অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-৬) 

বরকত সাহেব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ! নিচুগলায় বললেন, ওর মধ্যে কি কোনাে অস্বাভাবিকতা আপনার নজরে পড়েছে? 

ভালাে করে ভেবে বলুন। ভেবেই বলছি । তবে পারিপার্শ্বিক কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করছি। যেমন? 

যেমন আপনার গাছগুলিতে কোনাে পাখি নেই। একটি পাখিও আমার চোখে পড়ে নি। 

অন্যভুবনবরকত সাহেব চমকালেন না। তার মানে তিনি ব্যাপারটি আগেই লক্ষ্য করেছেন। আগে লক্ষ্য না করলে নিশ্চয়ই চমকাতেন। অর্থাৎ মানুষটির পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালাে। 

এই জিনিসটি চট করে কারাের চোখে পড়বে না। মিসির আলি বললেন, এ ছাড়াও অন্য একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। 

বলুন শুনি। আপনার বাড়ির কাজের লােকটি যার নাম নাজিম সে অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত। এটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এ বাড়ির সবাই আমাকে ভয় করে। কেন? 

পৃথিবীর নিয়মই হচ্ছে ক্ষমতাবানকে ভয় করা। আমি ক্ষমতাবান। ক্ষমতাটা কিসের? অর্থের। অর্থের ক্ষমতাই সবচে বড় ক্ষমতা। আপনার ধারণা যেহেতু আপনার প্রচুর টাকা সেহেতু সবাই আপনাকে ভয় করে? অন্য কারণও আছে। আমি বেশ বদমেজাজি। আপনার মেয়ে তিন্নি, সেও কি বদমেজাজি? 

বরকত সাহেবের ভ্রু কুঁচকে উঠল। তিনি জবাব দিতে গিয়েও দিলেন না। হালকাস্বরে বললেন, চা নিন। নাকি কফি খেতে চান? 

চা খাব । আপনি বলেছিলেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন করেন কী? কিছুই করি না। এখন আমি ঘরেই থাকি। এবং কাউকে ঘর থেকে বেরুতে দেন না। এ কথা বলছেন কেন? কারণ দারােয়ান আমাকে বেরুতে দেয় নি। ওকে বলে দিয়েছি যেন গেট না খােলে। কেন বলেছেন? 

তিন্নির জন্যে বলেছি। আমার ভয় গেট খােলা পেলেই সে চলে যাবে। আমি আর কোনাে দিন তাকে ফিরে পাব না। 

সেকি এর আগে কখনাে গিয়েছে? 

তাহলে কী করে আপনার ধারণা হল গেট খােলা পেলে সে চলে যাবে? 

আমাকে আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আমাকে প্রশ্ন করবার জন্যে তাে আপনাকে আনি নি। আপনাকে আনা হয়েছে আমার মেয়ের জন্যে। 

আনা হয়েছে বলাটা বােধহয় ঠিক হচ্ছে না। আমি নিজ থেকে এসেছি। 

বরকত সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনি দয়া করে আমার মেয়ের ঘরে চলে যান। ওর সঙ্গে কথা বলুন। 

ও কি তার ঘরে একা থাকে? হ্যা, একাই থাকে। 

মিসির আলি উঠে দাঁড়াতেই বরকত সাহেব বললেন, প্লিজ একটি কথা মন দিয়ে শুনুন। এমন কিছুই করবেন না যাতে আমার মেয়ে রেগে যায়। 

এ কথা বলছেন কেন? ও রেগে গেলে মানুষকে কষ্ট দেয়। কীভাবে কষ্ট দেয়? নিজেই বুঝবেন, আমার বলার দরকার হবে না। 

তিন্নির ঘরটি বিরাট বড়। একপাশে ছােট্ট একটি কালাে রঙের খাটে সুন্দর একটি বিছানা পাতা। নানান ধরনের খেলনায় ঘর ভর্তি। বেশিরভাগ খেলনাই হচ্ছে তুলার তৈরী জীবজন্তু। শিশুদের ঘর যেমন অগােছালাে থাকে এ ঘরটি সে-রকম নয়। বেশ গােছানাে ঘর। মিসির আলি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তিন্নিকে দেখলেন। মেয়েটি গভীর মনােযােগে ছবি আঁকছে। একবারও তাকাচ্ছে না তার দিকে। মিসির আলি বললেন, তিন্নি ভেতরে আসব? 

তিন্নি ছবি থেকে মুখ না তুলেই বলল, আসতে ইচ্ছে হলে আসুন। 

তিনি কিছু বলল না। মিসির আলি ভেতরে ঢুকলেন। হাসিমুখে বললেন, বসব কিছুক্ষণ তােমার ঘরে? 

বসার ইচ্ছে হলে বসুন। তিনি বসলেন। হাসিমুখে বললেন, কিসের ছবি আঁকছু? কিসের ছবি আঁকছ? গাছের। 

দেখি কেমন ছবি? দেখতে ইচ্ছে হলে দেখুন। 

তিনি তার ছবি এগিয়ে দিল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন—অদ্ভুত সব গাছের ছবি আঁকা হয়েছে। গাছগুলিতে কোনাে পাতা নেই। অসংখ্য ডাল। ডালগুলি লতানাে। কিছু কিছু লতা আবার চুলের বেণীর মতাে পাকানাে। 

সুন্দর হয়েছে তাে গাছের ছবি! আপনার ভালাে লাগছে? হ্যা। এ রকম গাছ কি আপনি এর আগে কখনাে দেখেছেন? 

দেখিনি। তাহলে আপনি কেন জিজ্ঞেস করলেন না— কী করে আমি না-দেখে এমন সুন্দর গাছের ছবি আঁকলাম। 

শিশুরা মন থেকে অনেক জিনিস আঁকে। 

তিন্নি হাসল। তিনি প্রথম মেয়েটির মুখে হাসি দেখলেন। তিন্নি হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। মিসির আলি বললেন, তুমি এত হাসছ কেন? 

হাসতে ভালাে লাগছে তাই হাসছি। 

তিনি নিজেও হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, আমি শুনেছি তুমি সব প্রশ্নের উত্তর জানাে । 

কে বলেছে? বাবা? হা। তুমি কি সত্যিসত্যি জানাে? জানি। পরীক্ষা করতে চান? হ্যা চাই। বল তাে নয়-এর বর্গমূল কত? তিন। পাঁচের বর্গমূল কত সেটা জানাে? তিন্নি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি জানি না। আচ্ছা দেখি এটা পার কি না। পেনিসিলিন যিনি আবিষ্কার করেছেন তার নাম কী? 

স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। হা হয়েছে। এখন বল দেখি তার স্ত্রীর নাম কী? আমি জানি না। সত্যি জানাে না? 

, আমি জানি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত সনে নােবেল প্রাইজ পেয়েছেন জানাে? জানি। উনিশশাে তের সনে।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছােট মেয়ের নাম জাননা? 

জানি না। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *