দুপুরবেলা কাজের মেয়েটি মিসির আলিকে ডেকে তুলল। কে নাকি দেখা করতে এসেছে। খুব জরুরি দরকার।
মিসির আলির রাগে গা কাঁপতে লাগল । কাজের মেয়েটিকে বলে দেয়া ছিল কিছুতেই যেন তাঁকে তিনটার আগে ডেকে তােলা না হয়। এখন ঘড়িতে বাজছে দুটা দশ। যত জরুরি কাজই থাকুক এই সময় তাকে ডেকে তােলার কথা নয়। মিসির আলি রাগ কমাবার জন্যে উল্টোদিকে দশ থেকে এক পর্যন্ত গুনলেন। গুনগুন করে মনে মনে গাইলেন— আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে এত পাখি গায় । এই গানটি গাইলে তার রাগ আপনাতেই কিছুটা নেমে যায়। কিন্তু আজ নামছে না। কাজের মেয়েটির ভাবলেশহীন মুখ দেখে তা আরাে বেড়ে যাচ্ছে। তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন, রেবা।
আর কোনােদিন তুমি আমাকে তিনটার আগে ডেকে তুলবে না। জ্বি আইচ্ছা।
দুটো থেকে তিনটা এই এক ঘণ্টা আমি প্রতিদিন দুপুরে ঘুমিয়ে থাকি। এর নাম হচ্ছে সিয়াস্তা। বুঝলে?
জি। ঘড়ি দেখতে জান? জ্বি না।
মিসির আলির রাগ দপ করে নিভে গেল। যে মেয়ে ঘড়ি দেখতে জানে না, সে তাকে তিনটার সময় ডেকে তুলবে কীভাবে? রেবা মেয়েটি নতুন কাজে এসেছে। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে।
রেবা। জি।
আজ সন্ধ্যার পর তােমাকে ঘড়ি দেখা শেখাব। এক থেকে বার পর্যন্ত সংখ্যা প্রথম শিখতে হবে। ঠিক আছে?
জ্বি ঠিক আছে। এখন বল, যে লােকটি দেখা করতে এসেছে, সে কেমন?
রেবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মানুষ মানুষের মতােই, আবার কেমন হবে। তার এই সাহেব কী সব অদ্ভুত কথাবার্তা যে বলে! পাগলা ধরনের কথাবার্তা।
বল বল, চুপ করে আছ কেন? | মিসির আলি বিরক্ত হলেন। এই মেয়েকে কাজ শেখাতে সময় লাগবে। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, মানুষকে দেখতে হবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝতে পারছ?
মেয়েটি মাথা নাড়ল। মাথা নাড়ার ভঙ্গি থেকেই বলে দেয়া যায় সে কিছুই বুঝে নি। বােঝার চেষ্টাও করে নি । সে শুধু ভাবছে এই লােকটির মাথায় দোষ আছে। তবে
দোষ থাকলেও লােকটা ভালাে। বেশ ভালাে। রেবা এ পর্যন্ত দুটি গ্লাস, একটা পিরিচ এবং একটা প্লেট ভেঙেছে। একটা কাপের বোঁটা আলগা করে ফেলেছে। সে তাকে কিছুই বলে নি। একটা ধমক পর্যন্ত দেয় নি। ভালাে মানুষগুলি একটু পাগল-পাগলই হয়ে থাকে।
মিসির আলি হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। একটি সিগারেট বের করে হাত দিয়ে গুঁড়াে করে ফেললেন। তিনি সিগারেট ছাড়বার চেষ্টা করছেন। যখনই খুব খেতে ইচ্ছা করে তিনি একটি সিগারেট বের করে গুড়াে করে ফেলেন। এবং ভাবতে চেষ্টা করেন একটি সিগারেট টানা হল। এতে কোনাে লাভ হচ্ছে না, শুধু মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছে ।
রেবা ।
এখন আমি তােমাকে কিছু প্রশ্ন করব। তুমি উত্তর দেবে। তােমার উত্তর থেকে আমি ধারণা করতে পারব যে লােকটি এসেছে সে কীরকম।
রেবা হাসল। তার বেশ মজা লাগছে। প্রথম প্রশ্ন, যে লােকটি এসেছে সে গ্রামে থাকে না শহরে? গেরামে। লােকটি বুড়াে না জোয়ান? জোয়ান। রােগা না মােটা? রােগা। কী কাপড় পরে এসেছে? মনে নাই। কাপড় পরিষ্কার না ময়লা? ময়লা। হাতে কী আছে? ব্যাগ বা ছাতা এসব কিছু আছে?
চোখে চশমা আছে?
মিসির আলি থেমে-থেমে বললেন, তােমাকে যে প্রশ্নগুলি করলাম সেগুলি মনে রাখবে। কেউ আমার কাছে এলে আমি এইগুলি জানতে চাই। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
এখন যাও আমার জন্যে এক কাপ চমৎকার চা বানাও। দুধ চিনি কিছু দেবে না। শুধু লিকার। বানানাে হয়ে গেলে চায়ের কাপে এক দানা লবণ ফেলে দেবে।
লবণ? হ্যা লবণ।
মিসির আলি উঠে দাড়ালেন। বসার ঘরে যে লােকটি এসেছে তাকে দেখা দরকার। রেবার কথামতাে লােকটি হবে গ্রামের, ময়লা কাপড় পরে এসেছে। জোয়ান বয়স। হাতে কিছুই নেই। এই ধরনের একজন লােকের তাঁর কাছে কী প্রয়ােজন থাকতে পারে?
বসার ঘরে যে লােকটি বসে ছিল সে রােগা নয়। পরনে গ্যাভার্ডিনের স্যুট। হাতে চামড়ার একটি ব্যাগ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। চোখে চশমা। মিসির আলি মনে মনে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। রেবা মেয়েটির পর্যবেক্ষণ শক্তি মােটেই নেই। একে বেশি দিন রাখা যাবে না। মিসির আলি বসে থাকা লােকটিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলেন।
তিনি ঘরে ঢোকার সময় লােকটি উঠে দাঁড়ায় নি। দাঁড়াবার মতাে ভঙ্গি করেছে। বসে থাকার মধ্যেও একটা স্পর্ধার ভাব আছে। লােকটি তাকিয়ে আছে সরু চোখে। যেন সে কিছু একটা যাচাই করে নিচ্ছে। মিসির আলি বললেন, ভাই আপনার নাম?
আমার নাম বরকতউল্লাহ। আমি ময়মনসিংহ থেকে এসেছি। কোনাে কাজে এসেছেন কি? হ্যা, কাজেই এসেছি। আমি অকাজে ঘুরাঘুরি করি না। আমার কাছে এসেছেন? আপনার কাছে না এলে আপনার ঘরে বসে আছি কেন? ভালােই বলেছেন। এখন বলুন কী ব্যাপার। অল্প কথায় বলুন।
বরকতউল্লাহ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, আমি কথা কম বলি। আপনাকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।
তিনি লক্ষ্য করলেন লােকটি আহত হয়েছে। তার চোখ মুখ লাল। মিসির আলি খুশি হলেন। লােকটি বড় বেশি স্পর্ধা দেখাচ্ছে।
বরকতউল্লাহ সাহেব, চা খাবেন? জ্বিনা, আমি চা খাই না। আমার যা বলার তা আমি খুব অল্পকথায় বলে চলে যাব।