তােমরা কে কই আছ দেইখ্যা যাও আমার ইমইন্যা আইছে। দাদীর কান্না দেখে ইমনের লজ্জা লাগছে। আবার ভালও লাগছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এমন বুড়াে একজন মানুষ তার মত ছােট্ট একজনকে এত ভালবাসে কেন। দাদীজানের শরীর অবশ ।
শুধু ডান হাতটা নাড়াতে পারেন। সেই হাতে তিনি ইমনকে ধরে আছেন। কিছুতেই ছাড়ছেন না। হাতে ন্যাপথলিনের গন্ধ। বুড়াে মানুষদের হাতে কি ন্যাপথলিনের গন্ধ হয় ?ইমনের সারাটা দিন কাটল ভয়াবহ উত্তেজনায়। দু’বার তাকে রাজহাঁস তাড়া করল। এতে ভয় যেমন লাগছিল মজাও লাগছিল।
বড়ই গাছে উঠে সে নিজের হাতে পাকা বড়ই পেড়ে খেলাে। বড়ই গাছে নিজে নিজে ওঠা কঠিন তবে ছােট চাচা একটা টেবিল এনে গাছের সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। টেবিল থেকে চট করে গাছে ওঠা যায়। তবে খুব বেশী দূর ওঠা যায় না। গাছ ভর্তি কাঁটা।
ছােট চাচা কামরাঙ্গা গাছের ডালে একটা দোলনা টানিয়ে দিলেন । খুব অদ্ভুত দোলনা- চেয়ার দোলনা। একটা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়।। কি যে মজার দোলনা। মনে হয় চেয়ারে বসে
আছে, সামনে টেবিল । চেয়ার এবং টেবিল দুটাই দুলছে।
অপেক্ষা পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
তারপর সে ছােট চাচার সঙ্গে গেল ছিপ ফেলে পুকুরে মাছ ধরতে। দু’জনের হাতে দু’টা ছিপ! ছােট চাচার বড় ছিপ, তার ছােট ছিপ। মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের করে, কেঁচো দিয়ে টোপ দেয়া হল। খুবই ঘেন্নার কাজ। মাছ মারতে হলে একটু ঘেন্নার কাজ করতেই হয়। ঢাকার কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ঘটনা একশ ভাগ সত্যি। ইমন তার ছিপে একটা সরপুটি মাছ ধরে ফেলল ।
মাছটা ধরে তার এত আনন্দ হল যে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ছােট চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে গাধা! মাছ ধরে কাঁদছিস কেন? এখানে কাদার কি হল ? মাছ ধরতে না পেরে কাদলেও একটা ব্যাপার ছিল। এত বড় মাছ ধরে ফিচ ফিচ কান্না। ছিঃ।। নিজের মারা সরপুটি মাছ ভাজা দিয়ে সে দুপুরে ভাত খেল। আরাে অনেক খাবার ছিল, মুরগীর মাংসের কোরমা ছিল, ডিমের তরকারী ছিল—তার আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করল না।।
পরদিন আরাে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। ছােট চাচা বললেন, আয় তােকে সতার শিখিয়ে দি। এক দিনে সাঁতার। আমি সাঁতার শিখানাের একজন
ওস্তাদ।
সতার শিখতে হলে প্রথম কোন কাজটা করতে হয় বল দেখি ?’
জানি না।’ ‘প্রথম পানিতে নামতে হয়। পানিতে না নেমেও সাঁতার শেখা যায়। সেই সাঁতারের নাম শুকনা সাঁতার। স্থলে বেঁচে থাকার জন্যে এই সাঁতার খুবই প্রয়ােজনীয়। বেশীর ভাগ মানুষ শুকনা সাঁতার জানে না বলে স্থলে ভেসে থাকতে পারে না।’
‘তুমি পার ?’
না, আমিও পারি না।’
ইমন ভয়ে ভয়ে চাচার হাত ধরল । পুকুরটাকে খুব গহীন মনে হচ্ছে। পানি কি পরিষ্কার-টলটল করছে। ফিরােজ বলল, ঝুপ করে পানিতে নাম । একদিনে সাঁতার ।
ইমন অবাক হয়ে বলল, সত্যি সত্যি একদিনে সাতার শিখব।
‘তাের যদি ইচ্ছা থাকে শিখতে পারবি। ইচ্ছা আছে ? ‘আছে।’ | ‘পানিতে আমার সঙ্গে নামবি কিন্তু পানিকে ভয় করতে পারবি না। পানিকে ভয় করলে একদিনে সাঁতার শিখতে পারবি না। শুধু মনে রাখবি আমি যখন আছি তখন তুই ডুববি না। আমি ধরে ফেলব। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। পারবি বিশ্বাস রাখতে ?
‘পারব।’
অপেক্ষা পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
‘তাহলে আয়। শুরু করা যাক। প্রথম এক ঘন্টা শুধু পানিতে দাপাদাপি করবি আমি তাের পেটে হাত দিয়ে তােকে ভাসিয়ে রাখব।’
ফিরােজ ইমনকে ভাসিয়ে রাখছে । ইমন প্রাণপণে দাপাদাপি করছে। প্রথমে একটু শীত লাগছিল, দাপাদাপির কারণে এখন আর শীত লাগছে না। ইমনের মনে হচ্ছে সে তার বাকি জীবনটা পানিতে দাপাদাপি করে কাটিয়ে দিতে পারবে। সঙ্গে শুধু একজনকে লাগবে যে তাকে ভাসিয়ে রাখবে। ছেড়ে
দেবে না।
ইমন দু’ঘন্টার মাথায় সত্যি সত্যি সাঁতার কাটল । ইমনের চেয়েও অনেক বেশী অবাক হল ফিরােজ। সে মুগ্ধ গলায় বলল—হার্ড নাট! তুইতাে সত্যি হার্ড নাট! সত্যি সত্যি একদিনে সাঁতার শিখে ফেললি ? তুইতাে বড় হয়ে গেছিসরে ব্যাটা !
গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ইমনের এত মন খারাপ হল যে বলার নয়। বিদায়ের দিন আকলিমা বেগম নাতীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। এক ফোটাও চোখের জল ফেললেন না। বিদায়ের সময় চোখের জল ফেলতে নেই, অমঙ্গল হয়। এম্নিতেই এই পরিবারে অমঙ্গলের ছায়া পড়ে আছে। আকলিমা বেগম ধরা গলায় বললেন, ইমইন্যা।
ইমন বলল, জুি দাদীমা ।
‘তােরে একটা কথা বলি—তুই যখন বড় হইয়া বিয়া করবি তখন বউরে নিয়া আসবি। আমিতাে বাইচ্যা থাকব না। তােরা দুইজনে আমার কবরের সামনে খাড়াবি।’
ইমন মাথা কাত করে বলল, জ্বি আচ্ছা।
‘তাের লাগি আমি আল্লাহ পাকের কাছে খাস দিলে দোয়া করছি। আমার দোয়া আল্লাহপাক কবুল করছেন।
আকলিমা বেগম নাতীর হাতে কাপড়ে মােড়া একটা ছােট্ট উপহার তুলে দিলেন ।
অপেক্ষা পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
জামিলুর রহমান সাহেবের বাড়িতে আজ ভয়াবহ উত্তেজনা। তিনি অফিসে যাননি। বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছেন। হাতে মােটা একটা দড়ি। তার সামনের টেবিলে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। চা ঠান্ডা হচ্ছে। আজ টোকন-শােভন দুই ভাইকে শাস্তি দেয়া হবে। এই শাস্তি মাঝে মধ্যেই দেয়া হয়। শাস্তি প্রক্রিয়া ভয়াবহ।
ফাতেমা চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছেন। শােভন টোকনকে ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। যথা সময়ে তালা খুলে জামিলুর রহমান সেই ঘরে দড়ি হাতে ঢুকবেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেবেন। পরের এক ঘণ্টা ভেতর থেকে পশুর গােংগানীর মত শব্দ আসবে। | ফাতেমা স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় বললেন, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ বানিয়ে দেব ? | জামিলুর রহমান বললেন, না।
‘ওরা কি করেছে।
কি করেছে তােমার জানার দরকার নেই।’ ফাতেমা প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, ছেলেমানুষ ।
জামিলুর রহমান বললেন, দু’দিন পর এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। ছেলেমানুষ মােটেই না। দাড়ি গােফ উঠে গেছে ছেলেমানুষ কি ?
তুমিতাে সকালে চা খাও নি। চা বানিয়ে দিচ্ছি, চা খাও, তারপর যা ইচ্ছা কর। তুমি বাবা, তুমিতাে শাসন করতেই পার। আমার এই অনুরােধটা রাখ।
জামিলুর রহমান বললেন, যাও, চা আন । ফাতেমাকে যত বােকা মনে হয় তত বােকা তিনি বােধ হয় না। চা বানানাের কথা বলে তিনি সময় নিচ্ছেন। যত সময় যাবে রাগ তত পড়বে। চা বানিয়ে সুপ্রভার হাতে দিয়ে পাঠাতে হবে । মানুষটা এক মাত্র সুপ্রভার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলে। সুপ্রভা হাত
নেড়ে নেড়ে কি সব গল্প করে মানুষটা আগ্রহ নিয়ে শুনে। সুপ্রভাকে বলতে হবে মজার কোন দীর্ঘ গল্প সে যেন শুরু করে।
অপেক্ষা পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
ফাতেমা নিজেই চা বানাতে গেলেন। অনেক দিন চুলার পাশে যান না। শরীর ক্রমেই ভারী হয়ে যাচ্ছে। আগুনের আঁচ আজকাল আর সহ্য হয় না। মাথা দপ দপ করে।। | তালাবন্ধ ঘরের খাটে শােভন টোকন বসে আছে। শােভনকে মােটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তবে টোকন ভয় পেয়েছে। তার মধ্যে ছটফটানির ভাব
স্পষ্ট। সে বারবারই বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
তাদের অপরাধ মােটামুটি গুরুতর। এই অপরাধ আগে কয়েকবার করেছে, ধরা পড়ে নি। আজ সকালে ধরা পড়ে গেছে। ধরা পড়ার কোন কারণ ছিল না। দুই ভাইয়ের হিসেবে সামান্য গন্ডগােল হয়ে গেছে।
জামিলুর রহমান সকালবেলা বাথরুমে অনেকখানি সময় কাটান। তিনি । খবরের কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন এবং কাগজ শেষ করে বের হন। খুব কম করে হলেও পনেরাে মিনিট সময় লাগে। বাবার কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা সরানাের জন্যে এই সময়টা যথেষ্ট। তারা তাই করল। কিন্তু সামান্য গন্ডগােল হয়ে গেল। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় জামিলুর রহমান শােবার ঘরে ঢুকলেন। জামিলুর রহমান বললেন, তােরা আয় আমার সঙ্গে। তারা বাবার সঙ্গে গেল। এইখানে আরাে একটা ভুল করা হল। তারা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারত। পালিয়ে যাওয়া হল না। জামিলুর রহমান দুই ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলেন।
শােভনের পানির পিপাসা পেয়েছে। শাস্তি কখন শুরু হবে বলা যাচ্ছে না, পানি খেয়ে নিতে পারলে ভাল হত। পেছনের দিকের জানালাটা খােলা। সেই জানালা দিয়ে এক জগ পানি যদি কেউ দিত।