অপেক্ষা পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

‘হ্যা। ‘ওকে দিন একটু কোলে নিয়ে আদর করি। 

‘কোলে নিয়ে আদর করতে হবে না। ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ঘুম ভাঙ্গলে বিশ্রী করে কাঁদে। অসহ্য লাগে।

অপেক্ষা

সুপ্রভার কান্না শুধু না সুরাইয়ার সব কিছুই অসহ্য লাগে। ইমন যখন পড়ার টেবিলে বসে গুনগুন করে সেই গুনগুন কিছুক্ষণ শুনলেই অসহ্য লাগে । আবার সে যখন নিঃশব্দে পড়ে তখন চারদিকের নৈশব্দও অসহ্য লাগে। সবচে বেশী অসহ্য লাগে তার বড় ভাই জামিলুর রহমানকে। 

জামিলুর রহমান মাঝে মধ্যে বােনের ঘরে ঢুকেন। নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন। দু’একটা কথা শােনার পরই সুরাইয়ার মাথা ধরে যায়। সুরাইয়া সঙ্গে 

সঙ্গে বলে “ভাইজান প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।” তিনি তারপরেও বসে থাকেন। এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে যান এবং কথা বলতেই থাকেন। বলতেই থাকেন। 

তারপর সুরাইয়া তুই আছিস কেমন বল । 

ভাল।’ 

‘দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা একটা ঘরের ভেতর থাকিস। এর নাম ভাল থাকা ? তােরতাে পাগল হতে বেশী বাকি নাই।’ 

‘পাগল আমি হব না ভাইজান, পাগল হলে আগেই হতাম। আগে যখন হই নাই এখনাে হব না । আশে পাশের সবাইকে পাগল বানাব, কিন্তু নিজে পাগল হব না।’ 

অপেক্ষা পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

‘এইত একটা কথার মত কথা বলেছিস । নিজে ভাল থাকবি। নিজের ভাল থাকাটাই জরুরী। অন্যের যা ইচ্ছা হােক—নিজে ঠিক থাকলে জগৎ ঠিক। শুনে ভাল লাগল । একটা ঘটনা ঘটলে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে হবে না-কি ? দুর্ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে না? সব সময় ঘটে।’ 

‘ভাইজান, আমার খুবই মাথা ধরেছে। 

‘দিন রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে থাকলে মাথা ধরবে না ? মাথা ধরবেই আমার কথা শােন, মাথা থেকে সব কিছু বাদ দে-আয় আমরা তাের জীবন নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করি।’ 

নতুন চিন্তা ভাবনাটা কি ? আমাকে বিয়ে দেবার কথা ভাবছেন ? ‘যদি ভাবি- অসুবিধা কোথায় ? তাের বয়স অল্প, সারাটা জীবন পড়ে আছে সামনে। 

সুরাইয়া হতভম্ব গলায় বলল, ইমনের বাবা বেঁচে থাকতেই আমি আরেকটা বিয়ে করে ফেলব ? 

‘বেঁচে আছে তােকে কে বলল ? 

‘মরে গেছে সেটাই বা কে বলল? তা ছাড়া আমি জানি বেঁচে আছে। আর যদি নাও থাকে বিয়েতাে আমি করব না।’ 

 ‘খুব ভাল একটা ছেলে পেয়েছিলাম। ইণ্ডেটিং-এর ব্যবসা করে। বয়স অল্প। রােড অ্যাকসিডেন্টে স্ত্রী মারা গেছেন। 

‘আপনি চান আমি আমার দুই বাচ্চা নিয়ে তার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ি ? ভাইজান যখন আপনার মনে হবে আমাদের আর পালতে পারছেন না, অসুবিধা হচ্ছে, তখন বলবেন আমি চলে যাব। 

‘কোথায় যাবি ? 

‘কোথায় যাব সেটা আমার ব্যাপার। ভাইজান এখন আপনি যান, আমার এমন মাথা ধরেছে যে ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকি।’

অপেক্ষা পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

 জামিলুর রহমান সাময়িক ভাবে উঠে চলে যান তবে কিছুদিন পর আবারাে আরেকটি ছেলের সন্ধান নিয়ে উপস্থিত হন– 

বুঝলি, ভদ্রলােকের বয়স সামান্য বেশী। মনে হয় ফিফটি ক্রস করেছে তবে ভাল স্বাস্থ্য। চেহারাও সুন্দর। দেখলে মনে হয় বয়স থার্টি ফাইভ, থার্টি সিক্স। হাইলি এডুকেটেড। ইলীনয় ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এস. করেছে। আমেরিকান এক মেয়ে বিয়ে করে ছিল। বিয়ে টিকে নি। আমেরিকান মেয়ে বুঝতেই পারছিস- বিয়েটা ওদের কাছে একটা খেলা । কিছু দিন Honey 

Honey বলা তারপর সাপ-নেউলের খেলা। | সুরাইয়া ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ভাইজান শােনেন আমি আমেরিকান মেয়ে না, আমি বাঙ্গালী মেয়ে এবং বিয়েটা আমার কাছে খেলা না। আমার একবার বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী আমাকে তালাকও দেয় নি মরেও যায় নি । আমি আবার বিয়ে করব কেন ? 

‘কোন স্বামী যদি দুই বছর তার স্ত্রীর সঙ্গে যােগাযােগ না রেখে নিরুদ্দেশ থাকে তাহলে সেই বিয়ে অটোমেটিক্যালি তালাক হয়ে যায়। 

‘কে বলেছে ? 

মওলানা সাহেব বলেছেন।’ 

‘মওলানা সাহেবদের বিয়ে হয়ত তালাক হয়ে যায়। ইমনের বাবাতাে মওলানা না।’ 

ইমনের বাবা বেঁচে আছেন, তিনি একদিন ফিরে আসবেন এই বিষয়টা সুরাইয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। সুরাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরাে একজন বিশ্বাস করে সে সুরাইয়ার ভাবী- ফাতেমা। 

অপেক্ষা পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

জামিলুর রহমান যেমন অতিরিক্ত চালাক, তার স্ত্রী ফাতেমা তেমনি অতিরিক্ত বােকা। জগতের বােকারা ভালমানুষ ধরনের হয়। ফাতেমা বেগম তা না! ভালমানুষী কোন ব্যাপারই তার মধ্যে নেই। সুরাইয়া তার পুত্র কন্যা নিয়ে এই সংসারে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে- এই ব্যাপারটা তার কাছে অসহনীয় লাগে। বােকা মানুষ বলেই তিনি মনের ভাব গােপন রাখেন 

– সরাসরি বলেন। পানের পিক ফেলে গম্ভীর গলায় বলেন, একটা কিছু ব্যবস্থাতাে নেওয়া দরকার । আর কত দিন। আমার ছেলেপুলে বড় হচ্ছে। 

তারপরেও সুরাইয়া তার ভাবীকে খুব পছন্দ করে কারণ ফাতেমারও ধারণা ইমনের বাবা বেঁচে আছে। কোন একদিন ফিরে আসবে । 

সেই কোন একদিনটা কবে ? সেটা ফাতেমা জানেন না । সুরাইয়াও জানে না। সুরাইয়ার কেন জানি মনে হয় লােকটা ফিরবে গভীর রাতে । হয়ত ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যেই ভিজতে ভিজতে উপস্থিত হবে। সুরাইয়া দরজা খুলে দেবে। সে ঢুকবে খুব সহজ ভাবে । যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা হচ্ছে লােকটার স্বভাব । সে তার স্বভাব মত বলবে, দেখি, একটা তােয়ালে দেখি। মাথাটা ভিজে গেছে। সুরাইয়া তােয়ালে এগিয়ে দেবে। মানুষটা মাথা মুছতে মুছতে বলবে, তুমি কেমন আছ ? 

সে বলবে, ভাল । ‘এত রােগা লাগছে কেন, শরীর খারাপ ? 

সেও সহজ ভাবেই বলবে, শরীর ঠিকই আছে। যে যেমন তার সঙ্গে সে রকম আচরণই করতে হয়। মানুষটা এক পর্যায়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে বলবে, ইমনের পাশে শুয়ে আছে এই ছােট মেয়েটা কে? 

‘ওর নাম সুপ্রভা। ‘সুপ্রভা কে ? ‘সুপ্রভা হল ইমনের ছােট বোেন। 

বল কি ? সুন্দর হয়েছেতাে ! 

হ্যা সুন্দর হয়েছে। ওকে ডেকে তুলব, কোলে নেবে? না থাক, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দরকার নেই। ইমনতাে দেখি অনেক বড় হয়েছে। ‘বড়তাে হবেই। তুমি কি ভেবেছিলে যে রকম রেখে গেছ ফিরে এসে সে রকম দেখবে ? 

অপেক্ষা পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

মানুষটা কথা ঘুরাবার জন্যে বলবে, ঠাণ্ডা লেগে গেছে, চা খাওয়াতে পারবে।’ 

‘অবশ্যই পারব। কেন পারব না। তুমি ভাত খাবে না? 

হ্যা খাব। ভাতও খাব। গােসল করতে হবে, সাবান দাওতাে।’ ভাত খাবার আগেই চা খাবে, নাকি ভাত খাবার পর চা খাবে ? ‘চা খেয়ে গােসল খানায় ঢুকব। আচ্ছা, এই বাড়িটা কার ? ‘আমার বড় ভাইয়ের বাড়ি। 

বাড়িতে বেশ বড়।’ 

মানুষটা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকবে- সুরাইয়া যাবে চা বানাতে। শুধু চা বানালে হবে না। ভাত চড়াতে হবে। গরম ভাত। ভাতে এক চামচ ঘি, ডিম ভাজা। ডিম ভাজার সঙ্গে শুকনাে মরিচ ভাজা। নতুন আলু ডােবা তেলে মচমচে করে ভাজা । মানুষটার খুব প্রিয় খাবার। 

সুরাইয়া রােজ রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে কাল্পনিক কথােপকথন চালায়। একেক রাতের কথা বার্তা হয় একেক রকম। রাতের এই কথােপকথন অংশটা তার বড় ভাল লাগে। 

ইমন অন্ধকারে সিঁড়িঘরের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জায়গাটা বিশ্রী রকমের অন্ধকার, সেই কারণে তার ভয় লাগছে। আবার অন্ধকার থেকে বারান্দায় আলােতে আসতে পারছে না। সে পেনসিল হারিয়ে ফেলেছে। স্কুলের ব্যাগ গুছাতে গিয়ে ধরা পড়েছে পেনসিল নেই। এই দুঃসংবাদ মা’কে না দিয়ে উপায় নেই। সে মাকে বলল। 

সুরাইয়া ধমক ধামক কিছুই দিল না। শান্তগলায় বলল, যেখান থেকে পার পেনসিল খুঁজে আন। পেনসিল না এনে আজ ঘুমুতে পারবে না। 

ঘন্টা খানিক আগে সে মার ঘরে উঁকি দিয়েছিল। সুরাইয়া তাকে দেখেই বলল, পেনসিল পেয়েছ? 

ইমন বলল, না। 

‘পেনসিল পাওনি তাহলে এসেছ কেন? বললাম না, পেনসিল না পেলে আসবে না। কথা কানে যায় না ? বাঁদর ছেলে। 

রাত দশটার মত বাজে। অন্যদিন এই সময়েও বাড়ি গমগম করে, আজ মনে হয় সবাই শুয়ে পড়েছে। বাড়ি নিঝুম । ইমন কি করবে বুঝতে পারছে 

অপেক্ষা পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ

এ বাড়িতে যদি ছােট চাচা থাকতেন তাহলে তাকে কানে কানে বললেই যত রাতই হােক তিনি দোকান থেকে পেনসিল কিনে আনতেন। ছােট চাচা নেই। এখন যে সে কাঁদছে, ভয়ে কাঁদছে না- ছােট চাচার জন্যে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই তার মনে হল- বাবা থাকলে বাবা কি তার পেনসিল কিনে আনতেন ? বলা যাচ্ছে না। বাবা কেমন ছিলেন, তিনি কি করতেন সে দ্রুত ভুলে যাচ্ছে। বাবার চেহারাও এখন তার মনে নেই, শুধু মনে আছে বাবা খুব ফর্সা ছিলেন। আগের বাড়িতে বাবা-এবং মা’র একটা ছবি ছিল ড্রেসিং টেবিলে সাজানাে। সেই ছবিটা এ বাড়িতেও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মা ট্রাংকে রেখে 

দিয়েছেন। ছবিটা সাজানাে নেই। ছবি সাজানাে থাকলে সে মাঝে মাঝে 

দেখত । 

‘কে ? কে বসে আছে ? 

ইমন চমকে উঠল- মিতু। অন্ধকারে পা টিপে টিপে কখন যে সামনে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি। 

ক্যাবলা, তাের কি হয়েছে ? চোখ মুছতে মুছতে ইমন বলল, পেনসিল হারিয়ে ফেলেছি। ‘পেনসিল হারিয়ে ফেললে এখানে বসে কাঁদছিস কেন? ইমন জবাব দিল না । মিতু বলল, ফুপু বকা দিয়েছে ? 

‘কি বলেছে পেনসিল না পেলে ঘরে ঢুকতে পারবি না ! 

“কি রঙের পেনসিল ? 

হলুদ। 

‘আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি। একটা কথা শােন, তাের যদি কিছু হারিয়ে যায় আমাকে বলবি আমি এনে দেব। একা একা বসে কাঁদবি না।’ 

ইমন ধরা গলায় বলল, আচ্ছা। 

মিতু দু’টা পেনসিল এনে দিল—একটা হলুদ, একটা সবুজ। হলুদটা স্কুল ব্যাগে রাখবে, সবুজটা কোথাও লুকিয়ে রাখবে। যদি আবারাে পেনসিল হারায় 

তখন কাজে লাগবে। | সুরাইয়া ইমনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, পেনসিল পাওয়া গেছে? ইমন হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। সুরাইয়া বলল, আবার যদি কিছু হারায় টেনে তােমার কান আমি ছিড়ে ফেলব, বাঁদর ছেলে । আমি বাবার নাম ভুলিয়ে দেব। বাবা নেই, বাবার নাম মনে রেখে কি হবে ? যাও হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে আস । 

ইমন বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে এল। আগে মাঝখানে ঘুমুতেন। সুরাইয়া, তারা দুই ভাই বােন দু’পাশে ঘুমুতাে। এক রাতে সুপ্রভা গড়াতে গড়াতে খাট থেকে পড়ে গেল। তার পর থেকে সুপ্রভা মাঝখানে শােয়। শােয়ার এই ব্যবস্থাটা তার খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে সুপ্রভাকে হাত দিয়ে ছােয়া যায়। সুপ্রভা যখন জেগে থাকে তখন তাকে হাত দিয়ে ছুলে খুব মজার একটা কাণ্ড হয়, সুপ্রভা খিল খিল করে হাসতে থাকে। সেই হাসি আর থামে । যে কেউ হাত দিয়ে ছুলে সুপ্রভা এমন করে না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *