যা দেখে কেউ ধারণাও করতে পারে না এই সম্প্রদায় আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু।
মিসির আলি সাহেব চা নিন। তিনি চা নিলেন। বলুন স্পেসিফিক্যালি আপনি কী জানতে চান।পৃথিবীতে ঠিক এ জাতীয় গাছ আছে কি না তা কে বলতে পারবে ? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি গাছপালার ক্যাটালগ জাতীয় কিছু কি আছে যেখানে সব জাতীয় গাছপালার ছবি আছে ? তাদের সম্পর্কে তথ্য লেখা আছে ।
হ্যা নিশ্চয় আছে। এ দেশে নেই। বােটানিক্যাল সােসাইটিতে আছে। ওদের একটি কাজই হচ্ছে গাছপালার বিভিন্ন স্পেসিসকে সিসটেমেটিক ভাবে ক্যাটালগিং করা ।
আপনি কি আমাকে কিছু লােকজনের ঠিকানা দিতে পারবেন যারা আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন ?
হা পারি। আপনি যাবার সময় আমি ঠিকানা লিখে দেব। আর কী জানতে চান ? মানুষ এবং গাছের মধ্যে পার্থক্য কি? প্রশ্নটা আরাে গুছিয়ে করুন।
মিসির আলি থেমে থেমে বললেন, আমরা তাে জানি গাছের জীবন আছে। কিন্তু আমি যা জানতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে গাছের জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবনের মিলটা কোথায় ?
চট করে উত্তর দেয়া যাবে না। এর উত্তর দেবার আগে আমাদের জানতে হবে জীবন মানে কী? এখনাে আমরা পুরােপুরিভাবে জীবন কী তাই জানি না।
বলেন কী ? জীবন কী জানেন না !
হ্যা তাই। বিজ্ঞান অনেক দূর আমাদেরকে নিয়ে গেছে কিন্তু এখনাে অনেক কিছুই আমরা জানি না। অনেক আনসলভ মিস্ত্রি রয়ে গেছে। আপনাকে আরেক কাপ চা দিতে বলি ?
বলুন।
ড. জাবেদ সিগারেট ধরিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে গাছের মিল অনেক বেশি।
বলেন কী !
হ্যা তাই। আসল জিনিস হচ্ছে জীন’ ঠিক করে কোন প্রােটিন তৈরী করা দরকার। অনেকগুলি জীন নিয়ে হয় একটি ডিএনএ মলিকুল। ডিওক্সি রিবাে নিউক্লিয়িক এসিড । প্রাণের আদি ব্যাপার হচ্ছে এই জটিল অণু। এই অণু থাকে জীবকোষে। তারা ঠিক করে একটি প্রাণী মানুষ হবে, না গাছ হবে, না সাপ হবে। মাইটোকনড্রিয়া বলে একটি জিনিস মানুষেরও আছে, আবার গাছেরও আছে। মানুষের যা নেই তা হচ্ছে ক্লোরােপ্লাস্ট।
আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।
বুঝতে পারার কথাও নয়। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে কিছু সহজ বইপত্র দিতে পারি।
আমি চাই। আমি আমাকে আরাে কিছু বলুন।
ডি.এন.এ. প্রসঙ্গেই বলি । এই অণুগুলি হচ্ছে প্যাচালাে সিঁড়ির মতাে। মানুষের ডি.এন.এ. এবং গাছের ডি.এন.এ, প্রায় একইরকম। সিঁড়ির দু-একটা ধাপ শুধু আলাদা। একটু অন্য রকম।
মিসির আলি গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। একজন ভালাে শিক্ষক খুবই সহজেই একজন মনােযােগী শ্রোতাকে চিনতে পারেন। ড. জাবেদ এই মনােযােগী শ্রোতাকে পছন্দ করে ফেললেন।
শুধু এই দু-একটি ধাপ অন্যরকম হওয়ায় প্রাণীজগতে মানুষ এবং গাছ আলাদা হয়ে গেছে। প্রােটিন তৈরীর পদ্ধতি হয়েছে ভিন্ন। আপনি আগে বরং কয়েকটা বইপত্র পড়ুন। তারপর আবার আপনার সঙ্গে কথা বলব ।।
ড. জাবেদ তিনটি বই দিলেন । দুটি ঠিকানা লিখে দিলেন। একটি লন্ডনের রয়েল বােটানিক্যাল সােসাইটির অন্যটি ড. লংম্যানের। ড. লংম্যান আমেরিকান এগ্রিকালচারাল রিসার্চের ডেপুটি ডাইরেকটর।
মিসির আলি সাহেব তার সঙ্গের ছবিগুলি দু-ভাগ করে দু-জায়গায় পাঠালেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার দশদিনের মাথায় ড. লংম্যান-এর চিঠির জবাব চলে এল।
টমাস লংম্যান
Ph. D. D. Sc. US Department of Agricultural Science
DD 505837 USA
প্রিয় এম, আলি, আপনার পাঠানাে ছবি এবং চিঠি পেয়েছি। যে সমস্ত লতানাে গাছের ছবি আপনি পাঠিয়েছেন তা খুব সম্ভব কল্পনা থেকে আঁকা। আমাদের জানামতে ও-রকম গাছের কোনাে অস্তিত্ব নেই। তবে পেরুর গহীন অরণ্যে এবং আমেরিকান রেইন ফরেস্টে কিছু লতানাে গাছ আছে যার সঙ্গে আপনার পাঠানাে গাছের সামান্য মিল আছে। আমি আপনাকে কিছু ফটোগ্রাফ পাঠালাম, আপনি নিজেই মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি রেইন ফরেস্ট এবং পেরুর গাছগুলির রং সবুজ কিন্তু আপনার পাঠানাে ছবির গাছের বর্ণ হলুদ এবং লালের মিশ্রণ। এর বেশি আপনাকে আর কোনাে তথ্য দিতে পারছি না।
আপনার বিশ্বস্ত
টি, লংম্যান। পুনশ্চ আপনি যদি ছবির মতাে গাছের কিছু নমুনা পাঠান তাহলে আমরা তা অত্যন্ত
আগ্রহের সঙ্গে পরীক্ষা করব।
রয়েল বােটানিক্যাল সােসাইটি চিঠির জবাব দিতে কুড়ি দিনের মতাে দেরি করল । তাদের জবাবটি ছিল এক লাইনের।
প্রিয় ড. এম. আলি, আপনার পাঠানাে ছবির মতাে দেখতে কোনাে গাছের কথা। আমাদের জানা নেই।
আপনার বিশ্বস্ত এ. সুরনসেন।
মিসির আলি সাহেব এই কদিনে জীবনের উৎপত্তি এবং বিকাশের ওপর গােটা চারেক বই পড়ে ফেললেন। ডি.এন.এ. এবং আর.এন.এ. মলিকুল সম্পর্কে পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলেন প্রচুর কেমিস্ট্রি জানা ছাড়া কিছু স্পষ্ট হচ্ছে না। বারবার এ্যামিনাে এসিডের কথা আসছে। এ্যামিনাে এসিড় কী জিনিস তা তিনি জানেন না। অথচ বুঝতে পারছেন প্রাণের রহস্যের সঙ্গে এ্যামিনাে এসিডের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মিসির আলি নাইন-টেনে পাঠ্য কেমিস্ট্রির বই কিনে এনে পড়াশুনা শুরু করলেন। কোমর বেঁধে পড়াশােনা যাকে বলে। এই ফাঁকে চিঠি লিখলেন তিন্নির বাবাকে। তিন্নির বাবা তার জবাব দিলেন না। তবে তিনি একটি চিঠি লিখল। কোনােরকম সম্বােধন চিঠিতে নেই । হাতের লেখা অপরিচ্ছন্ন। প্রচুর ভুল বানান। কিন্তু ভাষা এবং বক্তব্য বেশ পরিষ্কার । খুবই গুছিয়ে লেখা চিঠি, বাচ্চা একটি মেয়ের জন্যে যা বেশ আশ্চর্যজনক। চিঠির অংশবিশেষ এ-রকম।
( চিঠি ) আপনি আব্বাকে একটি লম্বা চিঠি লিখেছেন। আব্বা সেই চিঠি
-পড়েই ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন। আব্বা এখন আর আপনাকে পছন্দ করছেন না। তিনি চান না আপনি আমার ব্যাপারে আর কোনাে চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু আমি জানি আপনি করছেন। যদিও আপনি অনেক দূরে থাকেন তবু আমি বুঝতে পারি। আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন তাও বুঝতে পারি। কেউ আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু আপনি করেন। কেন করেন? আমি তাে ভালাে মেয়ে না। আমি সবাইকে কষ্ট দেই। সবার মাথায় যন্ত্রণা দেই। কাউকেই আমার ভালাে লাগে না। আমার শুধু গাছ ভালাে লাগে। আমার ইচ্ছা করে একটা খুব গভীর জঙ্গলের মাঝখানে গিয়ে বসে থাকি। গাছদের সঙ্গে কথা বলি। গাছেরা কত ভালাে। এরা কখনাে একজন অন্যজনের সঙ্গে ঝগড়া করে না। মারামারি করে না। নিজের জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এবং ভাবে। কত বিচিত্র জিনিস নিয়ে তারা ভাবে। এবং মাঝে মাঝে একজনের সঙ্গে অন্যজন কথা বলে। কী সুন্দর সেইসব কথা। এখন আমি মাঝে
মাঝে ওদের কথা শুনতে পাই। চিঠি এই পর্যন্তই। মিসির আলি এই চিঠিটি খুব কম হলেও দশবার পড়লেন। চিঠির কিছু অংশ লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন। যেমন একটি লাইন— এখন আমি মাঝে মাঝে ওদের কথা শুনতে পাই। স্পষ্টতই মেয়েটি গাছের কথা বলছে। পুরাে ব্যাপারটাই সম্ভবত শিশুর কল্পনা। শিশুদের কল্পনার মতাে বিশুদ্ধ জিনিস আর কিছুই নেই। মিসির
আলির নিজের এক ভাগ্নি অমিতা গাছের সাথে কথা বলত। ওদের বাড়ির সামনে ছিল একটা খাটো কদমগাছ। অমিতাকে দেখা যেত গাছের সামনে উবু হয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করছে। মিসির আলি একদিন আড়ালে বসে কথাবার্তা শুনলেন।
কিরে আজ তুই এমন মুখ কালাে করে রেখেছিস কনে ? রাগ করেছিস? তুই এমন কথায় কথায় রাগ করিস কেন ? কেউ বকেছে? কী হয়েছে বল তাে ভাই শুনি।