অপেক্ষা পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

ফিরােজ বুঝতে পারছে তার মানসিক কিছু সমস্যা হচ্ছে। সমস্যাটা মনে হয় বাড়ছে। রিকশায় উঠেই সে সারাক্ষণ পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি ট্রাক এল। বিদেশে এ জাতীয় সমস্যা হলে লােকজন আতংকে অস্থির হয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে চলে যেত।

অপেক্ষা

বাংলাদেশে এরচে ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে লােকজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতাে ঘােরাফেরা করে। সে যেমন করছে। ফিরােজের ধারণা সে পুরােপুরি না হলেও অস্বাভাবিক একজন মানুষ যে রিকশা পছন্দ করে না, তারপরেও প্রায় সারাদিনই রিকশার উপর থাকে। রিকশা ভাড়া করে ঘণ্টা হিসেবে। সারাদিনের জন্যে ভাড়া করলে সস্তা পাওয়া যায়। সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাড়া ২০০ টাকা। দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তা এবং মাঝে মধ্যে চা এই ২০০ টাকার বাইরে।

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ফিরােজ সারাদিনের জন্যে রিকশা ভাড়া করেছে। আজও করেছে। গত কয়েক মাস ধরে তাকে বিচিত্র সব জায়গায় অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে যেতে হচ্ছে । আজ দুপুর দু’টায় এক ভদ্রলােকের সঙ্গে সে দেখা করবে। ভদ্রলােকের নাম রকিব। তিনি নাকি থিওসফিক্যাল সােসাইটির সদস্য। বিখ্যাত মিডিয়াম। হারানাে মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারেন। অনেকের অনেক হারানাে ছেলেপুলে সম্পর্কে নির্ভুল সংবাদ দিয়েছেন। ভদ্রলােক ফ্রড না, কারণ তিনি টাকা পয়সা নেন না। তবে ফ্রড না হলেও বিরক্তিকর মানুষতাে বটেই। কয়েকদিন পর পর আসতে ।

অপেক্ষা পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

বলেন, এবং অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে আসতে বলেন। দুপুর দু’টা, বিকাল সাড়ে তিনটা । ভদ্রলােক কথা বলতে পছন্দ করেন। সব কথাবার্তাই পরকাল, মন্ত্র-তন্ত্র, ভূত-প্রেত বিষয়ক। দুপুর বেলা ভূত-প্রেতের কথা শুনতে ভাল লাগে 

ফিরােজ গম্ভীর মুখে শুনে যায়। গরজটা তার । 

গত কয়েক মাসে ফিরােজের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার ধারণা এই অভিজ্ঞতা না হলেও কোন ক্ষতি ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হল— মানুষের মূল্য খুবই সামান্য। দশ হাজার টাকা হারিয়ে গেলে কুড়ি বছর পরেও সেই টাকার শােকে মানুষ কাতর হয়। মানুষ হারিয়ে গেলে কুড়ি দিন পরই আমরা মােটামুটিভাবে তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি। 

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে হারানাে মানুষ খুঁজে বের করার কোন পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। থানায় গেলে পুলিশ অফিসার বিরক্ত মুখে বলেন– “জিডি এন্ট্রি করুন।” বলেই তিনি হাই তুলেন। মানুষ হারানাের সংবাদ পুলিশের কাছে হাই তােলার মত ব্যাপার। ফিরােজ থানার সেকেন্ড অফিসারের হাই অগ্রাহ্য করেই জিডি এন্ট্রি করিয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, এখন কি? 

সেকেন্ড অফিসার বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন কি মানে ? “জিডি এন্ট্রিতে করানাে হল— এখন আপনারা কি করবেন ? ‘আমরা একশান নেব।’ ‘কি একশান নেবেন? ‘কি একশান নেব সেটাতাে আমাদের ব্যাপার। আপনার কিছু না। 

ফিরােজ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল— আমি আসলে জানতে চাচ্ছি– নিখোজ মানুষের বিষয়ে আপনারা কি করেন। 

‘সব থানায় ইনফর্ম করা হয়।’ 

তারপর ? তারপর মানে ? সব থানায় আপনারা জানালেন—তারপর থানাগুলি থেকে কি করা হয়। 

সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, সত্যি কথা জানতে চান ? কিছুই করা হয় না। 

অপেক্ষা পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

‘কিছুই করা হয় না ? 

‘কি করা হবে ? আপনার কি ধারণা থানার স্টাফ হারিকেন জ্বালিয়ে আপনার ভাইকে খুঁজতে বের হবে ? খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি দেখেই এরা কুল পায় 

মানুষ খুঁজে বেড়াবে কখন ? 

তাহলে মানুষ নিখোজ হলে আমরা থানায় খবর দেই কেন ? ‘রেকর্ডের জন্যে দেই। একটা রেকর্ড থাকল। থানার রেকর্ডের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই রেকর্ড থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বের হয়ে আসে । এমনওতাে হতে পারে যে আপনি আপনার ভাইকে খুন করে ডেডবডি গুম করে থানায় এসে জিডি এন্ট্রি করালেন ভাই মিসিং। হতে পারে না? 

‘জ্বি না, হতে পারে না।’ 

‘আপনার কাছে হতে পারে না, কিন্তু অনেকের কাছে হতে পারে। আমার চাকরি বেশীদিন হয় নি—এর মধ্যেই এ ধরনের কেইস গােটা দশেক দেখেছি।’ 

বলেন কি ? | ‘খুব বেশী দুঃশ্চিন্তা করবেন না। অল্প বয়েসী মেয়ে-টেয়ে হারিয়ে গেলে টেনশানের ব্যাপার থাকে। মেয়েরা ব্রোথেলে চলে যায়। বিদেশে চলে যায়। যৌনকর্মী হিসেবে বিদেশে বাংলাদেশী মেয়েদের সুনাম আছে।’ 

কি বলছেন এসব?’ 

‘শুনতে খারাপ লাগছে ? সত্যি কথা শুনতে সব সময় চিরতার পানির মত লাগে। চিরতার পানি খেয়েছেন ? না খেলে খাবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খেতেন। শরীরের জন্যে ভাল। শরীরটা ভাল রাখুন-Health is Wealth. 

‘তাহলে আমি কি ধরে নেব— আপনারা আমার নিখোঁজ ভাই সম্পর্কে কিছু করবেন না ? 

‘কিছুই ধরে নেবেন না। একটা ভাল উপদেশ দেই শুনুন— ভাইয়ের ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে থাকুন। চালু পত্রিকাগুলিতে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দিন। খবর্দার, কোন পুরস্কার ঘােষণা করবেন না। পুরস্কার ঘােষণা করেছেন কি মরেছেন। জীবন অতিষ্ট হয়ে যাবে। ভাল একটা উপদেশ ফি ছাড়া আপনাকে দিলাম। 

অপেক্ষা পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

গত কয়েক মাসে ফিরােজের অন্যতম ও প্রধান কাজ হয়েছে উপদেশ শােনা। এবং প্রতিটি উপদেশ মানার চেষ্টা করা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। শুরুতে প্রতিদিন। তারপর সপ্তাহে একদিন। তারপর একটি পত্রিকায় প্রতি পনেরাে দিনে একবার। শুধু দেশী পত্রিকায় না—একজনের উপদেশ শুনে কোলকাতার আনন্দবাজার এবং স্টেটসম্যানেও বিজ্ঞাপন দিয়েছে। 

আরেকজনের উপদেশ শুনে জাতিসংঘের মিসিং পারসন ব্যুরােতে কুড়ি ডলার খরচ করে নাম এন্ট্রি করিয়েছে। এরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চল এবং শরণার্থী মিসিং পারসনের তালিকা তৈরী করে। 

একজন ফিরােজকে বলল ( ফিসফিসানি গলায়) পাসপাের্ট অফিসে খোঁজ নাও তােমার ভাই রিসেন্টলি কোন পাসপাের্ট করিয়েছে কি-না। মানুষের ভেতরে অনেক জটিলতা থাকে— চট করে বােঝা যায় না। আমি একজনকে জানি ফ্যামিলী ম্যান। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্যে অসীম মমতা। হঠাৎ সে মিসিং পারসন হয়ে গেল ।

পাসপাের্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে পাসপাের্ট করিয়েছে। সেই পাসপাের্টের সূত্র ধরে জানা গেল সে চলে গেছে অস্ট্রেলীয়ায়। খুব পাকাপাকিভাবে গিয়েছে ইমিগ্রেশন নিয়ে। অন্য একটা মেয়েকে বউ হিসেবে নিয়ে গেছে। কাজেই আমার মতে পাসপাের্ট অফিসে খোঁজ নেয়া খুবই জরুরী। অফিসিয়েলী এইসব কাজে অনেক সময় লাগে। দালাল ধরলে এক সপ্তাহের মধ্যে জানতে পারবে । হাজার খানিক টাকা খরচ হবে । 

অপেক্ষা পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

হাজার খানিক না- ফিরােজের তিন হাজার টাকা খরচ হল । তিন হাজার টাকার বিনিময়ে জানা গেল— হাসানুজ্জামানের নামে কোন পাসপাের্ট ইস্যু হয়নি। 

একজন গম্ভীর মুখে বলল— মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে ডেডবডি কেনা হয় আপনি জানেন ? সাধারণত কেনা হয় বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিস লাসের একটা ভাল মার্কেট বাংলাদেশে আছে। ঐসব জায়গায় খোঁজ নিয়েছেন ? খোজটা নিতে হবে গােপনে। ডােমদের মাধ্যমে। এইসব বিজনেসে অনেক হুস হাস ব্যাপার আছে। 

‘হস হাস ব্যাপার মানে ?’ 

‘ফিসি ব্যাপার। আমার এক দূর সম্পর্কের রিলেটিভ, সম্পর্কের চাচা—তার বড় ছেলে হঠাৎ হারিয়ে গেল। ওদের টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না। বিরাট ক্ষমতাবান। এরা প্রায় তােলপাড় করে ফেলল । যাকে বলে 

কম্বিং অপারেশন। শেষে ছেলেটার ডেডবডি কোথায় পাওয়া গেল জানেন? 

‘কোথায় ? 

‘মেডিক্যাল কলেজের ডিসেকসান রুমে । ছাত্র-ছাত্রীরা ডেডবডি কাটাকুটি করছে—- লিভার এক জায়গায়, কিডনী আরেক জায়গায়। হার্ট আরেক গামলায়। কাজেই খোঁজ খবর যখন করছেন ভালমত করেন– Leave no stone unturned.’ 

ফিরােজ এখন ক্লান্ত এবং বিরক্ত! বিরক্তিটা কার উপর সে জানে না। সম্ভবত তার ভাইয়ের উপর। মানুষটা হারিয়ে গিয়ে সবচে বড় বিপদে তাকে ফেলে দিয়ে গেছে। দুপুর দু’টায় ক্ষিধে পেটে পৃথিবীর সবচে বােরিং মানুষটার সামনে তাকে হাসিমুখে বসে থেকে পরকাল, ইএসপি, ক্লেরিওভান্স, এসট্রেল, প্রজেকসন সম্পর্কে গল্প শুনতে হচ্ছে। কোন মানে হয় ? কোন মানে হয় না। ফিরােজের এখন ইচ্ছা করে নিজেরই নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে । এক সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খাবে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। তারপর ভাল একটা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে হাসি মুখে ঘর থেকে বের হওয়া এবং আর ফিরে না আসা । 

অপেক্ষা পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

রকিব সাহেব বাসায় ছিলেন। একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, আব্দুর জ্বর শুয়ে আছে। ফিরােজ বলল, আমি কি চলে যাব ? ছেলেটি বলল, আপনাকে বসতে বলেছে। 

রকিব সাহেব এক ঘণ্টা পর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে উপস্থিত হলেন। ফিরােজ উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনার নাকি জ্বর ? 

রকিব সাহেব বললেন, শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে। পর পর কয়েকদিন রাত জাগলাম। বয়স হয়েছে আগের মতাে রাত জাগতে পারি না। 

ফিরােজ বলল, আমার ভাইয়ের ব্যাপারে কোন ইনফরমেশন কি পেয়েছেন? 

রকিব সাহেব হাসি মুখে বললেন– চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে পেয়ে যাব। আমাদের ইনফরমেশন গেদারিং টেকনিকটা একটু আলাদা। আমাদেরতাে ফ্যাক্স মেইল, ই মেইল নেই। আমাদের যােগাযােগটা হয় মানসিক ভাবে ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *