অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-১৫)

অমিতা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। যেন সে সত্যিসত্যি শুনতে পাচ্ছে গাছের কথা। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছে। একসময় সে উঠে দাঁড়াল এবং বিকট চিৎকার করে বলল- কে কদম গাছকে ব্যথা দিয়েছে ? কে পাতাসুদ্ধ তার ডাল ছিড়েছে ? কান্নাকাটি চিৎকার। জানা গেল আগের রাতে সত্যিসত্যি কদমগাছের একটি ডাল ভাঙা হয়েছে। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। কিছুদিন পর গাছটি আপনাআপনি মরে যায়। অমিতা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বড় অসুখে পড়ে যায়। জীবন-মরণ অসুখ। মাসখানিক ভুগে সেরে উঠে । গাছ প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়।অন্যভুবন মিসির আলি ঠিক করলেন অমিতার সঙ্গে দেখা করবেন। ছােটবেলার কথা জিজ্ঞেস করবেন। যদিও এটা খুবই সম্ভব যে অমিতার শৈশবের কথা কিছু মনে নেই। সে এখন থাকে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায়। তার স্বামী পুলিশের ডি.এস.পি.। সে নিজে কোনাে এক মেয়ে-স্কুলে পড়ায় । মিসির আলি ঠিক করলেন অমিতার সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবেন। ময়মনসিংহ। তিন্নির সঙ্গে কথা বলবেন। দু-একটা ছােটখাটো পরীক্ষা-টরীক্ষা করবেন। তিন্নির মা’র আত্মীয়স্বজনের খোঁজ বের করতে চেষ্টা করবেন। তিন্নিকে দিয়ে আরাে কিছু ছবি আঁকিয়ে পাঠাবেন ড, লংম্যানের কাছে। অনেক কাজ সামনে। মিসির আলি দু-মাসের অর্জিত ছুটির জন্যে দরখাস্ত করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরির পদটি হচ্ছে অস্থায়ী। পার্টটাইম শিক্ষকতার পদ। দু-মাসের ছুটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দেবে হয়তাে চাকরি চলে যাবে। কিন্তু উপায় কী ! এই রহস্য তাঁকে ভেদ করতেই হবে। ছােট্ট একটি মেয়ে কষ্ট পাবে তা হতেই পারে না। 

অমিতা অবাক হয়ে বলল, আরে মামা তুমি ? 

মিসির আলি বললেন, চিনতে পারছিস রে বেটি ? 

কী আশ্চর্য মামা তােমাকে চিনব না ? তােমাকে নিয়ে কত গল্প করি মানুষের সাথে । 

তিনি হাসলেন। অমিতা বলল, বিনা কারণে তুমি আমার কাছে আসনি। তুমি সেই মানুষই না। কী জন্যে এসেছ বল। 

এখনি বলব ? 

না এখন না। আমি স্কুলে যাচ্ছি । আজ আর ক্লাস নেব না। ছুটি নিয়ে চলে আসব । তুমি ততক্ষণে গােসল টোসল করে বিশ্রাম নাও | আমার ঘর-সংসার দেখ। ঘন ঘন চা খাওয়ার অভ্যাস এখনাে আছে ? 

“ আছে।। কাজের ছেলেটাকে বলে যাচ্ছি। সে প্রতি পনের মিনিট পরপর চা দেবে। তাের ছেলেপুলে কই। 

অমিতা ছােট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার ছেলেপুলে নেই মামা। হবেও না কোনাে দিন। তুমি তাে কোনাে খোঁজখবর রাখ না। কাজেই কিছুই জানে না। যদি জানতে তাহলে আর… 

সে কথা শেষ করল না । মিসির আলি লক্ষ্য করলেন মেয়েটির গলা ভারী হয়ে এসেছে। কত রকম দুঃখ-কষ্ট মানুষের থাকে। তার মন খারাপ হয়ে গেল। 

তাের বর কোথায়? ও টুরে গেছে চৌদ্দগ্রামে। সন্ধ্যাবেলায় ফিরবে। তুমি কি থাকবে সন্ধ্যা পর্যন্ত? না। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। তাতাে থাকবেই। তােমাকে যে আমি কত ভালােবাসি মামা অথচ তুমি… 

অমিতার গলা আবার ভারী হয়ে গেল। এই মেয়েটার মনটা অসম্ভব নরম। 

মিসির আলি গােসল সেরে ঘুরে-ঘুরে অমিতার ঘর-সংসার দেখলেন। বিরাট দোতলা বাড়ি। প্রতিটি ঘর চমৎকার করে সাজানাে। লাইব্রেরি ঘরটি দেখে তার মন ভরে গেল। বই বই আর বই। তাকিয়ে থাকতে ভালাে লাগে। 

কাজের ছেলেটির নাম চেরাগ মিয়া। সে সত্যি সত্যি পনের মিনিট পরপর চা নিয়ে আসছে। দু-কাপ চা খেয়ে মিসির আলি ধমক দিলেন আর লাগবে না। দরকার হলে আমি চাইব। লাভ হল না। পনের মিনিট পর সে আবার এক কাপ চা নিয়ে এল। 

দুপুরে খেতে বসে অমিতার সঙ্গে তিনি গাছের সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গটা তুললেন । 

অমিতা অবাক হয়ে বলল, এইটি জানবার জন্যে তুমি এসেছে আমার কাছে? 

তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি মামা? পাগলরাই শুধু এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ছুটাছুটি করে। 

পাগল হই আর যাই হই, যা জানতে চাচ্ছি সেটা বল। তুই যে ছােটবেলায় গাছের সঙ্গে কথা বলতি সেটা মনে আছে? 

হ্যা আছে। আচ্ছা, গাছ কি তাের সঙ্গে কথা বলত? 

অমিতা হাসিমুখে বলল, গাছ আমার সঙ্গে কথা বলবে কী? গাছ আবার কথা বলা শিখল কবে? 

তার মানে গাছের কোনাে কথা তুই শুনতে পেতি না? 

কীভাবে শুনব মামা? তুমি শুনতে পাও? এইসব ছােটবেলার খেয়াল । এটা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন? 

এমনি। 

উহু। এমি এম্নি মাথা ঘামাবার মানুষ তুমি না। নিশ্চয়ই কিছু-একটা আছে যা তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছ না। ওকি মামা, তােমার কি খাওয়া হয়ে গেল ! 

হ্যা। 

অসম্ভব। এগার পদ রান্না করেছি। তুমি খেয়েছ মাত্র পাঁচ পদ, এখনাে ছ’টা পদ বাকি আছে। 

মরে যাব অমিতা। 

মরে যাও আর যাই কর, খেতে হবে। জোর করে আমি মুখে তুলে খাইয়ে দেব। আমাকে তুমি চেনাে না মামা। 

মিসির আলি হাসলেন। অমিতা গম্ভীরমুখে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি জোর করে মুখে তুলে দেবে। মিসির আলি মৃদুস্বরে বললেন, গাছ তাহলে তাের সঙ্গে কোনাে কথা বলত না? 

অমিতা বিরক্ত স্বরে বলল, না। গাছ আমার সঙ্গে কেন কথা বলবে বল তাে? আমি কি গাছ? ভালাে করে তাকিয়ে দেখ তাে আমার দিকে, আমাকে কি গাছ বলে মনে হয়? 

মিসির আলি কিছু বললেন না। তাকিয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে। তাঁর এই ভাগ্নিটি ভারি সুন্দর। দেবীর মতাে মুখ। ঘন কালাে তরল চোখ। মুখের ভাবটি বড় স্নিগ্ধ।অমিতা বলল, মামা তুমি মানুষদের দুঃখ-কষ্ট দূর করবার জন্যে ছুটাছুটি কর অথচ আশেপাশে যারা আছে তাদের কথা কিছুই ভাবাে না। 

ভাবি না কে বলল? 

ভাবাে না। ভাবলে এই ছ-বছরে একবার হলেও আসতে আমার কাছে। | মিসির আলি দেখলেন, অমিতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। মেয়েগুলি এত নরম স্বভাবের হয় কেন, এই নিয়ে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *