ভাইজানের বাড়িতে ? তাকে কি বলবে ? ভাইজান দশটার ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন। একবার ঘুমিয়ে পড়লে তাকে জাগানাে নিষেধ। ভয়ংকর বিপদ এই কথা বললে তাঁকে হয়ত ডেকে দেবে-তিনি সব শুনে হাই তুলতে তুলতে বলবেন—এত রাতে কোথায় খোঁজ করবি ? সকাল হােক। তাছাড়া পুরুষ মানুষ এরা এক দুই রাত বাইরে থাকেই।
অফিসে? অফিস কি কেউ রাত একটা পর্যন্ত খােলা রাখে। হাসপাতালে ? এক্সিডেন্ট করে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কি-না জানতে চাওয়া। নাম হাসানুজ্জামান বয়স বত্রিশ। পরনে চেক ফুল সার্ট, খয়েরী প্যান্ট। পায়ে স্যাণ্ডেল। চোখে কালাে ফ্রেমের চশমা। গায়ের রঙ ফর্সা। দেখতে সুন্দর হালকা পাতলা। টেলিফোনে তার গলার স্বর খুব মিষ্টি।
সুরাইয়া চমকে উঠল । ছিঃ ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে ? হাসপাতালের কথা মনে আসছে কেন ? মানুষটা হাসপাতালে কেন যাবে ? কু চিন্তা মনে আসা ঠিক না। যে চিন্তা মনে আসে তাই হয়। ভাল কোন চিন্তা মনে আনতে হবে। সুন্দর কোন চিন্তা ।
‘বৌমা! বারিন্দায় বইসা আছ কেন?’
সুরাইয়া উঠে দাঁড়াল। আকলিমা বেগমের ঘুম ভেঙ্গেছে। তিনি বারান্দায় চলে এসেছেন। বাকি রাতটা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে এবং গান গেয়ে কাটাবেন। সুরাইয়া বলল, আম্মা ও এখনাে ফেরেনি।
অপেক্ষা পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
রাইত কত হইছে ? ‘দু’টা বাজতে পাঁচ মিনিট।
‘রাইততাে মেলা হইছে।
‘তুমি ভাত খাইছ ? “জ্বি না।’
‘যাও, তুমি গিয়া ভাত খাও। চিন্তার কিছু নাই—পুরুষ মানুষ দুই এক রাইত দেরী করেই। এইটা নিয়া চিন্তার কিছু নাই। বন্ধু-বান্ধবের বাড়িত গেছে, ‘টাশ’ খেলতাছে।’
‘ও তাস খেলে না মা।
‘খেলে না বইল্যা যে কোনদিন খেলব না এমুন কোন কথা নাই । বিলাই আর পুরুষ মানুষ এই দুই জাতের কোন বিশ্বাস নাই। দুইটাই ছােকছুকানি জাত। যাও, ভাত খাইতে যাও—আমি বসতেছি। যাও কইলাম।
সুরাইয়া রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। রান্নাঘরে না যাওয়া পর্যন্ত তার শাশুড়ি এই একটা বিষয় নিয়েই কথা বলতে থাকবেন—ভাত খাও, ভাত খাও। গ্রামের মানুষদের কাছে ভাত খাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইমনকে রাতে খাওয়ানাের সময় সুরাইয়ার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল। ক্ষিধের যন্ত্রনায় নাড়ি পাক দিচ্ছিল। এখন একেবারেই ক্ষিধে নেই। বরং বমি বমি ভাব হচ্ছে। এক গ্লাস লেবুর সরবত বানানাে যায়। ঘরে আর কিছু থাকুক না থাকুক লেবু আছে। ইমনের বাবা লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। গরম ভাত ছাড়া খেতে পারে না। পাতে যখন ভাত দেয়া হবে তখন সেই ভাতে ফ্যান মাখা থাকতে হবে ।
ফ্যান ভাত থেকে ধোঁয়া উঠতে হবে। এমন গরম ভাত মানুষ কপ কপ করে কি ভাবে খায় কে জানে। | সুরাইয়া চুলা ধরাল। রাতের বেলা হাসান যখন বলে- ভাত বার, ক্ষিধে । লেগেছে। তখনই সে চুলা ধরিয়ে আধাপট চাল দিয়ে দেয়। হাসানের হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে আসতে আসতে চাল ফুটে যায়। আজকের অবস্থা ভিন্ন। ভাত রাধা থাকুক। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ভাত রাধতেওতাে কিছু সময় যাবে।
অপেক্ষা পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
আকলিমা বেগম মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছেন। তিনি চেয়ারে বসতে পারেন না, খাটে বসতে পারেন না। রাতে ঘুমুবার সময়ও মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমান। সুরাইয়া মেঝেতে মশারি খাটিয়ে দিতে চেয়েছে, তিনি রাজি হন নি। মশারা নাকি তাঁকে কামড়ায় না।
‘বুড়া মাইনষের রক্তে কোন “টেস” নাই গাে বউ। শইল্যে মশা বয় ঠিকই- কামুড় দেয় না।’
আজ আকলিমা বেগমকে মশা কামড়াচ্ছে। তিনি এর মধ্যে কয়েকটা মশা মেরে ফেলেছেন। মৃত মশাগুলি জড় করছেন। যেন এরা মহামূল্যবান কোন প্রাণী, এদের মৃতদেহগুলির প্রয়ােজন আছে। আকলিমা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। এত রাত হয়ে গেল ছেলে বাসায় ফিরছে না কেন? এই বয়সে সবচে খারাপটাই আগে মনে হয় ।
ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে কি ? আজকের রাতটা কি ভয়ংকর কোন রাত ? তার সত্তর বছরের জীবনে অনেক ভয়ংকর রাত এসেছে- এবং চলেও গেছে। হাসানের বাবার মৃত্যুর কথাই ধরা যাক কবুতরের খুপড়িতে হাত দিয়েছে। কবুতর ধরবে। নতুন আলু দিয়ে কবুতরের মাংস রান্না হবে। হাত দিয়েই হাত টেনে নিল-রাঙ্গা বউ ইন্দুরে কামড় দিছে। কবুতরের বাসাত ইন্দুর।
না, ইদুর না—সাপ। বিরাট এক সাপ। তাদের চোখের সামনেই কবুতরের খােপ থেকে বের হয়ে এল। দু’জনই হতভম্ব। আকলিমা বেগম দিশা হারালেন না, সঙ্গে সঙ্গেই পাটের কোষ্টা দিয়ে হাত বাঁধলেন । ওঝা আনতে লােক পাঠালেন। কালা গরুর দুধে হাত ডুবিয়ে রাখলেন। শাদা বর্ণের দুধ যদি কালচে হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে জীবনের আশা নেই । দুধ কালচে হল ।
অপেক্ষা পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
আকলিকা বেগম আশায় আশায় বুক বাঁধলেন। ওঝা এসে পড়ল দুপুরের মধ্যে। ঘন্টা খানিক ঝাড়ফুকের পর বাঁধন খােলা হল। মানুষটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হাত জ্বইল্যা যাইতেছিল- এখন ব্যথা কমছে। পানি খাব বউ । পানি দাও। পানি আনা হল। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মুখে দেবার আগেই লােকটা মারা গেল।
এইসব কথা আকলিমা বেগম মনে করতে চান না, তবু মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে। লােকটা পানি খেয়ে মরতে পারল না- ভরা গ্লাস হাতে নিয়ে ধড়ফড় করে মরে গেল এই দুঃখও কম কি? জগতের কোন দুঃখই কম না। ছােট দুঃখ, বড় দুঃখ, সব দুঃখই সমান।।
আজ তার জন্যে কি দুঃখ অপেক্ষা করছে কে জানে। মন শক্ত করে রাখতে হবে। বাচ্চা বউটার দিকে তাকিয়ে মন শক্ত করতে হবে। বাচ্চা মানুষ দুঃখ পেয়ে অভ্যাস নেই। বউটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাত পার করতে
হবে। দিনের বেলা যে কোন কষ্টই সহনীয় মনে হয়- রাতে ভিন্ন ব্যাপার । কিছু কিছু রাতকে এই জন্যে বলে কাল-রাত। কালদিন’ বলে কিছু নেই। এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার, তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন—নরম মেয়েগুলি কঠিন বিপদ সামাল দিতে পারে। শক্ত মেয়েগুলি পারে না। চিৎ হয়ে পড়ে যায়। এই শক্তের একটা গেরাইম্যা, নাম আছে—“চিৎ শক্ত”।
অপেক্ষা পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
‘আম্মা, চা নেন।
আকলিমা বেগম চায়ের কাপ হাতে নিলেন। শহরে এলে তাঁর চা খাবার রােগে ধরে। বৌটা এই ভয়ংকর সময়েও চা বানিয়েছে, এটা ভাল লক্ষণ। মন। শক্ত আছে । আসল বিপদ সামাল দিতে পারবে।
“বৌমা বাজে কয়টা?
দুইটা পঁচিশ। ‘রাইত কাটতে বেশী দিরং নাই- তুমি ভাত খাইছ ?
তুমি ভাত খাও নাই- মিছা কথা বলছ। মুরুব্বির সাথে মিছা কথা বলা ঠিক না। যাই হউক, চেয়ার টান দিয়া আমার সামনে বও, তােমার লগে
আলাপ আছে।’
সুরাইয়া চেয়ার টেনে বসল। কেন জানি তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
‘বউমা মন দিয়া শােন- আমি একটা গনা গনছি। গনার মধ্যে পাইছি হাসান ভাল আছে। কাজেই মন খারাপ করবা না। সে আসব সালে।
‘কি গুনা-গুনেছেন ?
‘সেইটা তুমি বুঝবানা—আমি পুরান কালের মানুষ আমি অনেক গনা জানি।
আকলিমা বেগম কোন গনা জানেন না। বাচ্চা মেয়েটার মন শান্ত করার জন্যে কিছু মিথ্যা কথা বলা। এই মিথ্যা বলার জন্যে তাঁর পাপ হচ্ছে আবার মেয়েটার মন শান্ত করায় পূণ্য হচ্ছে। পাপ-পূণ্যে কাটাকাটি হয়ে সমান সমান।
ইমন জেগে উঠেছে। কাঁদছে। তাকে বাথরুম করাতে হবে। সুরাইয়া ছেলের কাছে গেল। আকলিমা বেগম আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক
দিচ্ছেন । ছেলে ফিরছে না এই দুঃশ্চিন্তা এখন আর তার মাথায় নেই । গনার ব্যাপারে যা বলেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা। বাচ্চা মেয়েটাকে শান্ত করার জন্যেই বলা। বউটা তাকে দেখতে না পারলেও তিনি তাকে খুবই পছন্দ করেন। মেয়েটার মনে দরদ আছে। স্বামীর জন্যে সে খুবই ব্যস্ত। আকলিমা বেগমের ঘুম পাচ্ছে। তিনি বারান্দা থেকে উঠলেন। কিছুক্ষণ ঘুমালেও কাজে আসবে। সকালে কোন ভয়ংকর সংবাদ এসে উপস্থিত হয় কে জানে।
অপেক্ষা পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
ইমন বাথরুম করল। পানি খেল । সব কিছুই ঘুমের মধ্যে। সুরাইয়া তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘুমের মধ্যেই সে বিড় বিড় করে কথা বলছে। আবার মাঝে মাঝে দাঁত কট কট করছে। পেটে কৃমি হয়েছে না-কি ? যে ভাবে চিনি খায় পেটে কৃমি হওয়া বিচিত্র না । সুরাইয়া ক্লান্ত গলায় ডাকল—ও বাবু, ও বাবু! ইমন ঘুমের মধ্যেই বলল, কি।।
‘তােমার বাবা এখনাে আসছে না কেন গাে বাবু ?
‘আমার খুব অস্থির লাগছে গাে সােনা।
ইমন আবারাে বলল, উঁ। আর তখনি বারান্দায় রাখা পানির বালতি থেকে পায়ে পানি ঢালার শব্দ হল। এই শব্দ সুরাইয়ার পরিচিত শব্দ। ইমনের বাবা বাইরে থেকে এলেই প্রথম যে কাজটা করে—বালতি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালে। তার জন্যে বালতি ভরতি পানি এবং একটা মগ বারান্দায় রাখা থাকে।
সুরাইয়ার শরীর ঝিম ঝিম করছে। ছুটে গিয়ে যে দেখবে সেই শক্তিও তার নেই। বারান্দায় যেতে ভয় লাগছে। গিয়ে যদি দেখে সে না, ইমনের দাদী নামাজের অজু করছেন। রাত বিরাতে অজু করার অভ্যাস।
নামাজের জন্যে অজু করবেন, তারপর নামাজ পড়তে ভুলে যাবেন।
সুরাইয়া উঠল । বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
ইমনের বাবা না, ফিরােজ। বালতি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালছে। ফিরােজ বলল, কি হয়েছে ভাবী ? এ ভাবে তাকিয়ে আছ কেন ?
সুরাইয়া জবাব দিতে পারল না, তার মাথা ঘুরে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে দেয়াল ধরতে চেষ্টা করল। ধরতে পারল না। ফিরােজ ছুটে এসে ধরে ফেলার আগেই মেঝেতে পড়ে গেল ।
অপেক্ষা পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ
ইদানীং ফিরােজের একটা সমস্যা হচ্ছে রিকশায় চড়তে পারে না। রিকশায় চড়লেই মনে হয় কাত হয়ে রিকশা পড়ে যাবে। সে ছিটকে পড়বে রিকশা থেকে। তাকে রাস্তা থেকে টেনে তােলার আগেই পেছনে “সমগ্র বাংলাদেশ সাত টন” লেখা একটা ঘাতক ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সে পট-পট জাতীয় মুড়িভাজার মত শব্দ শুনবে । শব্দটা ট্রাকের চাকার নিচে তার মাথার খুলি ভাঙ্গার শব্দ! মৃত্যুর আগের মুহূর্তে যে গন্ধ তার নাকে ঢুকবে সে গন্ধটা হল – পেট্রোলের গন্ধ এবং ট্রাকের চাকার গন্ধ। শেষ দৃশ্য হিসেবে দেখবে ট্রাকের মাডগার্ড।