অপেক্ষা পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

‘বললেইতাে লিখে ফেলা যায় না, চিন্তা ভাবনা করে লিখতে হবে। রাতে লিখব। শুরুটা হবে কিভাবে জানিস -ওগাে আমার প্রাণপাখি বুলবুলি। 

অপেক্ষা

সুপ্রভা আবারাে খিল খিল করে হেসে উঠল । মিতু বিরক্ত গলায় বলল, বললাম না হায়নার মত হাসবি না। 

‘হাসি আসলে কি করব ? 

‘হাসি আসলে হাসি চেপে রাখবি। হাসলে মেয়েদের যত সুন্দর লাগে হাসি চেপে রাখলে তারচে দশগুণ বেশী সুন্দর লাগে।’ 

‘তােমাকে কে বলেছে ? 

‘আমাকে কিছু বলতে হয় না। আমি হচ্ছি সবজান্তা। সব কিছু জানি। এবং ম্যানেজ মাষ্টার সব কিছু ম্যানেজ করতে পারি।’ 

‘তুমি কি মা’কে বলে আমার বান্ধবীর বাসায় যাবার ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবে ? আজ রাতে ওর বাসায় থাকার কথা। 

‘অবশ্যই ম্যানেজ করতে পারব। আমার কাছে এটা কোন ব্যাপার না।’ 

তাহলে তুমি আমাকে যাবার ব্যবস্থা করে দাও।’ আমি কেন করে দেব ? তাের সমস্যা তুই দেখবি। সুপ্রভা মন খারাপ করা গলায় বলল, আপা আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি খুব কঠিন হৃদয়ের মহিলা। 

মিতু সহজ গলায় বলল, ভুল বললি। আমি কঠিন হৃদয়ের মেয়ে, এটা মাঝে মাঝে মনে হবার ব্যাপার না। সব সময় মনে হবার ব্যাপার । 

মিতু উঠে দাঁড়াল। মিতুর সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রভাও উঠে দাঁড়াল। মিতু বিরক্ত গলায় বলল তুই ছায়ার মত সারাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিসনাতাে। বিরক্ত লাগে। 

অপেক্ষা পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

 ‘তুমি যাচ্ছ কোথায় ? ছাদ পিছল হয়ে আছে আপা ছাদে যেও না। রেলিং নেই ছাদ, ধপাস করে পড়বে। 

‘পড়ি যদি সেটা আমার সমস্যা । তাের সমস্যা না।’ 

মিতু ছাদের দিকেই যাচ্ছে। যাবার আগে সে ফুপুর সঙ্গে দু’ একটা কথা বলে যাবে বলে ঠিক করল। শক্ত কিছু কথা। এই মহিলাকে তার ইদানীং অসহ্য বােধ হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে আগ বাড়িয়ে কঠিন কথা শুরু করা যায় না । ফুপু তার সঙ্গে কখনাে কঠিন কিছু বলেন না। বললে সুবিধা হত। কোমর বেঁধে ঝগড়া করা যেত। 

সুরাইয়া মিতুকে দেখে সহজ গলায় বলল, কি ব্যাপার মিতু? মিতু বলল, কলার ভর্তা বানিয়েছি। খাবে ? 

 ‘খেয়ে দেখ না । ভাল হয়েছে।’ ‘ইচ্ছে করছে না। তাের ইউনিভার্সিটি কেমন লাগছে? ‘ভালও লাগছে না, মন্দও লাগছে না–সমান সমান লাগছে।’ 

‘আশ্চর্য, ঐ দিন দেখেছি লাল হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস- আজ একেবারে ইউনিভার্সিটি। 

‘লাল হাফপ্যান্ট ? 

‘হ্যা, লাল হাফপ্যান্ট। আমার সব পরিষ্কার মনে আছে। আমাকে দেখে জিভ বের করে ভেংচি কাটলি।’ 

‘তােমার পুরানাে দিনের কথা খুব মনে থাকে তাই না ফুপু ?’ ‘হ্যা, মনে থাকে।’ 

‘ফুপু তােমাকে একটা কথা বলার জন্যে এসেছি। আমিতাে কাউকেই কোন অনুরােধ টনুরােধ করি না। তােমাকে করছি। 

‘কি অনুরােধ ? 

‘সুপ্রভার এক বান্ধবীর জন্মদিন। সুপ্রভার খুব ইচ্ছা জন্মদিনে যায়। ওকে যেতে দিও । 

‘যেতে চাইলে যাবে। যেতে না দেবার কি আছে ? 

‘রাতটা ঐ বাড়িতে থাকবে। বান্ধবীরা মিলে হৈ চৈ গল্প গুজব করবে । সকালে চলে আসবে। আমি বিকেলে দিয়ে আসব সকালে নিয়ে আসব । কাল আমার ক্লাস নেই। 

“ঠিক আছে। 

ফুপু কলা ভর্তা একটু খেয়ে দেখ না। ভাল লাগবে। একটু মুখে দিলেই আরাে খেতে চাইবে। 

সুরাইয়া খানিকটা ভর্তা হাতে নিলেন তবে মুখে দিলেন না । মিতু চলে গেল ছাদে। সুপ্রভার অনুমতি এত সহজে আদায় হয়ে যাবে সে ভাবে নি। তার ধারণা ছিল অনেক । 

অপেক্ষা পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

তে হবে। আজ মনে হয় ফুপুর মনটা কোন কারণে ভাল। 

ছাদে এখনাে রেলিং হয় নি। প্রতি বছর জামিলুর রহমান একবার করে বলেন—এই শীতে রেলিং দিয়ে দেব। খােলা ছাদ কখন কি হয়। শীত চলে যায় রেলিং দেয়া হয় না। 

বর্ষার পানিতে শ্যাওলা পড়ে ছাদ পিছল হয়ে আছে। বুড়াে আঙ্গুল টিপে টিপে হাঁটতে হয়। যে কোন মুহূর্তে ছাদ থেকে মাটিতে নেমে আসার সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে হাঁটতে মিতুর অদ্ভুত ভাল লাগে। এটা এক ধরণের পাগলামীতে বটেই। মিতুর ধারণা সব মানুষের মধ্যে কিছু কিছু পাগলামী আছে- তার মধ্যেও আছে। এটা নিয়ে মাথা ঘামানাের কিছু নেই। তার পাগলামী ক্ষতিকারক পাগলামী না। আজ সে ছাদে হাঁটাহাঁটি করল না। চিলেকোঠায় চলে গেল। 

জামিলুর রহমান সাহেব সিঁড়ির পাশে এই ঘরটা বানিয়েছিলেন বাড়ির চাকর বাকরদের থাকার জন্যে। ঘরটা মিতু নিয়ে নিয়েছে। দু’টা নাম্বারিং লক দিয়ে ঘরটা তালা দেয়া। দু’ দু’টা তালা দেখে ধারণা হতে পারে ঘর ভর্তি মিতুর শখের জিনিস পত্র। আসলে ঘরটা প্রায় খালি । একটা চৌকি আছে। চৌকিতে পাটি পাতা। কোন বালিশ নেই। চৌকির পাশে ছােট্ট টেবিল । টেবিলে কিছু খাতা পত্র। কয়েকটা বল পয়েন্ট। দু’টা ফাউন্টেন পেন। কয়েকটা পেনসিল।

অপেক্ষা পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

টেবিলের সঙ্গে কোন চেয়ার নেই, কারণ চেয়ার বসানাের জায়গা নেই । মিতু চৌকিতে বসেই গুটগুট করে খাতায় কি সব লেখে। তবে বেশীর ভাগ সময় দরজা বন্ধ করে চৌকিতে শুয়ে থাকে। মাথার কাছের ছােট্ট জানালা দিয়ে হুহু করে হাওয়া খেলে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মনে হয় বাতাসটা আকাশ থেকে সরাসরি আসছে। 

আজ মিতু দরজা বন্ধ করে ইমনকে উড়াে চিঠি লিখতে বসল। রুলটানা কাগজে লিখলে ভাল হত। এখানে রুল টানা কাগজ নেই। কিছু আনিয়ে রাখতে হবে । 

মিতুর চিঠিটা হল এ রকম— 

৭৮৬ হে আমার প্রাণসখা বুলবুল। জানগাে তােমাকে আমি প্রত্যহ কলেজে যাইতে দেখি এবং বড় ভাল TEST 1 I love you very very much. Too much. So many love. তােমার সঙ্গে কবে আমার পরিচয় হইবে ? আমি বড়ই নিঃসঙ্গ। এখানে নতুন আসিয়াছি—কাহারাে সঙ্গে পরিচয় হয় নাই। আগে যেখানে ছিলাম সেখানে দুইটা অফার ছিল। তবে আমার পছন্দনীয় নহে। আমি দেখিতে মােটামুটি সুন্দরী তবে একটু শর্ট। হাই হিল পরিলে বােঝা যায় 

সবাই বলে আমার চোখ খুবই সুন্দর। তুমি যেদিন বলিবে সেদিন আমার জীবন ধন্য হইবে। জানগাে তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁট কেন ? আমার বান্ধবীরা তােমাকে নিয়া হাসাহাসি করে। তাহারা তােমাকে দেখাইয়া আমাকে বলে- “ঐ দেখ তাের কুজো বর যাচ্ছে।” ঠাট্টা করিয়া বর বলে তবে ইনশাল্লাহ্ একদিন তুমি নিশ্চয়ই আমার বর হইবে। ইহা আমার বিশ্বাস। I Love Love Love You You You Many hundrad 

Kiss. এবার ৫০ + ৩০, 

B দায় Your WIFE 

“A” 

চিঠি শেষ করে মিতু অনেকক্ষণ খিল খিল করে হাসল । না এই কাগজে চিঠি লিখলে হবে না—রুল টানা কাগজ আনাতে হবে এবং আরাে কাঁচা হাতে লিখতে হবে। চিঠি হাতে পেয়ে ইমনের মুখের ভাব কি রকম হবে কল্পনা করতেই ভাল লাগছে। আজই যদি চিঠিটা দেয়া যেত ভাল হত। রেজিষ্ট্রি করে পাঠালে চিঠি আসতে আসতে সাতদিনের মত লাগবে। সাত দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। উপায় নেই। 

অপেক্ষা পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

সুপ্রভা শাড়ি বদলেছে—এখন তাকে বাচ্চা একটা মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে শাড়ি না পরলেই তাকে ভাল দেখায়। সুরাইয়া 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *