তুমি আজ সকালে আমাকে পিশাচ ডাকছিলে কেন ? রহিমার মুখ সাদা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমল।। পিশাচরা কী করে রহিমা? রহিমা তার জবাব দিল না। তার পানির পিপাসা পেয়ে গেছে। বুক শুকিয়ে কাঠ । আর কোনাে দিন আমাকে পিশাচ ডাকবে না। জ্বি আচ্ছা। এখন যাও। আজ বােধ হয় স্বপ্নটা সে দেখবেই। বিছানায় শােয়া মাত্র চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। অনেক চেষ্টা করেও চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। ঘরের বাতাস হঠাৎ যেন অনেকখানি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে দূরে। এই দূর অনেকখানি দূর। গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়িয়ে দূরে আরাে দূরে । তিন্নি ছটফট করতে লাগল। সে ঘুমুতে চায় না। জেগে থাকতে চায়। কিন্তু ওরা তাকে জেগে থাকতে দেবে না। ঘুম পাড়িয়ে দেবে। এবং ঘুম পাড়িয়ে অদ্ভুত
সব স্বপ্ন দেখাবে।
তিন্নি সেই রাতে যে স্বপ্ন দেখল তা অনেকটা এরকম
একটি বিশাল মাঠে সে দাড়িয়ে আছে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু গাছ আর গাছ। বিশাল মহীরুহ। এইসব গাছের মাথা যেন আকাশ স্পর্শ করেছে। গাছগুলি অদ্ভুত । লতানাে ডাল। কিছু কিছু ডাল আবার বেণী পাকানাে। তাদের গায়ের রঙ সবুজ নয়, হলুদের সঙ্গে লাল মেশানাে। হালকা লাল। এইসব গাছ একসঙ্গে হঠাৎ কথা বলে উঠছে। নিজেদের মধ্যে কথা। আবার কথা বন্ধ করে দিচ্ছে। তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। শােনা যাচ্ছে শুধু বাতাসের শব্দ। ঝড়ের মতাে শব্দে বাতাস বইছে। আবার সেই শব্দ থেমে যাচ্ছে। তখন কথা বলছে গাছেরা। কত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে কত অদ্ভুত কথা। তার প্রায় কিছুই তিনি বুঝতে পারছে না। একসময় সমস্ত কথাবার্তা থেমে গেল। তিনি বুঝতে পালল সব কটি গাছ লক্ষ্য করছে তাকে। তাদের মধ্যে একজন বলল, কেমন আছ ছােট্ট মেয়ে ?
ভালাে। ভয় পাচ্ছ কেন তুমি ? আমি ভয় পাচ্ছি না। অল্প অল্প পাচ্ছ। কোনাে ভয় নেই।
‘কোনাে ভয় নেই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সব কটি গাছ একত্রে বলতে লাগল, ভয় নেই। কোনাে ভয় নেই।
ভয়াবহ শব্দ। কানে তালা লেগে যাবার মতাে অবস্থা। তিনি তখন কেঁদে ফেলল, তার কান্নার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শব্দ থেমে গেল। কথা বলল শুধু একটি গাছ।
ছােট মেয়ে তিন্নি।
কী ? কাঁদছ কেন? জানি না কেন। আমার কান্না পাচ্ছে। ভয় লাগছে?
হ্যা। কোনাে ভয় নেই। তােমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
কথা শেষ হবার সঙ্গে আলাে কমে এল। সব কটি গাছ একত্রে মাথা দুলিয়ে কী সব গান করতে লাগল। এই গানে মনে অদ্ভুত এক আনন্দ হয়। শুধু মনে হয় কত সুখ চারদিকে। শুধু বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। আনন্দ করতে ইচ্ছা করে ।।
ঘুম আসছে ছােট মেয়ে তিনি ? আসছে। তাহলে ঘুমাও। আমাদের গান তােমার ভালাে লাগছে? লাগছে। খুব ভালাে? হ্যা খুব ভালাে।
গাঢ় ঘুমে তিন্নির চোখ জড়িয়ে এল। স্বপ্ন শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়েও যেন হয় নি। তার রেশ লেগে আছে তিন্নির চোখমুখে।
মিসির আলি সারাদিন ঘুমুলেন।
দুপুরে একবার ঘুম ভেঙেছিল। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। তিনি পরপর দু গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন। যখন জাগলেন তখন বেশ রাত। বিছানার পাশে উদ্বিগ্ন-মুখে বরকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। একজন বেঁটে মতাে লােক আছে, হাতে স্টেথিসকোপ। নিশ্চয়ই ডাক্তার । দরজার পাশে চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে নাজিম । বােঝাই যাচ্ছে সে বেশ ভয় পেয়েছে।
বরকত সাহেব বললেন, এখন কেমন লাগছে ? ভালাে।।
মিসির আলি উঠতে চেষ্টা করলেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, নড়াচড়া করবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন। আপনার ব্লাডপ্রেশার এবনরম্যালি হাই।।
তিনি কিছু বললেন না। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে তার সময় লাগছে। ঘুমঘুম ভাবটা ঠিক কাটছে না। ডাক্তার সাহেব বললেন, হাই প্রেশারে কতদিন ধরে ভুগছেন ?
প্রেশার ছিল না। হঠাৎ করে হয়েছে। যে জিনিস হঠাৎ আসে তা হঠাৎ যায় । কি বলেন?
না, খুব সাবধান থাকবেন। আমি তাে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। বরকত সাহেবকে বলছিলাম হাসপাতালে ট্রান্সফার করবার জন্যে। সত্যি করে বলুন এখন কি বেটার লাগছে ?
লাগছে। আগের মতাে খারাপ লাগছে না।
ডাক্তার গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হঠাৎ করে এ-রকম হাই প্রেশার হবার তাে কথা নয়। খুব আনইউজুয়াল।
তিনি একগাদা অষুধপত্র দিলেন। যাবার সময় বার বার বললেন, রেস্ট দরকার। কমপ্লিট রেস্ট। কিছু খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। একটা ঘুমের অষুধ দিয়েছি। খেয়ে টানা ঘুম দিন। ভােরে এসে আমি আবার প্রেশার মাপব।
বরকত সাহেব বললেন, আপনি তাে সারাদিন কিছু খাননি।
এখন খাব। গােসল সেরে খেতে বসব। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। আপনি কি দয়া করে খাবারটা আমার ঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন ?
নিশ্চয়ই করব । আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম। মিসির আলি বললেন, আজ না, আমি আগামীকাল কথা বলব। ঠিক আছে। আগামীকাল।
বরকত সাহেব ঘর থেকে বেরুতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন। নিচুগলায় বললেন, আপনার কষ্ট হল খুব। আমি লজ্জিত।
আপনার লজ্জিত হবার কিছুই নেই। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না ।
দীর্ঘ স্নানের পর মিসির সাহেবের বেশ ভালােই লাগল। ক্লান্তির ভাব নেই। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা আছে তবে তা সহনীয় । এবং মনে হচ্ছে গরম এক কাপ চা খেলে সেরে যাবে।
খাবার নিয়ে এল নাজিম। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন নাজিম তাকে বারবার আড়চোখে দেখছে।