অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-১৬)

অন্যমনস্কভাবে তিনি খানিকক্ষণ ভাবলেন। একটি মেয়ের ডি.এন.এ. এবং একটি পুরুষের ডি.এন.এ. এর মধ্যে তফাৎ কী তাঁর জানতে ইচ্ছে হল। পড়াশােনা করতে হবে। প্রচুর পড়াশােনা । জীবন এত ছােট অথচ কত কী আছে জানার ।
অন্যভুবন

তিনি আজ সারাদিন ছাদে বসে আছে। সে ছাদে গিয়েছে সূর্য ওঠার আগে। এখন প্রায় সন্ধ্যা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একবারও সে নিজের জায়গা থেকে নড়েনি। তার ছােট্ট শরীরটি পাথরের মূর্তির মতাে স্থির হয়ে আছে। মাঝে মাঝে বাতাসে তার চুল উড়ছে। এ থেকেই মনে হয় এটি পাথরের মূর্তি নয়। জীবন্ত একজন মানুষ। সকালে কাজের মেয়ে নাস্তা নিয়ে ছাদে এসে ক্ষীণ গলায় বলেছিল, আপা নাস্তা আনছি।

তিনি কোনাে জবাব দেয়নি। কাজের মেয়েটি আধঘণ্টার মতাে অপেক্ষা করল। এর মধ্যে কয়েকবার নাস্তা খাবার কথা বলল। তিন্নির কোনাে ভাবান্তর হল না। 

দুপুরবেলা বরকত সাহেব নিজেই এলেন। শান্ত গলায় বললেন, খেতে আস মা । 

তিন্নি নিশ্চপ। বরকত সাহেব তার হাত ধরলেন। হাত গরম হয়ে আছে। বেশ গরম। যেন মেয়েটির একশ তিন বা চার জ্বর উঠেছে। তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, তােমার কি শরীরটা খারাপ মা? 

তিন্নি না-সূচক মাথা নাড়ল। 

এসাে, ভাত দেয়া হয়েছে। দুজনে মিলে খাই। 

সে আবার না-সূচক মাথা নাড়ল। যেন হাজার ভােল্টের ইলেকট্রিসিটি চলে গেল কপালের মাব’খান দিয়ে। তিনি মেয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ হতভম্বের মতাে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিন্নি তখন খুব সহজ গলায় বলল, বাবা তুমি চলে যাও। 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ

চলে যাব? 

তুমি আসবে না? 

কিছু খাবে না? খিদে নেই। 

এক গ্লাস দুধ খাও। দুধ পাঠিয়ে দেই। 

বরকত সাহেব নিচে গেলেন। এ কী গভীর পরীক্ষায় তিনি পড়লেন! মেয়ের এই বিচিত্র অসুখের সত্যি কি কোনাে সমাধান আছে? তার মনে হতে লাগল সমাধান নেই। এই অসুখ বাড়তেই থাকবে। কমবে না। মিসির আলি নামের মানুষটির কিছুই করার ক্ষমতা নেই। মেয়েটিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে কেমন হয়? ইউরােপ, আমেরিকার বড় বড় ডাক্তাররা আছেন। তাঁরা দিনকে রাত করতে পারেন—এই সামান্য কাজটা পারবেন না! খুব পারবেন। তিনি নিজে দুপুরে কিছু খেতে পারলেন না। মাথায় ভোতা যন্ত্রণা হতে লাগল। বিকেলের দিকে সেই যন্ত্রণা খুব বাড়ল। তিনি কয়েকবার বমি করলেন। অসম্ভব রাগে তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। কার ওপর রাগ? সম্ভবত নিজের ভাগ্যের ওপর। এত খারাপ ভাগ্যও মানুষের হয়? 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ

তিন্নি সন্ধ্যা মিলাবার পর নিজের ঘরে ঢুকল। আজ অনেকদিন পর তার আবার ছবি আঁকতে ইচ্ছা হচ্ছে । রংতুলি সাজিয়ে সে উবু হয়ে মেঝেতে বসল । তার সামনে বড় একটি কাগজ বিছানাে। সে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে অতি দ্রুত তুলি বুলাতে শুরু করল । প্রথমে মনে হচ্ছিল কিছু লাইন এলােমেলাে ভাবে টানা হচ্ছে। এখন আর তা মনে হচ্ছে না। এখন কাগজে লতানাে গাছের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আকাশে দুটি সূর্য। তার আলাে তেরছাভাবে গাছগুলির উপর পড়েছে। 

তিন্নি মৃদুস্বরে বলল, তােমরা কেমন আছ? 

ছবির গাছগুলি যেন উত্তরে কিছু বলল । তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আম র কিছু ভালাে লাগছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। 

গা গুলি যেন তার উত্তরেও কিছু বলল। খুব কঠিন কোনাে কথা। কারণ তিন্নিকে দেখা গেল দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেছে। সেই কান্না দীর্ঘস্থায়ী হল না। সে ছবিটি কুচিকুচি করে দিয়ে শান্ত হয়ে নিচে নেমে গেল। কারণ সে বুঝতে পারছে তার বাবা ঠিক এই মুহূর্তে তাকে নিয়ে ভাবছেন, সেই ভাবনাগুলি ভালাে নয়। তার বাবা সমস্যার কাছে থেকে মুক্তি চান। কিন্তু যে পথ তিনি বেছে নিতে চাচ্ছেন তাতে কোনাে লাভ হবে । 

বাবা। 

বরকত সাহেব চমকে ফিরলেন। তাঁর ঘর অন্ধকার। তিনি ইজিচেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি তাঁর সামনের খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। বরকত সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে তার মেয়ের দিকে তাকাতে লাগরেন। 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ

কিছু বলবে? বলব। বল শুনি। চেয়ারে বস। বসে বল । তিনি খুব নরম গলায় বলল, তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাও? হুঁ। বড় ডাক্তার দেখাব। পৃথিবীর সেরা ডাক্তার । ডাক্তার কিছু করতে পারবে না। 

কী করে বুঝলে? 

আমি জানি। আমার কোনাে অসুখ করেনি। আমি তােমাদের মতাে না। আমি অন্যরকম। 

সেটা আমি জানি। 

তুমি জানাে না। সবটা জানাে না। ঠিক আছে না-জানলে জানি না। এতকিছু জানার আমার দরকার নেই। আমার টাকার অভাব নেই। তােমাকে আমি বড় বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ইউরােপ । আমেরিকা। 

আমি এইখানেই থাকব। আমি কোথাও যাব না। 

বরকত সাহেব কড়া চোখে তাকালেন। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। কপালে ঘাম জমতে লাগল। তিনি বলল, তােমরা কিছুতেই আমাকে এখান থেকে নিতে পারবে না। তােমাদের সেই শক্তি নেই। 

বরকত সাহেব কিছু বললেন না। তিনি শান্ত সুরে বলল, এই বাড়িটাতে আমি একা থাকতে চাই বাবা । 

একা থাকতে চাই মানে? আমি একা থাকব। আর কেউ না । কী বলছ এসব? 

তিনি জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বরকত সাহেব কড়া গলায় বললেন, পরিষ্কার করে বল তুমি কী বলতে চাও। 

এই বাড়িটাতে আমি একা থাকব। আর কেউ থাকবে না। কাজের লােক, দারােয়ান, মালী এদের সবাইকে বিদায় করে দিয়ে তুমিও চলে যাও। তুমিও থাকবে না। 

আমিও চলে যাব? হ্যা। 

বরকত সাহেব উঠে এসে মেয়ের গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন। তিন্নি কিছুই বলল না । শান্ত পায়ে উঠে চলে গেল। বরকত সাহেব লক্ষ্য করলেন তিন্নি বাগানে চলে যাচ্ছে। বাগান এখন ঘন অন্ধকার। বর্ষার পানি পেয়ে ঝােপঝাড় বড় হয়ে উঠেছে। সাপখােপ নিশ্চয়ই আছে। এই মেয়ে এখন এই সাপখােপের মধ্যে একা-একা হাঁটবে। অসহ্য! অসহ্য! কিন্তু করার কিছুই নেই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *