অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-৩)

সাধারণত এক বৎসর বয়সেই শিশুরা কথা বলতে শুরু করে। তিন্নির বেলা তা হল না। সে কথা বলা শিখল না। বড় বড় ডাক্তাররা সবাই দেখলেন। তারাও কোনাে কারণ বের করতে পারলেন না। মেয়েটি কানে শুনতে পায়। তার ভােকাল-কর্ড ঠিক আছে। কিন্তু কথা বলে না। কেউ কিছু বললে মন দিয়ে শুনে— এই পর্যন্তই।অন্যভুবন

ই এন টি স্পেশালিস্ট প্রফেসর আলম বললেন— অনেক বাচ্চারাই দেরিতে কথা শেখে। এর বেলাও তাই হচ্ছে। দেরি হচ্ছে। আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে দিনরাত কথা বলবেন। ও শুনে, শুনে শিখবে। 

আমি প্রফেসর আলমের পরামর্শমতাে প্রচুর কথা বলতাম। গল্প পড়ে শুনাতাম। সিনেমায় নিয়ে যেতাম। কিন্তু কোনাে লাভ হল না। মেয়েটি একটি কথাও বলল না। 

ওর যখন ছ’বছর বয়স তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। দিনটি আমার পরিষ্কার মনে আছে । জুলাই মাসের তিন তারিখ, শুক্রবার। আমি দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমুচ্ছি। শরীরটা ভালাে যাচ্ছিল না। জ্বর-জ্বর ভাব। হঠাৎ তিনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগাল। এবং পরিষ্কার গলায় বলল, বাবা অসময়ে ঘুমুচ্ছ কেন? 

আপনি বুঝতেই পারছেন আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। প্রথমে ভাবলাম স্বপ্ন দেখেছি। তিনি কথা বলেছে। একটি দুটি শব্দ নয়, পুরাে বাক্য বলছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলছে। কোনােরকম জড়তা নয়, অস্পষ্টতা নয়। বিস্ময় সামলাতে 

আমার দীর্ঘ সময় লাগল। আমি একসময় বললাম, তুই কথা বলা জানিস? 

তিন্নি হাসিমুখে বলল, হঁা। কেন জানব না? 

এতদিন কথা বলিসনি কেন? 

তিন্নি তার জবাব দিল না। ঠোট টিপে হাসতে লাগল। যেন সে খুব মজা পাচ্ছে । এটা যেন চমৎকার একটা রসিকতা, কথা না বলে বাবাকে বােকা বানানাে। 

মিসির আলি সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে আমার সময় লাগল । তবে আমি ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। আমি কোনাে কিছু নিয়েই হৈচৈ শুরু করি না। প্রথমে নিজে বুঝতে চেষ্টা করি। কিন্তু তিন্নির ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝলাম না। হঠাৎ করে কথা বলা শুরু করা ছাড়াও তার মধ্যে অনেক বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা ছিল। 

এই পর্যন্ত বলেই বরকতউল্লাহ সাহেব থামলেন। পানি খেতে চাইলেন। মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বরকতউল্লাহ সাহেব নিচুগলায় আবার কথা শুরু করলেন। 

আমি লক্ষ্য করলাম তিনি সব প্রশ্নের জবাব জানে। 

মিসির আলি বললেন, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। সব প্রশ্নের জবাব জানে মানে? 

আপনাকে উদাহরণ দিলে ভালাে বুঝবেন। ধরুন আমি তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম মােলর বর্গমূল কত? সে একমুহূর্ত ইতস্তত না করে বলবে চার’। যদিও সে অঙ্কের কিছুই জানে না। যে মেয়ে কথা বলতে পারে না তাকে অঙ্ক শেখানাের প্রশ্নই ওঠে না। 

আপনাকে আরেকটি উদাহরণ দেই। একদিন বাসায় ফিরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, বল্ তাে মা আজ নয়াবাজারে কার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, হালিম সাহেবের সঙ্গে। 

হালিম আমার বাল্যবন্ধু । তিনি তাকে চেনে না। তার সঙ্গে আমার মেয়ের কোনাে দিন দেখা হয়নি। হালিমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে এটা তিন্নির জানার কোনাে কারণ নেই। মিসির আলি সাহেব, বুঝতেই পারছেন আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তার কিছুদিন পর আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। 

রাতের বেলা তিন্নিকে নিয়ে খেতে বসেছি। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমি হারিকেন জ্বালানাের জন্যে বললাম । কেউ হারিকেন খুঁজে পেল না। প্রয়ােজনের সময় 

কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না । টর্চ আনতে বললাম, তাও কেউ পাচ্ছে না। আমি বিরক্ত হয়ে ধমকাধমকি করছি । তখন তিন্নি বলল, বাতি চলে গেলে সবাই এত হৈ চৈ করে কেন? 

আমি বললাম, অন্ধকার হয়ে যায় তাই । অন্ধকার হলে কী অসুবিধা? অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না সেটাই অসুবিধা। তুমি দেখতে পাও না? শুধু আমি কেন কেউই পায় না। আলাে ছাড়া কিছুই দেখা যায় না মা। 

তিন্নি খুবই অবাক হল, বিস্মিত গলায় বলল, কিন্তু আমি তাে অন্ধকারেও দেখতে পাই। আমি তাে সবকিছু দেখছি! 

প্রথম ভাবলাম সে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু না, ঠাট্টা নয়। সে সত্যিকথাই বলছিল। সে অন্ধকারে দেখে। খুব পরিষ্কার দেখে। 

বরকতউল্লাহ সাহেব থামলেন। রুমাল বের করে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে লাগলেন। 

মিসির আলি বললেন, আপনার মেয়ের প্রসঙ্গে আরাে কিছু কি বলবেন? তিনি -সূচক মাথা নাড়লেন। 

আর কিছুই বলার নেই? আছে। কিন্তু এখন আপনাকে বলতে চাই না। কখন বলবেন? 

প্রথম আপনি আমার মেয়েকে দেখবেন। ওর সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আপনাকে বলব। 

ঠিক আছে। আপনার মেয়ের এখন বয়স হচ্ছে নয়। মেয়ের অস্বাভাবিকতাগুলি তাে আপনার অনেক আগেই চোখে পড়েছে। কোনাে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন? 

ডাক্তার এর কী করবে? কোনাে সাইকিয়াট্রিস্ট? না। আপনিই প্রথম ব্যক্তি যার কাছে আমি এসেছি। মেয়ের এই ব্যাপারগুলি আপনি মনে হচ্ছে লুকিয়ে রাখতে চান। হ্যা চাই । কেন চাই তা আপনি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন। আপনি মেয়ের মা সম্পর্কে কিছু বলুন। কী জানতে চান? 

জানতে চাই উনি কেমন মহিলা ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনােরকম অস্বাভাবিকতা ছিল কি না। 

ছিল না। উনি খুবই স্বাভাবিক মহিলা ছিলেন। | আপনি ভালােমতাে জানেন? 

হ্যা ভালােমতােই জানি। আমি এগার বছর আমার স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়েছি। তিনি আমাদের শেষ বয়সের সন্তান। এগার বছরে একজন মানুষকে ভালােমতাে জানা যায়।। 

তা জানা যায় । আচ্ছা, আপনার মেয়ের এই ব্যাপারগুলি কি বাইরের অন্য কাউকে বলেছেন? 

না, কাউকেই বলিনি। আপনি বুঝতেই পারছেন এটা জানাজানি হওয়া মাত্রই একটা হৈচৈ শুরু হবে । পত্রিকার লােক আসবে, টিভির লােক আসবে। আমি ভাবলাম কিছুতেই এটা করতে দেয়া উচিত হবে না। এখন মিসির আলি সাহেব, দয়া করে বলুন—আপনি কি আমার মেয়েটাকে দেখবেন? 

হ্যা দেখব। কবে যাবেন ময়মনসিংহ? আপনি কবে যাবেন? 

আমি আগামীকাল রাতে যাব। রাত দশটায় একটা ট্রেন আছে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস। 

মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, আমি আপনার সঙ্গেই যাব। বরকতউল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমার সঙ্গে যাবেন? হ্যা আপনার সঙ্গে যাব। কোনাে অসুবিধে হবে? 

বরকতউল্লাহ সাহেব মাথা নাড়লেন। কোনাে অসুবিধা হবে না। এই লােকটিকে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যে প্রথমে তার কথাই শুনতে চায় নি সে এখন…। কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষ আছে এই পৃথিবীতে। 

 এ ‘ পড়েছিল। 

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। আঁধার হয়ে আসছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *