বাথরুম থেকে বের হয়েই দেখলেন টেবিলে চায়ের আয়ােজন। পট ভর্তি চা, প্লেটে নােনতা বিসকিট, কুচিকুচি করে কাটা পনির। ভৃত্যশ্রেণীর একজন যুবক তাঁকে ঢুকতে দেখেই চা ঢালতে শুরু করল। তিনি লক্ষ্য করলেন লােকটি আড়চোখে তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়া মাত্র, চট করে মাথা নামিয়ে নিচ্ছে।
তােমার নাম কী ? নাজিম। শুধু নাজিম? নাজিমুদ্দিন। কতদিন ধরে এ বাড়িতে আছ? জ্বি অনেক দিন । অনেক দিন মানে কত দিন?
পাঁচ বছর । এ বাড়িতে কজন মানুষ থাকে?
নাজিম জবাব দিল না। চায়ের কাপে চিনি ঢেলে এগিয়ে দিল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে এখন চলে যাবে। মিসির আলি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে কজন মানুষ থাকে?
জ্বি না স্যার আমি জানি না। বরকত সাহেব এবং তার মেয়ে এই দুজন ছাড়া আর কজন মানুষ থাকে? আমি স্যার কিছুই জানি না।
মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। আর কোনাে প্রশ্ন করলেন না। চায়ে চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরালেন। তিনি সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছেন সেটা মনে
রইল না। এই লােকটি কোনােকিছু বলতে চাচ্ছে না কেন? বাধা কোথায়?
নাজিম মৃদুস্বরে বলল, স্যার বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিবেন?
, আমি অসময়ে ঘুমুব না। সকালের নাস্তা দেওয়া হবে সাড়ে সাতটায়। ঠিক আছে।
আসি স্যার, পাশের ঘরেই আছি। দরকার হলে কলিংবেল টিপবেন। দরজার কাছে কলিংবেল আছে।
তিনি মাথা নাড়লেন। কিছু বললেন না। ঘড়িতে বাজছে পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ । আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ব্রহ্মপুত্র নদী নিশ্চয়ই খুব কাছে। ভােরবেলা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে ভালাে লাগবে। এই শহরে এর আগে তিনি আসেন নি। অপরিচিত শহরে ঘুরে বেড়াতে চমৎকার লাগে।
গেট বন্ধ। গেটের পাশের খুপরি ঘরটায় দারােয়ান নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। মিসির আলি উঁচু গলায় ডাকলেন দারােয়ান, দারােয়ান গেট খুলে দাও।
দারােয়ান বেরিয়ে এল কিন্তু গেট খুলল না। যেন সে কথা বুঝতে পারছে না। গেট খুলে দাও, আমি বাইরে যাব। গেট খােলা যাবে না। খােলা যাবে না মানে? কেন যাবে না? বড় সাহেবের হুকুম ছাড়া ভােলা যাবে না। তার মানে? কী বলছ তুমি? এটা কি জেলখানা নাকি?
দারােয়ান কোনাে উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। যেন মিসির আলির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার ব্যাপারে তার কোনাে আগ্রহ নেই।
তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন একা-একা। তাঁর সামনে ভারী লােহার গেট। সমস্ত বাড়িটিকে যে পাঁচিল ঘিরে রেখেছে তাও অনেকখানি উঁচু। সত্যি সত্যি জেলখানা জেলখানা ভাব। মিসির আলি আবার ডাকলেন– দারােয়ান দারােয়ান। কেউ বেরিয়ে এল না। ভাের সাতটা পর্যন্ত মিসির আলি বাড়ির সামনের বাগানে চিন্তিতমুখে ঘুরে বেড়ালেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেন। এই বাড়িটি গাছগাছালিতে ভর্তি। কিন্তু কোনাে গাছে পাখি ডাকছে না। শুধু যে ডাকছে না তাই নয়, কোনাে গাছে পাখি বসে পর্যন্ত নেই! অথচ ভােরবেলার এই সময়টায় পাখির কিচির-মিচিরে কান ঝালাপালা হবার কথা। অথচ চারদিক কেমন নীরব। থমথমে।
স্যার আপনার নাস্তা দেয়া হয়েছে। কোথায়?
দোতলায়। চল যাই।
আমি যাব না ন্যার । আপনি একা একা যান। ঐ যে সিঁড়ি ।
মিসির আলি বললেন, কেমন আছ তিন্নি? সিড়িতে পা রেখেই মিসির আলি থমকে দাঁড়ালেন। সিঁড়ির মাথায় একটি বালিকা দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি দারুণ রূপসী। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানাে চুল। টানা টানা চোখ। দেবী মূর্তির মতাে কাটা-কাটা নাক মুখ । মেয়েটি দাঁড়িয়েও আছে মূর্তির মতাে। একটুও নড়ছে না। চোখের দৃষ্টিও ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, কেমন আছ তিন্নি?
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, ভালাে আছি। আপনি ভালাে আছেন? হা ভালােই আছি । আপনাকে গেট খুলে দেয় নি। তাই না?
মিসির আলি উপরে উঠতে উঠতে বললেন, দারােয়ান ব্যাটা বেশি সুবিধার না। কিছুতেই গেট খুলল না।
দারােয়ান ভালােই। বাবার জন্য খুলে নি। বাবা গেট খুলতে নিষেধ করেছেন। তাই নাকি? হা। বাবার ধারণা গেট খুললেই আমি চলে যাব। তুমি বুঝি শুধু চলে যেতে চাও?
চাই না। কিন্তু বাবার ধারণা আমি চলে যেতে চাই। মেয়েটি আবার মাথা দুলিয়ে হাসল। মেয়েটি এই দারুণ শীতেও পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে আছে। খালি পা। মনে হচ্ছে সে শীতে অল্প-অল্প কাঁপছে।
তিন্নি তােমার শীত লাগছে না?
বল কী! এই প্রচণ্ড শীত, তােমার ঠাণ্ডা লাগছে না?
আপনি নাস্তা খেতে যান। বাবা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। দেরি হচ্ছে। দেখে মনে মনে রেগে যাচ্ছে।
তাই বুঝি? হ্যা তাই।
মেয়েটি হাঁটতে শুরু করল। ধবধবে সাদা রঙের ফ্রকে তাকে দেবশিশুর মতাে লাগছে। মিসির আলি মেয়েটির প্রতি গাঢ় মমতা বােধ করলেন। তার ইচ্ছে করল মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু এ মেয়ে হয়তাে এসব পছন্দ করবে না। একে দেখেই মেনে হচ্ছে এর পছন্দ-অপছন্দ খুব তীব্র।
নাশতার আয়ােজন প্রচুর।
রুটি মাখন থেকে শুরু করে চিকেন ফ্রাই ফিশ ফ্রাই সবই আছে। বিলেতি কায়দায় সবার সামনেই এক বাটি সালাদ। লম্বা লম্বা গ্লাসে কমলালেবুর রস। রাজকীয় ব্যাপার। শুধু খাবারদাবার এগিয়ে দেবার জন্যে কেউ নেই। বরকত সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বসে আছেন কেন? শুরু করুন।
তিন্নির জন্যে অপেক্ষা করছি।
ও আসবে না। আসবে না কেন? খেয়ে নিয়েছে। আমার মেয়ের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে? হ্যা। কেমন দেখলেন আমার মেয়েকে? ভালাে।