অপেক্ষা পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

শােভন খাট ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। জানালায় লম্বা করে শিক বসানাে। একটা শিক বাঁকানাে কোন কঠিন কাজ নাশাবল দিয়ে চাড় দিলেই শিক বাকবেদারােয়ান ভাইয়ের ঘরে শাবল আছে। 

অপেক্ষা

জানালার পাশে ইমনের মুখ দেখা গেলভয়ে তার মুখ শাদা হয়ে গেছেটোকনশােভন দুই ভাইই তার খুব প্রিয় মানুষরাতে সে এই ঘরে তাদের সঙ্গে ঘুমায়এদের ভয়াবহ শাস্তি কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে। ভাবতেই তার 

বুক শুকিয়ে আসছে। এর আগের বার শােভন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ডাক্তার আনতে হয়েছে, স্যালাইন দিতে হয়েছে। আজও নিশ্চয়ই সে রকম হবে। 

ইমন !’ 

যা চট করে এক জগ পানি নিয়ে আয়।’ ইমন ছুটে গেল পানি আনতে । পানির জগ শিকের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে না। সে জগ বদলে দু’টা পানির বােতল নিয়ে এল। শােভন বলল, বাবা কি করছে রে ? 

‘চা খাচ্ছেন। 

হাতে দড়ি আছে ? 

‘তুই একটা কাজ কর। দারােয়ান ভাইয়ের ঘর থেকে শাবলটা নিয়ে আয়। শাবল দিয়ে শিকে চাড় দিয়ে শিক বাঁকিয়ে ফেলবি । আমরা পগার পার হয়ে যাব। পারবি না?’ 

পারব।’ 

অপেক্ষা পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

তাহলে দেরি করিস না।’ ইমন শাবল আনতে ছুটে গেল। জানালার শিক বাঁকানাের কাজটা খুব সহজেই হয়ে গেল। দুই ভাই মুহর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল । 

জামিলুর রহমান তালা খুলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শীতল গলায় ডাকলেন, ইমন। 

ইমন ফ্যাকাশে মুখে ঘরে ঢুকল। জামিলুর রহমান বললেন, তুই কাঁপছিস কেন ? তুই কি করেছিস? ওদের সাহায্য করেছিস ? 

ইমন হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। ‘কি ভাবে সাহায্য করেছিস ? 

শাবল এনে দিয়েছি।’ সার্ট খােল। ইমন সার্ট খুলল।। 

বিছানায় উপুড় হয়ে থাক। আজ তােকে এমন একটা শিক্ষা দেব যে, জীবনে কখনাে অপরাধীকে সাহায্য করবি না। 

জামিলুর রহমান ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দড়ি হাতে নিলেন। ইমন দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যাবে । দরজা বন্ধ । ইচ্ছা থাকলেও কেউ তাকে বাঁচানাের জন্যে আসবে না। প্রচন্ড শারীরিক যন্ত্রণার সময় কোন প্রিয়জনকে ডাকতে ইচ্ছা করে। ইমন ফিস ফিস করে ডাকছে-– ছােট চাচা! ও ছােট চাচা। বাতাস কেটে দড়ি শাঁ শাঁ শব্দে নিচে নেমে আসছে। এই শব্দে ইমনের ডাকাডাকি চাপা পড়ে যাচ্ছে। ইমন অজ্ঞান হয়ে যাবার আগমুহূর্তে দেখল— জানালার শিক ধরে মিতু এসে দাঁড়িয়েছে। মিতুর গােলাকার মুখ লালচে হয়ে আছে । মিতু তীব্র স্বরে— সারা বাড়ি কাপিয়ে চিৎকার করে বলল— বাবা বাবা। 

এরপরে কি ঘটেছে ইমনের মনে নেই। 

সন্ধ্যাবেলা ফিরােজ এসে হতভম্ব। ইমন অর্ধচেতনের মত পড়ে আছে। তার সারা গায়ে ব্যাণ্ডেজ। শরীরে জ্বর। ঠোট কেটে ফুলে উঠেছে। 

ফিরােজ বলল, তাের কি হয়েছে ? ইমন বলল, কিছু হয় নি। ‘কিছু হয়নি মানে ? কে তােকে মেরেছে ? ‘বড় মামা।’ 

‘তাের বড় মামা কি পাগল ? এইভাবে কেউ কাউকে মারে ? সে পেয়েছে। কি ? বাড়িতে জায়গা দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে ? তাের এখানে থাকতে হবে 

তুই চলতাে।’ 

‘কোথায় যাব ? 

অপেক্ষা পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

‘আমার সঙ্গে যাবি। আমার মেসে থাকবি! মেসে থেকে পড়াশােনা করবি। তােকে আমি এই বাড়িতে রাখব না।’ 

মা যেতে দেবে না ছােট চাচা।’ ‘যেতে দেবে না মানে ? অবশ্যই যেতে দিতে হবে। আমি ভাবীর সঙ্গে কথা বলছি।’ 

ফিরােজ দোতলায় উঠে গেল। সুরাইয়া দোতলার বারান্দায় টুলের উপর বসে ছিলেন। তাঁর হাতে একটা বই। বইটার নাম স্বপ্ন তথ্য। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়া। স্বপ্নের ব্যাখ্যা পড়তে তার ভাল লাগে। ফিরােজকে দেখে তিনি বই বন্ধ করলেন। তার চোখে ঈষৎ বিরক্তি দেখা গেল। 

ভাবী কেমন আছেন ? 

ভাল। ইমনের কি অবস্থা আপনি দেখেছেন ? ‘দেখিনি— শুনেছি। অপরাধ করেছে— শাস্তি পেয়েছে।’ ‘এইভাবে কেউ কাউকে মারে ? 

‘ভাইজানের রাগ বেশী। তিনি যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। শাসনের দরকার আছে। শুধু আদরে কিছু হয় না।’ 

ভাবী, আমিতাে ইমনকে এখানে রাখব না।’ 

‘তুমি তাকে রাখা না রাখার কে? তুমি তাকে কোথায় নিয়ে রাখতে চাও ? তােমার মেসে ? খামাখা রাগ দেখিও না। খামাখা আদরও দেখিও না।’ 

ভাবী, আমি কোন রাগ দেখাচ্ছি না। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। 

‘এইসব মন খারাপের কোন দাম নেই। মাসে দুই মাসে একবার আসবে। সাথে থাকবে সস্তার কিছু খেলনা। খানিকক্ষণ কচলাকচলি করে চলে যাবে। এইসব আদরের মানে কি ? 

‘ভাবী আপনি আমার উপর কেন রাগ করছেন বুঝতে পারছি না।’ 

আমি রাগ করছি নাতাে। তােমার উপর রাগ করব কেন?’ ফিরােজ হতাশ গলায় বলল, ভাবী, আজ রাতটা আমি এই বাড়িতে থেকে যাব। ওর খুব জ্বর। ইমনের সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকি। ওর পাশে কারাের থাকা দরকার। 

সুরাইয়া স্বপ্ন তথ্যের বই খুলতে খুলতে শুকনাে গলায় বললেন, বাড়তি আদর দেখানাের কোন দরকার নেই। ওদের কপালে অনাদর লেখা— আমি চাই ওরা যেন অনাদরেই মানুষ হয়। 

আপনি কি ইমনকে দেখেছেন ? না।’ আপনার কি উচিত না, ওর পাশে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বসা। 

‘শােন ফিরােজ, আমার কি উচিত বা অনুচিত এই উপদেশ তুমি আমাকে দিতে এসাে না। আমি কাউকে উপদেশ দেই না। আমিও চাই না কেউ আমাকে উপদেশ দিক। এক কাজ কর আজ তুমি চলে যাও । অন্য একদিন এসাে । আজ তুমি উত্তেজিত। আমি নিজে সারাক্ষণ উত্তেজনার মধ্যে থাকি— অন্যের উত্তেজনা আমার ভাল লাগে না।’ 

অপেক্ষা পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

‘চলে যেতে বলছেন ? ‘হ্যা, চলে যেতে বলছি।’ ‘জামিল ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলে যাই।’ ‘অবশ্যই তুমি তার সঙ্গে কথা বলবে না। 

সুরাইয়া স্বপ্নের বই খুলে বসলেন। সাপ দেখলে, শত্রু বৃদ্ধি পায়, সাপ কামড়াতে দেখলে, অসুখ হয়। সাপ মারতে দেখা শুভ-শত্রু বিনাস হয়। সাপ ও সাপিনিকে শখ লাগা অবস্থায় দেখলে— ধন প্রাপ্তি কিংবা পুত্র সন্তান প্রাপ্তি । 

ইমনের জ্বর কমেছে। দুপুরে একশ দুই ছিল, এখন একশ। ঘুমের ওষুধ দেয়ার কারণে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। সারাদিনে কিছু খায়নি। কিছুক্ষণ আগে এক বাটি স্যুপ খেয়েছে। তার মাথার কাছে সুপ্রভা বসে আছে। সুপ্রভা তাকে গল্পের বই পড়ে শুনাচ্ছে । ইমনের গল্প শুনতে মােটেও ভাল লাগছে না। বেচারী এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছে বলে ইমন কিছু বলছে না। সুপ্রভা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে। ইমনের মনে হল তার বােনটা ঐতাে কিছুদিন আগেই হামাগুড়ি দিত— আজ এত বড় হয়ে গেছে। ভাইকে বই পড়ে শুনাচ্ছে— কি আশ্চর্য। সুপ্রভা রিনরিনে গলায় পড়ছে— লালমােহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু চোখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, রামমােহন রায়ের নাতি ছিল সেটা জানতেন? ফেলুদার মুখের উপর রুমাল চাপা, তাই 

সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *