কী হচ্ছে আপনি আমাকে বলুন । এবং আমি কী করব সেটা আমাকে বলুন। আমার শরীরও বেশি ভালাে না। ব্লাডপ্রেশার আছে, ইদানীং সুগারের প্রবলেম দেখা দিয়েছে। রাতের পর রাত ঘুমুতে পারি না।
মিসির আলি দৃঢ় গলায় বললেন, হাল ছেড়ে দেবার মতাে এখনাে কিছু হয়নি। হালই তাে নেই। হাল ধরবেন কীভাবে? বরকত সাহেব উঠে পড়লেন। বাকি রাতটা মিসির আলি জেগেই কাটালেন । অন্ধকার ঘরে শুয়ে-শুয়ে সমস্ত ব্যাপারটা গুছাতে চেষ্টা করলেন। জিগ স পাজল’ একটির সঙ্গে অন্যটির কিছুতেই মিলে না। তবু কি কিছু একটা দাড়া করানাে যায় না?
একটা পর্যায়ে জীবনকে প্রকৃতি দু-ভাগে ভাগ করলেন প্রাণী এবং উদ্ভিদ। প্রাণীরা ঘুরে বেড়াতে পারে, উদ্ভিদ পারে না। পরবর্তী সময়ে প্রাণের বিকাশ হল। ক্রমে ক্রমে জন্ম হল অসাধারণ মেধাসম্পন্ন প্রাণী মানুষ। এই বিকাশ শুধু প্রাণীর ক্ষেত্রে হবে কেন? কেন উদ্ভিদের বেলায়ও হবে না?
ধরা যাক উদ্ভিদের বেলায়ও বিকাশ হল। একসময় জন্ম হল এমন একশ্রেণীর উদ্ভিদ, অসাধারণ যাদের মেধা। এই পৃথিবীতে হয়তাে হল না, হল অন্য কোনাে গ্রহে। একটি উন্নত প্রাণী খুঁজে বেড়াবে অন্য উন্নত জীবনকে। কারণ তারা চাইবে তাদের আহরিত জ্ঞান অন্যকে জানাতে। তখন তারা কি চেষ্টা করবে না ভিন জাতীয় প্রাণের সঙ্গে যােগাযােগের? সেই যােগাযােগের মাধ্যম হিসাবে এমন একটি প্রাণ’ তার দরকার যে একই সঙ্গে মানুষ এবং উদ্ভিদ। এ জাতীয় একটি প্রাণ সে তৈরী করতে চেষ্টা করবে। তার জন্যে তাকে ডিএনএ অণুর পরবর্তন ঘটাতে হবে। প্রথমে পরীক্ষাতেই সে তা পারবে না। পরীক্ষাটি তাকে করতে হবে বার বার।
অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ
তিন্নি কি এ-রকম একজন কেউ? মহাজ্ঞানী উদ্ভিদগােষ্ঠীর পরীক্ষার একটি বস্তু? মানুষ যদি উদ্ভিদ নিয়ে, ইঁদুর নিয়ে, ল্যাবরেটরিতে নানান ধরনের পরীক্ষা করতে পারে
ওরা কেন পারবে না?
কিন্তু তারা পরীক্ষাটা করছে কীভাবে? একজন মানুষ ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের গায়ে একটি সিরিঞ্জে করে রিএজেন্ট ঢুকিয়ে দিতে পারে। কিন্তু উদ্ভিদ কি তা পারবে?
হয়তাে পারবে। মাইক্রওয়েভ রশি দিয়ে আমরা দূর থেকে যন্ত্র চালু করতে পারি, ওদের হাতেও হয়তাে তেমন ব্যবস্থা আছে।।
মিসির আলি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসলেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে। বাগানটিকে ভারি সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়।
আপনি আজ আর ঘুমুলেন না, তাই না? মিসির আলি চমকে উঠলেন। তিন্নির গলা।
তুমিওতাে দেখছি জেগে আছ। হ্যা আমি জেগেই থাকি।
মিসির আলি কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। এ জাতীয় কথাবার্তায় তিনি এখন অভ্যস্ত। আগের মতাে অস্বস্তি বােধ হয় না। বরঞ্চ মনে হয় এইতাে স্বাভাবিক। বরঞ্চ কথা বলার এই পদ্ধতি অনেক সুন্দর। মুখােমুখি এসে বসার দরকার নেই। দুজন দুজায়গায় থেকে কথা বলে চমৎকার সময় কাটানাে।
তিনি, আমি যে এতক্ষণ তােমার বাবার সঙ্গে গল্প করলাম সেটা কি তুমি জানাে?
হা জানি। সব কথা শুনেছি। আমি তােমাকে নিয়ে যা ভেবেছি তাও নিশ্চয়ই জানাে ? হ্যা তাও জানি। সব জানি। আমি কি ঠিক পথে এগুচ্ছি? অর্থাৎ আমার থিওরি কি ঠিক আছে? কিছু কিছু ঠিক। বেশির ভাগই ঠিক না।
কোন জিনিসগুলি ঠিক না, সেটা কি আমাকে বলবে?
বলব না। কেন বলবে না?
তিন্নি জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, তুমি কি চাও না আমি তােমাকে সাহায্য করি?
চাই না। একসময় কিন্তু চেয়েছিলে। তখন খুব ভয় লাগত, এখন লাগে না।
মিসির আলি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর খুব শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বুঝতে পারছ তােমার মধ্যে একটি পরিবর্তন হচ্ছে, তুমি বদলে যাচ্ছ । শেষ পর্যন্ত কী হবে তুমি কি জানাে?
জানি। তুমি কি আমাকে তা বলবে? না।
আচ্ছা এইটুকু বল তুমি কি একমাত্র মানুষ যার উপর এই পরীক্ষাটি হচ্ছে? না তুমি ছাড়াও আরাে অনেককে নিয়ে এ-রকম হয়েছে বা হচ্ছে।
অনেককে নিয়েই হয়েছে। এবং হচ্ছে। এবং এবং…।। বল আমি শুনছি ।। এমন একদিন আসবে পৃথিবীর সব মানুষ এ-রকম হয়ে যাবে। তার মানে?
তখন কত ভালাে হবে তাই না? মানুষের কোনাে খাবারের কষ্ট থাকবে না। মানুষ কত উন্নত প্রাণী কিন্তু সে তার সবটা সময় নষ্ট করে খাবারের চিন্তায়। এই সময়টা সে নষ্ট করবে না। কত জিনিস সে জানবে। আরাে কত ক্ষমতা হবে তার।
কী হবে এতকিছু জেনে? তিন্নি খিলখিল করে হেসে উঠল। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?
হাসি আসছে তাই হাসছি। মানুষ তাে এখনাে কিছুই জানে না আর আপনি বলছেন কী হবে এত জেনে।
তুমি বুঝি অনেক কিছু জেনে ফেলেছ?
হ্যা।
অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ
কী কী জানলে বল । তা বলব না। আপনি এখন ঘুমুতে যান। আমার ঘুম পাচ্ছে না, আমি আরাে কিছুক্ষণ কথা বলব তােমার সঙ্গে।
না আপনি আর কথা বলবেন না। আপনি এখন ঘুমুবেন এবং সকালে উঠে ঢাকা চলে যাবেন। আর কখনাে আসবেন না।
আসব না মানে? ইচ্ছা করলেও আসতে পারবেন না। আমার কথা কিছুই আপনার মনে থাকবে না।
কী বলছ তুমি? আপনাকে আমার দরকার নেই।
তিনি হাসতে লাগল। মিসির আলি সারারাত বারান্দায় বসে রইলেন। অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হতে লাগল মেয়েটি যা বলছে তাই হবে।
মানুষ যখন কোনাে জটিল এক্সপেরিমেন্ট করে তার সাবধানতার সীমা থাকে না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে যেন তার এক্সপেরিমেন্ট নষ্ট না হয়। কেউ এসে যেন তা ভণ্ডুল না করে দেয়। যারা এই ছােট্ট মেয়েটিকে নিয়ে এই ভয়াবহ এক্সপেরিমেন্ট করছে তারাও তাই করবে। কে রক্ষা করবে মেয়েটিকে।
ভােররাতের দিকে মিসির আলির শরীর খারাপ লাগতে লাগল। তার কেবলি মনে হল ঢাকায় কী যেন একটা কাজ ফেলে এসেছেন। খুব জরুরি কাজ। এক্ষুনি ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু কাজটি কী তা মনে পড়ছে না। তিনি ভাের আটটায় ঢাকা রওনা হয়ে গেলেন। বরকত সাহেব বা তিনি কারাে কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নিলেন না।
তিন্নির ব্যাপারটা নিয়ে বড় বড় খাতায় গাদাগাদা নােট করেছিলেন। সব ফেলে গেলেন, কিছুই সঙ্গে নিলেন না।