অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-২)

মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, অল্প কথায় কিছু বলতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার অভ্যাস হচ্ছে বেশি কথা বলা। আপনি, চা খাবেন কি না তার জবাব দিতে গিয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য বলেছেন। আপনি বলেছেন– জ্বি না, আমি চা খাই না। আমার যা বলার তা আমি খুব অল্প কথায় বলে চলে যাব। এই বাক্যটিতে সতেরটি শব্দ আছে।অন্যভুবন

বরকতউল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। তাঁর ঐ কুঞ্চিত হল। মিসির আলি মনে মনে হাসলেন। কাউকে বুদ্ধির খেলায় হারাতে পারলে তার খুব আনন্দ হয়। 

বরকতউল্লাহ সাহেব আপনি কী চান? 

আপনার সাহায্য চাই। তার জন্যে আমি আপনাকে যথাযথ সম্মানী দেব। আমি ধনাঢ্য ব্যক্তি না হলেও দরিদ্র নই। আমি চেক বই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। 

ভদ্রলােক কোটের পকেটে হাত দিরেন। মিসির আলির খানিকটা মনখারাপ হয়ে গেল । ধনবান ব্যক্তিরা দরিদ্রের কাছে প্রথমেই নিজেদের অর্থের কথা বলে কেন ভাবতে লাগলেন। 

বরকতউল্লাহ বললেন, আমি কি আমার সমস্যাটার কথা আপনাকে বলব? 

মিসির আলি বললেন, তার আগে জানতে চাই আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমি এমন কোনাে বিখ্যাত ব্যক্তি নই যে ময়মনসিংহের একজন লােক আমার নাম জানবে। 

বরকতউল্লাহ নিচুস্বরে বললেন, আমি খুঁজছি একজন ভালাে সাইকিয়াট্রিস্ট। যার কাছে আমি অকপটে আমার কথা বলতে পারব। যে আমার কথায় লাফিয়ে উঠবে না, 

আবার অবিশ্বাসীর হাসিও হাসবে না। আমি জানি আপনি সে-রকম একজন মানুষ। কী করে জানি তা তেমন জরুরি নয়। 

মিসির আলির মনে হল লােকটা বেশ বুদ্ধিমান। গুছিয়ে কথা বলতে জানে। যার মানে হচ্ছে গুছিয়ে কথা বলার অভ্যেস তার আছে। লােকটি সম্ভবত একজন ব্যবসায়ী। সফল ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের লােকজনদের সঙ্গে খুব গুছিয়ে কথা বলতে হয়। 

বরকতউল্লাহ সাহেব, আপনি কি একজন ব্যবসায়ী? হ্যা আমি একজন ব্যবসায়ী। কতদিন ধরে ব্যবসা করছেন? প্রায় দশ বছর। এখন করছি না। কিসের ব্যবসা? 

অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ

আপনি আমাকে জেরা করছে কন বুঝতে পারছি না। 

আপনার সমস্যা নিয়ে আমি থা ঘামাব কি না, তা জানার জন্যে জেরা করছি। যদি আপনাকে আমার পছন্দ হয় তবেই আপনার কথা শুনব। সবার সমস্যা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। 

যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পেলেও না? | না। আমার সম্পর্কে ভালােরকম খোজখবর আপনি নেন নি। যদি নিতেন তাহলে জানতেন যে আমি টাকা নেই না। 

বরকতউল্লাহ সাহেব দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। তিনি তাঁর সামনে বসে থাকা রােগা ও বেঁটে লােকটিকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কথাবার্তা বলছে অহংকারী মানুষের মতাে কিন্তু বলার ভঙ্গিটি সহজ ও স্বাভাবিক। 

আপনি টাকা নেন না কেন, জানতে পারি কি? 

নিশ্চয়ই পারেন। টাকা নিলেই একধরনের বাধ্যবাধকতা এসে পড়ে। আমি তার মধ্যে যেতে চাই না। অন্যের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা আমার পেশা নয়, শখ। শখের ব্যাপারে কোনােরকম বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। কী বলেন? 

ঠিকই বলছেন। আমি আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেব। কী জানতে চান বলুন? 

অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ

আপনার পড়াশােনা কতদূর? এম.এ. পাশ করেছি পলেটিক্যাল সায়েন্স। আপনি বলছেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, কেন? এই প্রশ্নের জবাব আপনাকে পরে দেব। অন্য প্রশ্ন করুন। আপনি বিবাহিত? হ্যা। আমার ন’ বছর বয়েসী একটি মেয়ে আছে। আপনার সমস্যা এই মেয়েকে নিয়েই, নয় কি? জ্বি হা। কী করে বুঝলেন? 

মেয়ের কথা বলার সময় আপনার গলার স্বর পাল্টে গেল, তাই থেকেই আন্দাজ করছি। আপনার স্ত্রী মারা গেছেন কতদিন হল? 

পাঁচ বছর হল। স্ত্রী মারা গেছেন সেটা কী করে বলতে পারলেন? 

বাচ্চাদের কোনাে সমস্যা হলে মা নিজে আসেন। এ ক্ষেত্রে আসেন নি দেখে সন্দেহ হয়েছিল। তাছাড়া বিপত্নীক মানুষদের দেখলেই চেনা যায়। 

আমি কি এবার আমার ব্যাপারটা বলব? বলুন । সংক্ষেপে বলতে হবে? 

সংক্ষেপে বলার দরকার নেই । চা দিতে বলি? জ্বি না আমি চা খাই না। একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিতে বলুন, খুব ঠাণ্ডা। তৃষ্ণা হচ্ছে। আমার ঘরে ফ্রিজ নেই। পানি খুব ঠাণ্ডা হবে না । 

ভদ্রলােক তৃষ্ণার্তের মতােই পানির গ্লাস শেষ করে দ্বিতীয় গ্রাস চাইলেন। মিসির আলি বললেন, আরেক গ্লাস দেব? 

আর লাগবে না। আপনি তাহলে শুরু করুন। আপনার মেয়ের নাম কী? তিন্নি। বলুন তিন্নির কথা। 

ভদ্রলােক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সম্ভবত মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন। কিংবা বুঝে উঠতে পারছেন না ঠিক কোন্ জায়গা থেকে শুরু করবেন। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন ভদ্রলােকের কপালে সূক্ষ্ম ঘামের কণা জমতে শুরু করেছে। মিসির আলি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, ন’বছর বয়েসী একটি মেয়ের এমন কী সমস্যা থাকতে পারে যা বলতে গিয়ে এমন অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়।

অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ

বলুন আপনার মেয়ের কথা বলুন। 

ভদ্রলােক বলতে শুরু করলেন। আমার মেয়ের নাম তিন্নি। 

ওর বয়স ন’ বছর। মেয়ের জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। মেয়েটিকে আমি নিজেই মানুষ করি। আমি মােটামুটিভাবে একজন সচ্ছল মানুষ। কাজেই আমার পক্ষে বেশকিছু কাজের লােকজন রাখা কোনাে সমস্যা ছিল না। তিন্নিকে দেখাশােনার জন্যে অনেকেই ছিল। কিন্তু তবু মেয়েটির বেশিভাগ দায়িত্ব আমি পালন করেছি। দুধ বানানাে, খাওয়ানাে, ঘুম পড়ানাে—সবই আমি করতাম। বুঝতেই পারছেন মেয়েটি আমার খুবই আদরের। সব বাবার কাছেই তাদের ছেলেমেয়ের আদর থাকে কিন্তু আমার মধ্যে বাড়াবাড়ি রকমের ছিল। 

মিসির আলি বললেন, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এখন নেই? 

ভদ্রলোেক এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তার মেয়ের কথা বলে যেতে লাগলেন। তিনি এমন একটি ভঙ্গি করলেন যেন প্রশ্নটি শুনতে পান নি। 

তিন্নির বয়স যখন এক বৎসর তখন লক্ষ্য করলাম ও অন্যান্য শিশুদের মতাে নয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *