরার কইলজা বড়।
নাম কী আপনার ? রশীদ। আচ্ছা ভাই রশীদ, আপনার কাছে সিগারেট আছে ? সিগারেট নাই, বিড়ি আছে। খাইবেন ?
দেন দেখি একটা।
মিসির আলি চিন্তিত মুখে বিড়ি টানতে লাগলেন। বেলা বাড়ছে তার খেয়াল নেই। অনেক কাজ পড়ে আছে সামনে। কাজ গুছাতে হবে। কীভাবে গুছাতে হবে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।
এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকে জেরা করতে হবে। এলােমেলাে প্রশ্ন উত্তর নয়। পুখানুপুঙ্খ জেরা। তিন্নির মা’র সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। ভদ্রমহিলার চিঠিপত্র ডায়েরি এইসব দেখতে হবে। ভালােভাবে জানতে হবে তিনি মেয়ে সম্পর্কে কী ভাবছেন। মারা অনেক কিছু বুঝতে পারে।
কী ভাবেন ?
মিসির আলি চমকে উঠে বললেন, কিছু ভাবি না ভাই। চায়ের জন্যে ধন্যবাদ। কাল সকালে আমি আবার আসব ।
জি আইচ্ছা। আপনে ময়মনসিংয়ের লােক না মনে হইতাছে। জ্বি না। আমি ঢাকা থেকে এসেছি। কুটুম্ববাড়ি ? জ্বি কুটুম্ববাড়ি।
তােমার নাম রহিমা ?
ভালাে আছ রহিমা ? জ্বি আল্লাহতালা যেমুন রাখছে।
রহিমা লম্বা একটা ঘােমটা টানল। এই লােকটি তার কাছে কী জানতে চায় তা সে বুঝতে পারছে না। সে তাে কিছুই জানে না। তাকে কিসের এত জিজ্ঞাসাবাদ। তিন্নির আব্বা বলে দিয়েছেন—– উনি যা জানতে চান সব বলবে। কিছুই গােপন করবে না। এও এক সমস্যা। গােপন করার কী আছে ?
রহিমা!
জুি। দেশের বাড়িতে তােমার কে কে আছেন ? এক মাইয়া আছে। মেয়েকে দেখতে যাও না। জ্বি যাই। শেষবার কবে গিয়েছিলে ? তিন বছর আগে।
এই তিন বৎসর যাও নি কেন?
রহিমা চমকে উঠল। তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। যেন সে নিজেই গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। কেন যায় নি।
মেয়ে যাবার জন্যে বলে না ? জ্বি বলে। তবু যেতে ইচ্ছা করে না, তাই না?
রহিমার মা চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, তিন্নির মাকে তাে তুমি দেখেছ তাই না ?
জ্বি। কেমন মহিলা ছিলেন ?
খুব ভালাে। এমুন মানুষ দেখি নাই। খুব সুন্দর আছিল। কীরকম ব্যবহার। কাউরে রাগ হয়ে কথা কয় নাই।
ঐ ভদ্রমহিলার মধ্যে তিন্নির মতাে কোনাে কিছু ছিল কি ? জ্বি না। বড় ভালাে মানুষ ছিল । ইনার কথা মনে হইলেই চউক্ষে পানি আসে। রহিমা সত্যি সত্যি চোখ মুছল। মিসির আলির আর কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল না।
অন্যদের কাছ থেকে তেমন কিছু জানা গেল না। বাড়ির দারােয়ানের একটি কথা অবশ্যি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সে বলছে, তিনি ছােটবেলায় খুব ছুটাছুটি করত। বাগানে দৌড়াত। যতই সে বড় হচ্ছে ততই তার ছােটাছুটি কমে যাচ্ছে। এখন বেশিরভাগ সময় সে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে কিংবা চুপচাপ বসে থাকে।
তুমি কতদিন ধরে এ বাড়ি আছ ? জ্বি অনেক দিন। ছুটিছাটায় দেশের বাড়িতে যাও না ? জি যাই। শেষ কবে গিয়েছিলে ?
অনেক হিসাব-নিকাশ করে দারােয়ান বলল, তিন বৎসর আগে একবার গেছিলাম।
গত তিন বৎসর যাও নি ? জ্বি না।
তিন্নির মা’র পুরানাে চিঠিপত্র বা ডায়েরি কিছুই পাওয়া গেল না। বরকত সাহেব বললেন, এদেশের মেয়েদের কি আর ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে ? এরা ঘরের কাজকর্ম করেই সময় পায় না। ডায়েরি কখন লিখবে ?
চিঠিপত্র ? পুরানাে চিঠিপত্র ? | পুরানাে চিঠিপত্র কি কেউ জমা করে করে রাখে বলুন? চিঠি আসে, আমরা চিঠি পড়ে ফেলে দেই। ব্যস। তাছাড়া ও চিঠি লিখবে কাকে ? বাপ-মা মরা মেয়ে ছিল। মামার কাছে মানুষ হয়েছে। বিয়ের পর সেই মামা মারা গেলেন। সে একা হয়ে গেল। চিঠিপত্র লেখার বা যােগাযােগের কেউ ছিল না।
আপনার স্ত্রী কি খুব বিষন্ন প্রকৃতির ছিলেন?
মনে হয়। হাসিখুশিইতাে ছিল। কোনােরকম অসুখ বিসুখ ছিল কি?
বলার মতাে তেমন কিছু না, সর্দি কাশি এইসবে খুব ভুগত। এটা নিশ্চয়ই তেমন কিছু না।
তিনি যখন তার পেটে সে সময় কি তার জার্মান মিজেলস হয়েছিল ?
এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন?
জার্মান মিজেলস একটা ভাইরাস ঘটিত অসুখ। এতে বাচ্চার অনেক ধরনের ক্ষতি হবার কথা বলা হয়। জিনে’ কিছু ওলটপালট হয়।
এ ধরনের কোনাে অসুখ-বিসুখ হয়নি। মামস ? মামস হয়েছিল কি?
তাও না। মিসির আলি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, সেই সময় তিনি কি কোনাে অদ্ভুত স্বপ্নটপ্ন দেখতেন ?
বরকত সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, কেন জিজ্ঞেস করছেন? মানসিক অবস্থাটা জানবার জন্যে। দেখতেন কি কোনাে স্বপ্ন।
হা দেখতেন। কী ধরনের স্বপ্ন আপনার মনে আছে?
ঠিক মনে নেই। প্রায়ই দেখতাম জেগে বসে আছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলত, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
কী দুঃস্বপ্ন সেটা জিজ্ঞেস করেন নি ? | জ্বি না, জিজ্ঞেস করিনি। স্বপ্নটপ্নর ব্যাপারে আমার তেমন উৎসাহ নেই। তবে সে নিজ থেকে কয়েকবার আমাকে বলতে চেষ্টা করেছে আমি তেমন গুরুত্ব দেই নি।।
আপনার কি কিছুই মনে নেই? ও বলত তার দুঃস্বপ্নগুলি সব গাছপালা নিয়ে। এর বেশি আমার কিছু মনে নেই।