ঢাকায় পৌঁছার আগেই প্রচণ্ড জ্বরে জ্ঞান হারালেন ।
ট্রেনের একজন সহযাত্রী দয়াপরবশ হয়ে তাকে পৌছে দিলেন ঢাকা মেডিকেলে। তিনি প্রায় দুমাস অসুখে ভুগলেন। সময়টা কাটল একটা ঘােরের মধ্যে। পুরােপুরি সুস্থ হতে তাঁর আরাে দুমাস লাগল।
কিন্তু পুরােপুরি বােধহয় সুস্থ হলেনও না। কিছু কিছু জিনিস তিনি মনে করতে পারেন না। যেমন একদিন অমিতা তাঁকে দেখতে এসে বলল, তুমি শুধু আজেবাজে কাজে ছুটাছুটি কর তারপর একটা অসুখ বাঁধাও । সেইবার হঠাৎ কুমিল্লা এসে উপস্থিত। যেভাবে হঠাৎ আসা সেইভাবে হঠাৎ বিদায়। আমিতাে ভেবেই পাই না…।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কুমিল্লা। কুমিল্লা কেন যাব? সেকি ! তােমার মনে নেই? নাতাে।
তুমি মামা একটা বিয়ে টিয়ে করে সংসারী হও। নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে একবার এক ভদ্রলােকের সঙ্গে দেখা। তিনি রাগী গলায় বললেন, যাক আপনার দেখা পাওয়া গেল। বইগুলি তাে ফেরত দিলেন না। কেন?
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী বই?
কী বই মানে? বােটানির দুটি বই নিয়ে গেলেন না আমার কাছে থেকে! তাই নাকি?
আবার বলছেন তাই নাকি। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ডা. জাবেদ।
আমিতাে ঠিক…। মিসির আলি খুবই বিব্রতবােধ করলেন কিন্তু কিছুই করার নেই ।
এর প্রায় এক বৎসর পর মিসির আলি ময়মনসিংহের এক এডভােকেটের কাছ থেকে এক চিঠি পেলেন। চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে বরকতউল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ী ময়মনসিংহ শহরের বাড়ি মিসির আলিকে দান করেছেন। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কিছু টাকাও ব্যাংকে জমা আছে। টাকার অঙ্কটি অবশ্য উল্লেখ করা হয় নি। মিসির
আলি ভেবেই পেলেন না অপরিচিত এক দ্রলােক শুধু শুধু তাঁকে বাড়ি দেবেন কেন? | সেই বাড়ি দেখেও তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিশাল বাড়ি। এ্যাডভােকেট ভদ্রলােক গম্ভীরমুখে বললেন, বাড়ি অনেকদিন তালাবন্ধ আছে। বাগানের অবস্থা দেখেন
জঙ্গল হয়ে আছে।
অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি বললেন, আমাকে বাড়িটা কেন দেয়া হয়েছে সেটাইতাে বুঝতে পারছি না।
এ্যাডভােকেট ভদ্রলােক বিরক্ত মুখভঙ্গি করলেন। মােটা গলায় বললেন, দিচ্ছে যখন নিন। ইচ্ছা করলে বিক্রি করে দিতে পারেন। ভালাে দাম পাবেন। আমার কাছে কাস্টমার আছে। ক্যাশ টাকা দেবে।
মিসির আলি বাড়ি বিক্রি করার ব্যাপারে তেমন কোনাে আগ্রহ দেখালেন না। ক্লান্ত গলায় বললেন, আগে দেখি বাড়িটা আমাকে কেন দেয়া হল। আজকালকার দিনে কেউতাে আর শুধু শুধু এ-রকম দান খয়রাত করে না! দানপত্রে কি কিছুই লেখা নেই?
তেমন কিছু না। শুধু বাগানের প্রতিটি গাছের যথাসম্ভব যত্ন নেবার জন্যে অনুরােধ করা হয়েছে। উইলের কপি তাে পাঠিয়েছি আমি আপনাকে।
মিসির আলি বাড়ি তালাবন্ধ করে ঢাকা ফিরে এলেন। বরকতউল্লাহ লােকটি সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য জোগাড় করলেন। জানতে পারলেন যে এর একটি অসুস্থ মেয়ে ছিল । মেয়েটির মাথার ঠিক ছিল না। মেয়েটি মারা যাবার পর ঐ বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতরই তার কবর হয়। ভদ্রলােক নিজেও অল্পদিন পর মারা যান। কিন্তু এর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। জগতে রহস্যময় ব্যাপার এখনাে তাহলে ঘটে।
পাচ বছর পরের কথা।
মিসির আলি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ময়মনসিংহে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম। নীলু, হাসিখুশি ধরনের একটি মেয়ে। খুব সহজেই অবাক হয়, অল্পতেই মন খারাপ করে, আবার সামান্য কারণেই মন ভালাে হয়ে যায়।।
ময়মনসিংহে আসার নীলুর কোনাে ইচ্ছা ছিল না। আসতে হয়েছে মিসির আলির আগ্রহে। তিনি বারবার বলেছেন, তােমাকে মজার একটা জিনিস দেখাব।
অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ
অনেক চেষ্টা করেও সেই মজার জিনিসটি সম্পর্কে নীলু কিছু জানতে পারে নি। মিসির আলি লােকটি কথা খুব কম বলেন। তিনি প্রশ্নের উত্তরে শুধু হেসে বলেছেন গেলেই দেখবে । খুব অবাক হবে।
নীলু সত্যি অবাক হল। চোখ কপালে তুলে বলল, এই বাড়িটা তােমার? বল কী? কে তােমাকে এই বাড়ি দিয়েছে?
দিতে হবে কেন, আমি বুঝি কিনতে পারি না?
পার না। তােমার এত টাকাই নেই। বরকত সাহেব বলে এক ভদ্রলােক দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন? ঐটা একটা রহস্য। রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছি । যখন করব তখন জানবে।
গভীর আগ্রহে নীলু বিশাল বাড়িটি ঘুরে-ঘুরে দেখল। বহুদিন এখানে কেউ ঢুকে নি, ভ্যাপসা, পুরানাে গন্ধ। দেয়ালে ঘন ঝুল। আসবাবপত্রে ধুলাের আস্তরণ। বাগানে ঘাস হয়েছে হাঁটু উঁচু। পেছনদিকটায় কচুগাছের জঙ্গল। মিসির আলি বললেন, এ তাে দেখছি ভয়াবহ অবস্থা। | নীলু বলল, যত ভয়াবহই হােক আমার খুব ভালাে লাগছে। বেশ কিছুদিন আমি এ বাড়িতে থাকব কী বল?
কী যে বল। এ বাড়ি এখন মানুষ বাসের অযােগ্য। মাস দু-এক লাগবে বাসের যােগ্য করতে।
তুমি দেখ না কী করি ।
কোমর বেঁধে ঘর গােছাতে লাগল নীলু। তার প্রবল উৎসাহ দেখে মিসির আলির কিছু বলতে মায়া লাগল । যেন এই মেয়েটি দীর্ঘদিন পর নিজের ঘর-সংসার পেয়েছে। আনন্দে উৎসাহে ঝলমল করছে। একদিনের ভেতর মালী লাগিয়ে বাগান পরিষ্কার করল। বাজার থেকে চাল ডাল কিনে রান্নার ব্যবস্থা করল। রাতে খাবার সময় চোখ বড় বড় করে বলল, জানাে এ বাড়ির ছাদ থেকে পাহাড় দেখা যায়। নীল পাহাড়ের সারি। কী যে অবাক হয়েছি পাহাড় দেখে ।।
অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ
পাহাড়ের নাম হচ্ছে গারাে পাহাড়।
আজ অনেকক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখলাম । মালী বাগানে কাজ করছিল আমি পাহাড় দেখছিলাম।
ভালাে করেছ।
ও ভালাে কথা, বাগানে খুব অদ্ভুত ধরনের একটা গাছ আছে। ভােরবেলা তােমাকে দেখাব। কোনাে অর্কিড টর্কিড হবে। হলুদ রঙের লতানাে গাছ। মেয়েদের চুলে
যে-রকম বেণী থাকে সে-রকম বেণী করা। নীল নীল ফুল ফুটেছে।
মিসির আলি তেমন কোনাে উৎসাহ দেখালেন। নীলু বলল, আচ্ছা এই বাড়িতে থেকে গেলে কেমন হয়?
কী যে বল! ঢাকায় কাজকর্ম ছেড়ে এখানে থাকব?
আমি থাকি? তুমি সপ্তাহে সপ্তাহে এখানে থাকবে। আমার কোনাে অসুবিধা হবে । আমার এ বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।