সুরাইয়ার একটা ছেলেমানুষী স্বপ্ন হচ্ছে কোন একদিন তাদের টেলিফোন আসবে এবং সে তখন রােজ একঘন্টা করে ইমনের বাবার সঙ্গে কথা বলবে। মানুষটা বিরক্ত হােক বা রাগ হােক কিছুই যায় আসে না। সে কথা বলবেই।
ছেলের দাঁত পড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই কোন এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি না। টেলিফোনে এই খবর দিলে ইমনের বাবার রেগে যাবার সম্ভাবনা। তবে রাগটা সে প্রকাশ করবে না। যত রাগই হােক মায়া মায়া করে কথা বলবে। ফিরােজের জল বসন্ত এটাও দেবার মত খবর। সে এম এ পরীক্ষা দেবে না
এটাও বলা যেতে পারে। অনেক কিছুইতাে আছে বলার মত।
অবশ্যি আরেকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। সেই খবরটা টেলিফোনে দেয়া যাবে না। সব খবর কি আর টেলিফোনে দেয়া যায় ? সুরাইয়া টেলিফোন করা ঠিক করল ।।
ভারী এবং রাগী গলার এক ভদ্রলােক টেলিফোন ধরলেন, “কাকে চাই” এমন ভাবে বললেন যেন কাউকে চাওয়াটা শাস্তিযােগ্য অপরাধ। সুরাইয়া হকচকিয়ে গিয়ে বােকার মত বলল, দয়া করে ইমনের বাবাকে দিন।
‘ইমনের বাবার নামটা জানতে পারি ?
যুরাইয়া লজ্জিত গলায় নাম বলল। ভদ্রলােক বললেন, আপনি ধরে থাকুন, লাইন ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইমনের বাবা মায়া মায়া গলায় বলল, কে সুরাইয়া ? কেমন আছ ?
অপেক্ষা পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
সুরাইয়ার এত ভাল লাগলাে যে চোখে প্রায় পানি এসে গেল। সে বােকার মত বলে বসল, এখনাে আসছ না কেন ? ‘অফিস ছুটি হােক তারপর আসব।’
‘শােন, ইমনের দাঁত পড়ে গেছে। উপরের পাটির দাঁত, তাকে যে কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।’
তার কি দাঁত পড়ার মত বয়স হয়েছে ? ছয় বছরে দাঁত পড়ে, ওর পাঁচ বছর তিনমাস।’ ও আচ্ছা।’ ‘তােমার ভাইয়ের গায়ে গােটা গােটা কি যেন উঠেছে। ওর ধারণা জল-বসন্ত। সে জল-বসন্ত নিয়েই বাইরে গেছে।’
‘ও আচ্ছা।’ ‘আমাকে বলছিল সে এম এ পরীক্ষা দেবে না।’ “নিশ্চয়ই ঠাট্টা করেছে।’ ‘আমার কাছে ঠাট্টা বলে মনে হয় নি। আচ্ছা শােন, এই যে হঠাৎ লিফোন করলাম রাগ করনিতাে।
না, রাগ করব কেন? টেলিফোন করাটাতাে কোন ক্রাইম না।’ ‘তােমার বড় সাহেব, উনি কি তােমার দিকে তাকিয়ে আছেন ?
‘উনি তাকিয়ে থাকবেন কেন ? টেলিফোনতাে আমার টেবিলে। আমাকে টেলিফোন দিয়েছে।’
‘বল কি, কবে দিয়েছে ? ‘গত সপ্তাহে। ডিরেক্ট লাইন না । পি বি এক্স লাইন। ‘গত সপ্তাহে টেলিফোন দিয়েছে তুমি আমাকে বলনি কেন? ‘এটা কি বলার মত কোন ব্যাপার ?’।
‘অবশ্যই বলার মত ব্যাপার। আশ্চর্য তুমি এরকম কেন? আমাকে কিছুই বলনা। আচ্ছা শােন, তুমি আমাকে কার্ডফোনের একটা কার্ড করিয়ে দেবে, আমি রােজ তােমাকে টেলিফোন করব।
সুরাইয়া শুনল ইমনের বাবা হাসছে। ‘আজ কিন্তু অনেকক্ষণ তােমার সঙ্গে কথা বলব। তােমার কাজ থাকুক আর যাই থাকুক।’
অপেক্ষা পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
‘সুরাইয়া আজ চারটার সময় আমাদের একটা মিটিং আছে। আমাকে সেই মিটিং এর ফাইল তৈরী করতে হবে তিনটার মধ্যে। কাজেই তােমাকে টেলিফোন রাখতে হবে।
সুরাইয়া দুঃখিত গলায় বলল, ও আচ্ছা।
‘আমি এক কাজ করি আজ সকাল সকাল চলে আসি। তারপর কোন একটা স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে ইমনের একটা ছবি তুলে রাখি। বড় হয়ে দেখলে মজা পাবে।’
আচ্ছা।’ সুরাইয়া রাখি ?
ইমনের বাবা টেলিফোন রেখে দিল। সুরাইয়া তারপরেও বেশ কিছু সময় টেলিফোন কানে ধরে রাখল। পাে পাে শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে এমন খারাপ লাগছে। আর কাউকে কি টেলিফোন করা যায় ? ছেলের দাঁত পড়েছে এই খবরটা নিশ্চয়ই অন্যকে দেবার মত। বড় ভাইজানকে কি খবরটা দেব ? সুরাইয়া মনস্থির করতে পারছে না। তার বড় ভাই জামিলুর রহমান শুকনা ধরণের
মানুষ। নিজের ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছুই বুঝেন না। তিনি কোন কিছুতে বিরক্তও হন না, বা আনন্দিতও হন না।
সুরাইয়া ভাইজানের বাড়িতে টেলিফোন করল। জামিলুর রহমান টেলিফোন ধরলেন এবং গম্ভীর গলায় হ্যালাে বলার বদলে বললেন, কে ?
সুরাইয়া বলল, ভাইজান আমি সুরাইয়া । “কি ব্যাপার ?’
না কিছু না, এমনি খবর নেয়ার জন্যে টেলিফোন করলাম। আপনারা ভাল আছেন ?
হা। ‘ভাবী—ভাবী ভাল আছেন ?
হঁ্যা।’ “ইমনের আজ একটা দাঁত পড়েছে। “ও আচ্ছা।’
‘মিতুর কি দাঁত পড়েছে ? মিতুর বয়সতাে ইমনের কাছাকাছি। ইমনের দুই মাসের ছােট। মিতুর দাঁত পড়ে নি ?
‘জানিনাতাে। ‘আপনার শরীর ভাল আছে ভাইজান ?’
‘হজমের যে সমস্যা ছিল সমস্যা মিটেছে ?
‘না আছে। সুরাইয়া এখন রাখি-আমাকে একটু পুরােনাে ঢাকায় যেতে হবে। তােরা একদিন চলে আসিস। জামাইকে নিয়ে আসিস। তোের শাশুড়িকেও নিয়ে আসিস।
অপেক্ষা পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
সুরাইয়া কিছু বলার আগেই তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। সুরাইয়া তারপরেও টেলিফোন কানে দিয়ে রাখল। পোঁ পোঁ শব্দ হচ্ছে। মন খারাপ করা শব্দ। তারপরেও আজ কেন জানি শব্দটা শুনতে ভাল লাগছে। মানুষের জীবনে একেকটা দিন একেক রকম হয়ে আসে। কোন কোন দিনে মন খারাপ হবার মত ব্যাপার ঘটলেও মন খারাপ হয় না বরং মন ভাল হয়ে যায়। আজ মনে হয়
সে রকম একটা দিন।
ব্যাপারটা কি ? রাত এগারােটা বাজে ইমনের বাবা এখনাে আসছে না। সুরাইয়া প্রাণপণ চেষ্টা করছে দুঃশ্চিন্তা না করতে। যেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরার কথা থাকে সেদিন দেরি হয় এটা জানা কথা। তার কোন বন্ধু হয়তাে তাকে বাসায় ধরে নিয়ে গেছে। তার ছেলের জন্মদিন বা এই জাতীয় কিছু। রাতে না খাইয়ে ছাড়বে না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্প করতে করতে দেরি হচ্ছে।
সুরাইয়া বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। একবার ফিরােজের ঘরে উঁকি দিল । ফিরােজও ফিরে নি। তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সে প্রায়ই রাত বিরেতে বাড়ি ফেরে । একবার ফিরে ছিল রাত তিনটায় । কিন্তু ইমনের বাবাতাে কখনাে এত দেরি করে না। সত্যিকারের কোন বিপদ হয়নিতাে ? বড় শহরের বিপদগুলিও হয় বড় বড়। কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ গণ্ডগােল লেগে যায়। গাড়ির কাচ ভাঙ্গা হতে থাকে, ককটেল ফুটতে থাকে। এক সময় পুলিশের গাড়ি আসে।
বেশির ভাগ সময়ই পুলিশরা গাড়ি থেকে নামে না। যদি নামে তাহলে নিরীহ মানুষ যারা সাতেও নেই পাঁচেও নেই তাদের দিকে হুংকার দিয়ে ছুটে যায়। লাঠি পেটা করে। মাথা ফাটিয়ে দেয়। যেদিন কোথাও কোন গণ্ডগােল থাকে না সেদিন ফুটপাতে ট্রাক উঠে পড়ে। এই অদ্ভুত শহরে নিশ্চিন্ত হয়ে ফুটপাথ দিয়েও হাঁটার উপায় নেই।
অপেক্ষা পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
আজ কি শহরে কোন গণ্ডগােল হচ্ছে ?
পত্রিকায়তাে কিছু লেখেনি। পত্রিকাটা অবশ্যি সুরাইয়ার ভালমত পড়া হয়নি। এখন বারান্দায় বসে পত্রিকাটা পড়া যায়। এতে সময়টা কাটবে । সুরাইয়ার কেন জানি মনে হচ্ছে রাত বারােটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ইমনের বাবা আসবে। তার আবার যা মনে হয় তাই হয়। সুরাইয়া পত্রিকা নিয়ে বসল। রাত বারােটা পাঁচ পর্যন্ত সে পত্রিকা পড়ল। কেউ এল না । সুরাইয়ার বমি বমি লাগছে। এই বমি, উদ্বেগ জনিত বমি না।
এর কারণ ভিন্ন। তার শরীরে আরাে একজন মানুষ বাস করছে। সে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মানুষটার কথা হাসানকে এখনাে বলা হয়নি। আজ বলে ফেললে কেমন হয়। শুধু তার শাশুড়ি জানেন। ছেলের বাড়িতে পা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিচু গলায় বললেন, ও বউ, তােমার কয় মাস ? সুরাইয়া হতভম্ব। তার মাত্র তিনমাস চলছে! কারাে কিছু বােঝার কথাই না। তিনি কি করে বুঝলেন ? পুরানাে দিনের মানুষদের চোখ এত তীক্ষ্ণ ?
আকলিমা বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি জেগে থাকলে সুরাইয়া তার উদ্বেগের খানিকটা তাঁর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারত। তাঁকে কি ডেকে তুলবে ? না, আরাে আধঘন্টা যাক । তাকে না জাগানােই ভাল। তিনি জেগে গেলে ঝামেলা করবেন। কান্নাকাটিও শুরু করতে পারেন। এই বয়সের মানুষদের মাথার ঠিক থাকে না। আকলিমা বেগমের মাথা একটু মনে হয় বেশী রকমের বেঠিক।
অপেক্ষা পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
তিনি রাতে ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত একটা দেড়টার দিকে জেগে ওঠেন। শুরু হয় একা একা কথা বলা, বারান্দায় হাঁটা। মাঝে মধ্যে গানের মত সুর করে কি জানি বলেন। শুনতে ভাল লাগে প্রথমবার শুনে সুরাইয়া চমকে ওঠে বলেছিল, আম্মা গান গাচ্ছেন নাকি ? হাসান বিরক্ত গলায় বলেছে, গান গাইবে কেন ? টেনে টেনে কথা বলছে।
কথাগুলি কি বুঝতে পারছ ? না।’ “উনি কি সব সময় এ রকম করেন না আজই করছেন?
প্রায়ই করেন। ফালতু আলাপ বন্ধ করে ঘুমানাের চেষ্টা কর।
সুরাইয়া বারান্দায় বসে আছে। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায় না। বাড়িওয়ালা তার বাড়ির চারদিকে খুব উঁচু করে দেয়াল দিয়েছে। দেয়ালে আবার সূচালাে লােহার শিক বসানাে—যেন চোর দেয়াল টপকে ঢুকতে না পারে। গেট আছে। গেটে দারােয়ান নেই। সব ভাড়াটের কাছে একটা করে চাবি দেয়া। রাতে বিরেতে কেউ ফিরলে চাবি দিয়ে গেট খুলে ঢুকতে হবে। তিন তলা বাড়ির এক তলায় দু’জন ভাড়াটে থাকেন। তিন তলায়ও দু’জন ভাড়াটে। দু’তলার সবটা নিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালা।
এদের কারাের সঙ্গেই। সুরাইয়ার কোন যােগ নেই। যােগ থাকলে ভাল হত- আজ এই বিপদের সময় এদের কাছে ছুটে যাওয়া যেত । বিপদে তারা কি করত না করত সেটা পরের কথা। সুরাইয়াদের পাশের ডান দিকের ফ্ল্যাটে থাকেন আব্দুল মজিদ সাহেব। বেঁটে খাট মানুষ। গাট্টা গােট্টা চেহারা। মখে সব সময় পান। সকালে যখন ব্রিফ কেস হাতে বের হন তখন ভুর ভুর করে জর্দার গন্ধ পাওয়া যায়।সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা হলে থমকে দাঁড়ান। অকারণে গলা খাকাড়ি দেন। তার চোখের দৃষ্টি গা বেয়ে নামতে থাকে। ভয়ংকর ব্যাপার। সুরাইয়ার কয়েকবারই ইচ্ছে করেছে বলে—আপনি এই ভাবে তাকান কেন ?
অপেক্ষা পর্ব (২)- হুমায়ূন আহমেদ
এ ভাবে তাকাবেন না। আমি নিতান্তই ভদ্র মেয়ে বলে কিছু বলছি না। কোন একদিন কঠিন কোন মেয়ের পাল্লায় পড়বেন, সে উলের কাঁটা দিয়ে আপনার চোখ গেলে দেবে । বিপদ যত বড়ই হােক—আব্দুল মজিদ সাহেবের কাছে যাওয়া যাবে না।
কোথাও কি টেলিফোন করা যায় ? বাড়িওয়ালা সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লেও তাদের ছােট মেয়েটা এবার এস. এস. সি. পরীক্ষা দিচ্ছে। বলতে গেলে প্রায় সারা রাত জেগে পড়ে। দরজায় ধাক্কা দিলেই সে দরজা খুলে দেবে। কোথায় টেলিফোন করবে ?