অপেক্ষা পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

সুরাইয়া আয়নার সামনে বসে আছে। তার চোখে মুখে হতভম্ব ভাব। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সিঁথির কাছের কিছু চুল তামাটে হয়ে আছে। কি ভয়ংকর কথা! চুল পেকে যাচ্ছে ? না-কি হলুদ-টলুদ জাতীয় কোন রঙ লেগেছে ? হলুদ রঙ লাগবে কিভাবে ? কত বছর হল সে রান্না ঘরে যায় না। সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন- সুপ্রভা! 

অপেক্ষা

সুপ্রভা দরজা ধরে দাড়াল। সে আজ শখ করে তার মা’র শাড়ি পরেছে। নীল শাড়িতে সাদা সাদা বুটি। শাড়িটা যে এত সুন্দর আগে বােঝা যায় নি। পরার পর বােঝা যাচ্ছে। শাড়ি পরার জন্যে তাকে এত বড় লাগছে যে মনেই হচ্ছে না তার বয়স মাত্র তের। মনে হচ্ছে তরুনী এক মেয়ে যে সুযােগ পেলেই সবার চোখ এড়িয়ে তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে গল্প করে। সুপ্রভা এম্নিতেই দেখতে সুন্দর-শাড়ি পরায় আজ তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। একটু আগে মিতু তাকে দেখে বলেছে—সুপ্রভা, খবর্দার শাড়ি পরবি 

হিংসায় আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবি সারা গায়ে ফোসকা উঠে যাবে। 

সুরাইয়া মেয়েকে দেখে বলল, সুপ্রভা দেখতে আমার মাথার চুল পেকে যাচ্ছে নাকি ? 

সুপ্রভা বলল, হুঁ। ‘হু আবার কি ধরণের কথা। হয় বল হঁ্যা, নয় বল না। চুল পেকেছে ? সুপ্রভা ক্ষীণ গলায় বলল, হ্যা। সুরাইয়া তীব্র গলায় বলল, চুল পাকবে কেন ? এখনই কেন চুল পাকবে ? 

অপেক্ষা পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

সুপ্রভা এই প্রশ্নের কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। চুল পেকে গেলে সে কি করবে ? সেতাে আর একশ বছরের পুরানাে ঘি মায়ের মাথায় মাখিয়ে তার চুল পাকায় নি। এম্নিতেই সে মায়ের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। আজ সকাল থেকে ভয় বেশী লাগছে কারণ বান্ধবীর জন্মদিনে যাবার কথা যখন বলা হয়েছে 

মা বিশ্রী করে তাকিয়েছেন, কিছু বলেন নি। অথচ আগে ভাগে কথা ঠিক হয়ে আছে সবাই দল বেঁধে শাড়ি পরে যাবে। রাতে ঐ বাড়িতে থাকবে। সারা রাত গল্প করবে। তাদের বাড়িতে লেজার ডিস্ক প্লেয়ার আছে। সেই লেজার ডিস্কে ছবি দেখা হবে । যে ছবি দেখা হবে সেই ছবিও এনে রাখা হয়েছে, Sound of Music. 

‘শাড়ি পরেছিস কেন ?’ 

সুপ্রভা খুবই অবাক হল । সে মা’কে জানিয়েই শাড়ি পরেছে। আলমিরা থেকে মা নিজেই শাড়ি বের করে দিয়েছেন। এখন হঠাৎ এই কথা কেন ? 

‘শাড়ি পরার এইসব ঢং কোথেকে শিখলি ? তুই কোথায় আছিস তুই জানিস না। পরের বাড়িতে দাসীর মত পড়ে আছিস—রঙ করতে লজ্জা লাগে 

– বেহায়া মেয়ে ?’ সুরাইয়া দম নেবার জন্যে থামলেন । সুপ্রভা ভাবল এই ফাঁকে সে সরে যাবে। তবে এই কাজটা করাও ঠিক হবে না। সবচে ভাল হয় সে যদি মা’কে রাগ ঝাড়ার পুরাে সুযােগটা দেয়। | ‘টং এর মেয়ে। ঢংতাে ষােল আনার উপর দু’আনা আঠারাে আনা শিখেছিস। যা শেখার তাতে শিখছিস না। অংকে পেয়েছিস এগারাে। এমন কোন মেয়ে আছে যে অংকে এগারাে পায় ? বল, আছে কোন মেয়ে ? দে, কথার জবাব দে। চুপ করে থাকলে টেনে জিভ ছিড়ে ফেলব ? 

অপেক্ষা পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

সুপ্রভা মনে মনে মায়ের কথার জবাব দিল । এই কাজটা সে ভাল পারে । মা যখন প্রশ্ন করতে থাকেন তখন সে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিকই তবে মনে মনে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেয়। যে কোন প্রশ্নই মা তিনবার চারবার করে করেন। মা’র একই প্রশ্নের জবাব সুপ্রভা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেয়। তার বেশ মজা লাগে।। 

‘কি সার্কাসের সংএর মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? কথার জবাব দে ? আছে কোন মেয়ে যে অংকে এগারাে পায় ? 

সুপ্রভা মনে মনে বলল, হ্যা মা আছে। নন্দিতা বলে একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে আছে। সে পেয়েছে নয়। তােমার যদি বিশ্বাস না হয় তুমি নন্দিতার কাছে টেলিফোন করে জেনে নিতে পার। ওরা দারুণ বড়লােক। ওদের বাড়িতে তিনটা টেলিফোন । নন্দিতাও আজ জন্মদিনে যাবে । নন্দিতা পরবে লাল সিল্কের শাড়ি। রাজশাহী সিল্ক । সেরিকালচার বাের্ডে তার এক মামা চাকরি করেন তিনি এনে দিয়েছেন। 

সুরাইয়া বললেন—তুই এক্ষুণি শাড়ি খােল। বই খাতা নিয়ে বােস। ইমনকে বল অংক দেখিয়ে দিতে। 

সুপ্রভা মনে মনে বলল, দুপুর বেলা বই নিয়ে বসব কেন মা ? ইমন ভাইয়াকেও অংক দেখিয়ে দিতে বলা যাবে না। তার জ্বর। সে বিছানায় শুয়ে কে কে করছে। শাড়ি খুলে ফেলতে বলছ খুলে ফেলছি কিন্তু কোন কাপড়টা পরব তাও বলে দাও। যা পরব সেটা নিয়েইতাে তুমি কথা শুনাবে।এত কথা শুনতে কারাের ভাল লাগে না। বাবা যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, আমার ধারণা তােমার কথা শুনে পালিয়ে গেছে। এবং সে নিশ্চয়ই লক্ষী টাইপ কোন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে যে মেয়ে দশটা কথার উত্তরে একটা কথা বলে। তােমার মত ক্যাট ক্যাট করে না। 

অপেক্ষা পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

সুপ্রভা মা’র সামনে থেকে সরে গেল। তাকে দেখে মনেও হবে না সে। মনে দুঃখ পেয়েছে বা মন খারাপ করেছে। বরং মনে হবে একটু আগে তার জীবনে মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই আনন্দেই সে ঝলমল করছে। সুপ্রভা একতলায় মিতুর ঘরে ঢুকল। রাতে সে মিতুর সঙ্গে ঘুমায়। মিতুর ঘরটাই তার ঘর। মিতু আপার ঘরে থাকতে তার ভালই লাগে তবে আরাে ভাল লাগতাে যদি তার নিজের কোন ঘর থাকতাে। পুরাে ঘরটা সে সাজাতে নিজের মত করে। ঘরে খাট রাখত না। নন্দিতার মত মেঝেতে একটা ফোম বিছিয়ে রাখতাে। নিজের একটা সিডি প্লেয়ার থাকতাে। সারাক্ষণ গান শুনত। 

মিতু কাঁচাকলার ভর্তা বানাচ্ছিল। কাঁচাকলা কুচিকুচি করে কেটে তার সঙ্গে তেতুল, কাঁচামরিচ, লবন মিশিয়ে ভর্তা। কাঁচাকলার কষের সঙ্গে পরিমাণ মত তেতুল মিশাতে পারলে অসাধারণ একটা জিনিস তৈরী হয়। তেতুলের পরিমান ঠিক করাটাই জটিল। বেশী হলেও ভাল লাগবে না, কম হলেও ভাল লাগবে না। যে কোন ধরণের ভর্তা বানানাের ব্যাপারে মিতু মােটামুটি একজন বিশেষজ্ঞ। সুপ্রভা মিতুকে ডাকে “ভর্তা রাণী”। 

সুপ্রভা হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি আপা কেমন হয়েছে ? 

মিতু বিরক্ত গলায় বলল, আগে বানানাে হােক তারপর দেখবি। তুই যা চট করে রান্নাঘর থেকে ধনে পাতা নিয়ে আয়। অল্প ধনে পাতা কচলে দিয়ে 

দি। 

‘ধনে পাতা দিও না আপা। কলা ভর্তায় ধনে পাতার গন্ধ ভাল লাগে না।  

‘তােকে মাতব্বরী করতে হবে না। যা করতে বলছি কর।’ 

সুপ্রভা ধনে পাতা আনতে গেল। মিতু কি মনে করে যেন মুখ টিপে হাসল । সব মানুষের কিছু বিচিত্র স্বভাব আছে। মিতুরও আছে। তার বিচিত্র স্বভাবের একটা হচ্ছে যখন একা থাকে তখনই সে মুখ টিপে হাসে। আশে পাশে কেউ থাকলেই সে গম্ভীর। তখন তাকে দেখলে মনে হবে কাজ ছাড়া সে কিছু বুঝে না। কাজের বাইরের সব কিছুই তার অপছন্দ।

অপেক্ষা পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

 সুপ্রভা ধনে পাতা নিয়ে উপস্থিত হল। মিতু বলল, ইমনের জ্বর কত জানিস? 

‘একশ চার। আমি ঠিক করেছি ওর গায়ে পানি ভর্তি একটা কাপ ঘন্টা খানিক বসিয়ে রাখব। জ্বরের তাপে পানি গরম হবে। সেই পানি দিয়ে আমি চা বানিয়ে খাব।’ 

সুপ্রভা খিল খিল করে হাসতে লাগল । মিতু আপাকে এই জন্যেই তার এত ভাল লাগে। গম্ভীর মুখে এমন মজার মজার কথা বলবে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়। হাসি দেখে মিতু আপা আবার বিরক্ত হয়ে ধমক দেয়। কি আশ্চর্য মেয়ে, নিজেই হাসাবে আবার নিজেই ধমকাবে। | ‘সুপ্রভা হাসি থামা। বিশ্রী শব্দ করে হাসছিস কি ভাবে ? তুই তাে হায়ানা 

, মানুষ। তাের হাসি শুনে মনে হচ্ছে একটা মহিলা হায়ানা হাসছে। হাসি বন্ধ কর।’ 

সুপ্রভা হাসি বন্ধ করতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মিতু আপাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। মিতু আপা কোন রকম সাজগােজ করে না, অথচ তাকে দেখে মনে হয় সবসময় বাইরে যাবার জন্যে সেজে আছে। 

‘সুপ্রভা আয় একটা কাজ করি—ইমনের কাছে একটা উড়াে চিঠি ‘পাঠাই।’ 

‘কি উড়াে চিঠি ? 

‘প্রেমের চিঠি। কোন একটা মেয়ে লিখেছে এ রকম । ভুল বাংলায় আজে বাজে টাইপ। চিঠি পড়ে তার আত্মা কেঁপে উঠবে। কাউকে বলতেও পারবে 

, মুখ শুকনা করে ঘুরবে। আমরা দূর থেকে মজা দেখব । আইডিয়াটা কেমন ? 

ভাল। খুব ভাল।’ ‘চিঠিটা আমরা পােষ্টাপিস থেকে রেজিষ্ট্রি করে পাঠাব।’ ‘চিঠিটা কে লেখবে ? তুমি ? তােমার হাতের লেখাতাে চিনে ফেলবে। ‘আমার চার-পাঁচ রকম হ্যাণ্ড রাইটিং আছে। চেনার কোন উপায়ই নেই। ‘তাহলে আপা চল লিখে ফেলি।’ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *