অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-৭) 

মিসির আলি হাসতে লাগলেন। তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। গম্ভীরস্বরে বলল, আপনি হাসছেন কেন? 

আমি হাসছি কারণ তুমি কীভাবে সব প্রশ্নের জবাব দাও তা বুঝতে পারছি। তাহলে বলুন কীভাবে সব প্রশ্নের জবাব দেই। 

অন্যভুবনআমি লক্ষ্য করলাম যেসব প্রশ্নের উত্তর আমি জানি শুধু সেসব প্রশ্নের উত্তরই তুমি জানাে। যেমন আমি জানি নয়ের বর্গমূল তিন, কাজেই তুমি বললে তিন। কিন্তু পাচের বর্গমুল কত তা তুমি বলতে পারলে না। কারণ আমি নিজেও তা জানি না। আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের স্ত্রীর নাম তুমি বলতে পারলে না, কারণ আমি তার স্ত্রীর নাম জানি না। ঠিক এই ভাবে 

থাক আর বলতে হবে না।। 

তিন্নি তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোনাে হাসি নেই। সমস্ত চেহারায় কেমন একটা কঠিন ভাব চলে এসেছে। যা এত অল্পবয়েসী একটি বাচ্চার চেহারার সঙ্গে ঠিক মিশ খাচ্ছে না। মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, তুমি মানুষের মনের কথা টের পাও। টের পাও বলেই জানা প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পার। এটা একধরণের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা। কেউ কেউ এধরনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।। 

তিন্নি শীতল গলায় বলল, আপনি খুব বুদ্ধিমান। মিসির আলি বললেন, হ্যা আমি বুদ্ধিমান। আপনি বুদ্ধিমান এবং অহংকারী। 

যারা বুদ্ধিমান তারা সাধারণত অহংকারী হয়। এটা দোষের নয়। যে জিনিস তােমার নেই তা নিয়ে তুমি যখন অহংকার কর সেটা হয় দোষের। 

আপনি এখানে কেন এসেছেন? তােমাকে সাহায্য করবার জন্যে এসেছি। কিসের সাহায্য? 

আমি এখনাে ঠিক জানি না। সেটাই দেখতে এসেছি। হয়তাে তােমার কোনাে সাহায্যের প্রয়ােজন নেই। তােমার বাবা শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন। 

আমি ডাক্তার পছন্দ করি না। আমি ডাক্তার নই। আপনি এখন আমার ঘর থেকে চলে যান। আমার আপনাকে ভালাে লাগছে না। আমার কিন্তু তােমাকে ভালাে লাগছে। খুব ভালাে লাগছে। আপনি এখন যান। 

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন, কেন? চলে যান। 

তিন্নি কথা ক’টি বলার সঙ্গে সঙ্গে মিসির আলি তার মাথার ঠিক মাঝখানে এক ধরনের যন্ত্রণা বােধ করলেন। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল। বমি-বমি ভাব হল, আর সেই সঙ্গে তীব্র ও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। যেন কেউ একটি ধারালাে ব্লেড দিয়ে আচমকা মাথাটা দু-ফাক করে ফেলেছে। মিসির আলি বুঝতে পারছেন তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। পৃথিবী তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখছেন সাবানের বুদবুদের মতাে বুদবুদ। জ্ঞান হারাবার ঠিক আগমুহূর্তে ব্যথাটা কমে গেল। সমস্ত শরীরে একধরনের অবসাদ। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি তাকালেন তিন্নির দিকে। মেয়েটির ঠোটের কোণে মৃদু হাসি। সহজ হাসি নয়, উপহাসের হাসি। মিসির আলি দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, এটা তাে তুমি ভালােই দেখালে । 

তিন্নি বলল, এর চেয়েও ভালাে দেখাতে পারি। 

তা পার। নিশ্চয়ই পার । তুমি  িবাগ হলেই এ-রকম কর? হা করি। আমি তােমাকে রাগাতে চাই না। কেউ চায় না। সবাই তােমাকে খুশি রাখতে চায়? হা। কিন্তু তবু তুমি প্রায়ই রেগে যাও তাই না? 

হ্যা যাই। রাগটা সাধারণত কতক্ষণ থাকে? ঠিক নেই। কখনাে কখনাে অনেক বেশি সময় থাকে। 

আচ্ছা তিন্নি, মনে কর এখানে দুজন মানুষ আছে! তুমি রাগ করলে একজনের ওপর। তাহলে ব্যথাটা কি সেইজনই পাবে না দুজন একত্রে পাবে? 

যার ওপর রাগ করেছি সেই পাবে। অন্যে পাবে কেন? অন্যজনের ওপর তাে আমি রাগ করিনি। 

তাওতাে ঠিক। এখন কি আমার ওপর তােমার রাগ কমেছে? 

হ্যা কমেছে। 

তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসাে তাে যাতে আমি বুঝতে পারি তােমার রাগ সত্যি সত্যি কমেছে! 

তিন্নি হাসল। মিসির আলি বললেন, আমি কি আরাে খানিকক্ষণ বসব? বসার ইচ্ছা হলে বসুন। 

মিসির আলি বসলেন। একটি সিগারেট ধরালেন। মেয়েটি নিজের মনে ছবি আঁকছে। সেই গাছের ছবি, লতানাে ডাল, পত্রহীন বিশাল বৃক্ষ। মিসির আলি ঠিক করলেন তিনি একটি পরীক্ষা করবেন। এই মেয়েটি যেভাবেই হােক মস্তিষ্কের কোষে সরাসরি চাপ প্রয়ােগ করতে পারে। উচ্চপর্যায়ের একটি ট্যালিপেথিক ক্ষমতা। ছােট্ট একটি মেয়ে অথচ কত সহজে মানুষের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। এটাকে বাধা দেবার একমাত্র উপায় সম্ভবত মেয়েটিকে মাথার ভেতর ঢুকতে না-দেয়া। সেটা করা যাবে তখনই যখন নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে। সমস্ত চিন্তা ও ভাবনা কেন্দ্রীভূত করা হবে একটি বিন্দুতে। 

মিসির আলি ডাকলেন, তিন্নি। তিন্নি মুখ না তুলেই বলল, কী? 

তুমি আমার মাথার ব্যথাটা আবার তৈরী কর তাে। কেন? আমি একটা ছােট্ট পরীক্ষা করব। কী পরীক্ষা? আমি দেখতে চাই এই ব্যথার হাত থেকে বাঁচার কোনাে উপায় আছে কি না। উপায় নেই। 

সেটাই দেখব। তবে তিন্নি একটি কথা, ব্যথাটা তুমি তৈরী করবে খুব ধীরে । এবং যখনই আমি হাত তুলব তুমি ব্যথাটা কমিয়ে ফেলবে। 

আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ। 

আমি মােটেই অদ্ভুত মানুষ নই। আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ। আমি এসেছি তােমাকে সাহায্য করতে। 

আমার কোনাে সাহায্য লাগবে না। 

হয়তাে লাগবে না। তবু আমি তােমার ব্যাপারটা পুরােপুরি বুঝতে চাই। এখন তুমি ব্যথা তৈরী করাে তাে। খুব ধীরে ধীরে। | তিন্নি মাথা তুলে সােজা হয়ে বসল। তার দৃষ্টি তীক্ষ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। ঠোট বেঁকে যাচ্ছে। বাঁকা ঠোট খুব হালকাভাবে কাপছে। 

মিসির আলি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তিনি তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ একটি ব্যাপারে কেন্দ্রীভূত করে ফেললেন। খুব ছােটবেলায় তিনি একটি সাপের মুখােমুখি হয়েছিলেন। এখন তিনি ভাবছেন সেই সাপটির কথা। সাপটির হলুদ গা ছিল চক্রকাটা। বুকে ভর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছিল। তাকে দেখেই সে থমকে গেল। ঘন ঘন তার চেরা জিভ বের করতে লাগল। মিসির আলি এখন আর কিছুই ভাবছেন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *