দোতলায় কেউ নেই। কেউ থাকে না কখনাে। এ বাড়ির সব মানুষজন থাকে। একতলায়। তিনি যখন কাউকে ডাকে তখনি সে আসে, তার আগে কেউ আসে না । তিন্নির কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। সে জানালার পাশে গিয়ে বসল। এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তা দিয়ে লােকজন যাওয়া-আসা করছে। নানান ধরনের মানুষ।
কারাের সঙ্গে কারাের কোনাে মিল নেই। কত মজার মজার কথা একেকজন ভাবছে। কিন্তু ওরা কেউ জানে না তিন্নি সব বুঝতে পারছে। এইতাে একজন মােটা লােক যাচ্ছে। তার হাতে একটা ছাতা। শীতের সময় কেউ ছাতা নিয়ে বের হয়? ছাতাটা কেমন অদ্ভুতভাবে দোলাচ্ছে লােকটা। এবং মনে মনে ভাবছে বাড়ি পৌঁছেই গরম পানি দিয়ে গােসল করে ঘুমুবে। শীতের দিনের সন্ধ্যাবেলায় কেউ ঘুমায়? লােকটার মনে খুব আনন্দ। কারণ সে হঠাৎ করে অনেক টাকা পেয়েছে। কেউ দিয়েছে তাকে। যে দিয়েছে তার নাম রহমত মিয়া।
বুড়ােলােকটি চলে যেতেই রােগা একটা মানুষকে দেখা গেল। সে খুব রেগে আছে। কাকে যেন খুব গাল দিচ্ছে। এমন বাজে গাল যে শুনলে খুব রাগ লাগে। তিন্নি জানালা বন্ধ করে দিল।
অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ
ঘরটা এখন অন্ধকার। অন্ধকারে কেউ কিছু দেখতে পায় না। কিন্তু সে পায়। কেউ অন্ধকারে দেখতে পায় না, সে পায় কেন? সে কেন অন্য মানুষদের মতাে নয়? কেন সবাই তাকে ভয় পায়? এই-যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, কিন্তু কেউ তার কাছে আসছে না। যতক্ষণ সে না-ডাকবে ততক্ষণ আসবে না। এলেও খুব ভয়ে ভয়ে আসবে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলবে তিন্নি আপা। তিনি আপা!! এমন রাগ লাগে। রাগ হলে তিন্নির সবাইকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে। তখন তার কপালের বাঁ পাশে চিনচিনে ব্যথা হয়। ব্যথা হলেই রাগ আরাে বেড়ে যায়। রাগ বাড়লে ব্যথা বাড়ে। কী
কষ্ট! কী কষ্ট!!
তিন্নি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল এবং রিনরিনে গলায় ডাকল—নাজিম, নাজিম। নাজিমের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। তিন্নি তাকে দেখতে পাচ্ছে না। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি পেছনের দিকে। কিন্তু তবু তিন্নি পরিষ্কার বুঝতে পারছে নাজিম রেলিং ধরে ধরে উপরে আসছে, তার হাতে একগ্লাস দুধ। নাজিম তার জন্যে দুধ আনছে। কী বিশ্রী ব্যাপার। সে দুধ চায় নি তবু আনছে । এমন গাধা কেন লােকটা?
অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ
তিন্নি আপা।
তিন্নি তাকাল না । নাজিম সিড়ির মাথায় দাড়িয়ে আছে । ভয় পাচ্ছে খুব। ভয়ে তার পা কাপছে।
দুধ এনেছেন কেন? দুধ খাব না।
অন্য কিছু খাবেন আপা?
কিছু খাব না। জ্বি আচ্ছা। বাবা কবে আসবে আপনি জানেন?
জানি না আপা। বাবা কাল সকালে আসবে। একা আসবে না। একটা লােককে নিয়ে আসবে।
নাজিম কিছু বলল না। তিন্নি কাটা-কাটা গলায় বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তাই না?
করছি আপা। আমি সবকিছু বুঝতে পারি । আমি জানি আপা। আপনি আমাকে ভয় করেন কেন? আমি ভয় করি না আপা।
না করেন। আপনারা সবাই আমাকে ভয় করেন। আপনি করেন, আবুর মা করে, দারােয়ান করে, সবাই ভয় করে । যান আপনি চলে যান।
দুখ খাবেন না?
খাব না। কিছু খাব না। বাতি জ্বালিয়ে দেই?
বাতি জ্বালাতে হবে না। জ্বি আচ্ছা। আমি যাই আপা?
অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ
আপনি যেতে পারবেন না। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন। নাজিম দাঁড়িয়ে রইল। তিন্নি তার ঘরে ঢুকে ছবি আঁকতে বসল। ঘর এখন নিকষ অন্ধকার কিন্তু তাতে তার কোনাে অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারেই বরং রংগুলি পরিষ্কার দেখা যায়। তিনি অতি দ্রুত ব্রাশ চালাচ্ছে। ভালাে লাগছে না। কিছু ভালাে লাগছে না। কান্না পাচ্ছে। সে তার রংগুলি দূরে সরিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
নাজিম ভীত গলায় বলল, কী হয়েছে তিন্নি আপা? তিন্নি তীক্ষ্ণস্বরে বলল, কিছু হয়নি আপনি চলে যান। নাজিম অতি দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে গেল। যেন সে পালিয়ে বেঁচেছে।
তারা ময়মনসিংহ এসে পৌছলেন ভাের রাতে । তখনাে চারদিক অন্ধকার। কিছুই দেখার উপায় নেই। মিসির আলির মনে হল বিশাল একটি রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গাছগাছালিতে চারদিক ঢাকা। বারান্দায় অল্প পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলছে। তাতে চারদিকের অন্ধকার আরাে গাঢ় হয়েছে। মিসির আলি বললেন, রাজবাড়ি বলে মনে হচ্ছে।
বরকত সাহেব শীতল গলায় বললেন, একসময় ছিল। সুসং দুর্গাপুরের মহারাজার বাড়ি। আমি কিনে নিয়েছি।
দারােয়ান গেট খােলা মাত্র ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। অনেক লােকজন বেরিয়ে এল। সবাই ভত্যশ্রেণীর। আজকালকার যুগেও যে এতজন কাজের লােক থাকতে পারে তা মিসির আলি ধারণা করেন নি। তিনি লক্ষ্য করলেন এরা কেউ তিনি মেয়েটির উল্লেখ করছে না। মেয়ের বাবাও মেয়ে সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। অথচ জিজ্ঞেস করাটাই স্বাভাবিক ছিল।
বরকত সাহেব বললেন, আপনি যান বিশ্রাম করুন। সকালবেলা আপনার সঙ্গে কথা হবে।
কালাে মতাে লম্বা একটি ছেলে তার ঘর দেখিয়ে দিল ।
অন্যভুবন- হুমায়ূন আহমেদ
একতলার একটি কামরা, পুরােনাে দিনের কামরাগুলি যেমন হয়-দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বিশাল। বিরাট দক্ষিণমুখী জানালা। ঘরের আসবাবপত্র সবই দামি ও আধুনিক। খাটে ছ-ইঞ্চি ফোমের তােশক। রকিং চেয়ার। মেঝেতে দামি স্যায় কার্পেট। মফস্বল শহরে এসব জিনিস ঠিক আশা করা যায় না।
বাথরুমে ঢুকে মিসির আলি আরাে অবাক হলেন। ওয়াটার হিটারের ব্যবস্থা আছে । চমৎকার বাথটাব। মিসির আলির মনে হল অনেকদিন এ ঘরে বা বাথরুমে কেউ আসে নি। এমন চমৎকার একটি গেস্টরুম এরা শুধু-শুধু বানিয়ে রেখেছে।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু গরম পানির ব্যবস্থা যখন আছে তখন একটা হট শাওয়ার নেয়া যেতে পারে। মিসির আলি দীর্ঘ সময় নিয়ে গােসল সারলেন। শরীর ঝরঝরে লাগছে। এক কাপ গরম চা পেলে বেশ হত।