অপেক্ষা পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

ছােট চাচা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন- আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। তুই কলাটা এখনাে খাস নি?

অপেক্ষা

‘আমাকে দে খেয়ে ফেলি—ক্ষিধেয় চোখে অন্ধকার দেখছি।’ 

ফিরােজ কলা খেয়ে বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল । ইমন ছােট চাচার মাথার কাছে জেগে বসে রইল। তার মনে হচ্ছে জেগে থাকাটা খুব দরকার । বেঞ্চটার পাশে চওড়া কম। ছােট চাচা যে কোন সময় গড়িয়ে পড়ে যেতে পারেন। পাহারা দেয়ার জন্যে তাকে জেগে থাকতে হবে । 

তার একটা বােন হয়েছে অথচ তার নাম রাখা হয় নি এই চিন্তাটাও তাকে অভিভূত করছে। সবারই নাম আছে শুধু তার বােনটার কোন নাম নেই। যদি নাম রাখতে ভুলে যায়, যদি কোনদিনই তার নাম না রাখা হয় তাহলে কি হবে ? মন খারাপ করে বেচারী ঘুরে বেড়াবে। কেউ তাকে খেলতে ডাকবে 

কি করে ডাকবে, মেয়েটারতাে নামই নেই। আজ সারাদিন নানান রকম ভয়াবহ সমস্যা ইমন পার করেছে, তার চোখে এক ফোটা পানি আসে নি। এখন এই ভাের রাতে বােনটার দুঃখে তার চোখে পানি এসে গেল। সে যতবারই সার্টের হাতায় চোখ মুছে ততবারই চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। তার একটা বােন হয়েছে সেই বােনটার নাম নেই কেন ? 

অপেক্ষা পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে চিকন করে কাটা এক টুকরা শশা। ছােট চাচা বলেছেন কচ্ছপের বাচ্চারা শশা খায়। ইমনের ধারণা কচ্ছপের বাচ্চারা শশা খায় না। সে অনেকক্ষণ ধরেই শশা হাতে বসে আছে তার কাছ থেকে তাে খাচ্ছে না। বরং শশার টুকরা মুখের কাছে ধরতেই এরা মুখ হাত পা খােলসের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে শশা ওদের জন্যে ভয়ংকর কোন খাবার। মানুষের বাচ্চাদের কাছে দুধ যেমন ওদের কাছে শশাও তেমন। 

কচ্ছপের বাচ্চা দু’টা ইমনের জন্যে এনেছে তার ছােট চাচা। এরা বেশীর ভাগ সময় থাকে বাথরুমে লাল প্লাষ্টিকের বালতিতে। মাঝে মাঝে ইমনের যখন খেলতে ইচ্ছে করে তখন সে বালতি থেকে তুলে আনে। পানি থেকে তােলার সময় তার একটু ভয় ভয় করে। কামড় দেয় কি-না। এখন পর্যন্ত কামড় দেয়নি। ছােট চাচা বলেছেন- কচ্ছপের বাচ্চাদের দাঁত নেই বলে তারা কামড়ায় না। যখন তারা বড় হবে, দাঁত উঠবে তখন কামড়াবে। তখন তাদের আর বালতিতে রাখা যাবে না- নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। যে নদীতে কচ্ছপ ফেলা হবে সেই নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। ঢাকা নগরী বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। 

ইমনের আজ স্কুল নেই । সে সকাল থেকেই কচ্ছপের বাচ্চা নিয়ে খেলছে। এদের সে নামও দিয়েছে-বড়টার নাম টম, ছােটটার টমি। এরা দু’জন একসঙ্গে থাকলেও দু’জনের মধ্যে কোন মিল নেই । শুকনায় ছেড়ে দেয়া মাত্র দু’জন দু’দিকে হাঁটতে থাকে। ইমন বই এ পড়েছিল কচ্ছপরা আস্তে হাঁটে। এখন সে জানে এটা মিথ্যা কথা। এরা চারপায়ে বেশ দ্রুত হাঁটে। মুহূর্তের মধ্যে ঘরের কোনায় চলে যায়। তাদের তখন খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়। সবচে বেশী দ্রুত হাটে টমি। ইমন ভেবে রেখেছে তার ছােট বােনটা যখন আরেকটু বড় হবে তখন তাকে সে একটা কচ্ছপের বাচ্চা দিয়ে দেবে। ইমনের ছােট বােনের নাম- সুপ্রভা। মা বলেছেন, সুপ্রভা নামের মানে হচ্ছে সুন্দর ।

অপেক্ষা পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

সকাল। Good Morning. কিন্তু ছােট চাচা বলেছেন সুপ্রভা মানে সুন্দর আলাে । কারটা ঠিক সে জানে না। ইমন ঠিক করে রেখেছে কোন একদিন সে তাদের মিসকে জিজ্ঞেস করবে। 

সুপ্রভা এখনাে খুবই ছােট। বেশীর ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে তখন সে কাঁদার জন্যে জাগে। খানিকক্ষণ। কেঁদে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ইমন তার সারা জীবনেও এমন কাঁদুনে বাচ্চা দেখেনি। সবচে মজার ব্যাপার হচ্ছে সুপ্রভা কারাে উপর রাগ করে বা ব্যথা পেয়ে কাঁদে না। কোন রকম কারণ ছাড়া কাঁদে। সুপ্রভার কান্না দেখতে ইমনের খুব ভাল লাগে। সে মাঝে মাঝে সুপ্রভার কান্না দেখতে যায়। কিন্তু বেশীক্ষণ দেখতে পারে না, কারণ তার মা কঠিন গলায় বলেন, এখানে কি করছ? যাওতাে—অন্য খানে যাও। আশ্চর্য, এত বিরক্ত করে। 

আগে ইমন কখনাে তার মা’কে ভয় পেত না, এখন পায়। কারণ মা’র মেজাজ সারাক্ষণ খারাপ থাকে। আগে মা তাকে পড়াতে বসতাে—এখন বসায়

সে যদি বই খাতা নিয়ে মা’র কাছে যায় মা বলে, অনেক বিরক্ত করেছ এখন যাও তাে। অথচ সে কাউকেই বিরক্ত করে না। এমন কি কচ্ছপগুলিকেও

কোন কচ্ছপ যদি দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে—সে তাকে লুকিয়ে থাকতে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বের করে আনে না। ওরা কচ্ছপ হলেও ওদেরও হয়ত লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছা করে। সে কেন ওদের খেলা নষ্ট করবে ? 

হােম ওয়ার্ক করার জন্যে সে এখন যায় ছােট চাচার কাছে। ছােট চাচা তাকে মােটামুটি আদরই করেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন হার্ড নাট। হার্ড মানে হচ্ছে শক্ত, আর নাট হল বাদাম। হার্ড নাট হল শক্ত বাদাম। ছােট চাচা তাকে কেন শক্ত বাদাম বলে তা সে জানে না। কখনাে জিজ্ঞেস করে নি। কোন একদিন জিজ্ঞেস করবে। ছােট চাচা পড়াতে পড়াতে প্রায়ই বলে—কিরে হার্ড নাট, মন খারাপ? 

অপেক্ষা পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

সে বলে, না। কারণ তার মন খারাপ থাকে না, আবার মন ভালও থাকে । সুপ্রভার সঙ্গে সে যদি গল্প করতে পারত তাহলে তার মন ভাল থাকতাে। বা মার সঙ্গে গল্প করতে পারলেও মন ভাল থাকতাে। মা গল্পতাে করেই না, সামনে গিয়ে দাড়ালেও বলে- “যা ভাগ। সামনে থেকে যা। শুধু বিরক্ত শুধু বিরক্ত। একদিন ঠাশ করে একটা চড়ও মারলেন, আচমকা মারলেন বলে সে মেঝেতে পড়ে গেল। ঠোট কেটে রক্ত বের হতে লাগল। তারপরেও সে একটুও কাঁদে নি, শুধু ডাক্তার যখন ঠোট সেলাই করতে গেলেন—তখন 

কাদল। তারপরেও ডাক্তার বললেন, বাহ দারুণ ছেলেতাে। ছেলের খুব সাহস। ছােট চাচা বললেন, সাহস হবে না, এ হল হার্ড নাট! এ মােটেই সহজ জিনিস। 

রিকশায় ফেরার পথে ছােট চাচা তাকে আইসক্রীমের দোকানে নিয়ে গেলেন ! কাপ আইসক্রীম কিনে দিয়ে বললেন, শােন হার্ড নাট। তাের মা’র মেজাজতাে এখন খুব খারাপ থাকে। এখন তাকে বিরক্ত করবি না। 

ইমন অবাক হয়ে বলল, আমিতাে তাকে বিরক্ত করি না। 

‘জানি তুই বিরক্ত করিস না। তারপরেও যখন বিরক্ত হয় তখন আমাদের উচিত একটু দূরে দূরে থাকা। 

‘মা’র মেজাজ কখন ঠিক হবে চাচা ? ‘তাের বাবা ফিরে এলেই মেজাজ ঠিক হবে।’ ‘বাবা কখন ফিরবে ? 

‘এখনাে ঠিক বলা যাচ্ছে না তবে ফিরবেতাে বটেই। কত দিন আর বাইরে থাকবে ? 

বাবা এখন কোথায় ? ‘আমরা এখনাে ঠিক জানি না মনে হয় ইণ্ডিয়ায়। ‘ইণ্ডিয়াতে ? 

হু। ইণ্ডিয়ার মধ্যপ্রদেশে। সেখানে খুব জঙ্গলতাে। আমার মনে হয় বনে জঙ্গলে ঘুরছে। বাসার কথা একসময় মনে পড়বে তখন হুট করে চলে আসবে।’ 

ইমনের ধারণা ছােট চাচা ঠিক কথা বলছেন না। বাবা ইণ্ডিয়ার মধ্যপ্রদেশে থাকলে ছােট চাচা গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসতেন। বাবা অন্য কোথাও আছেন । খুব কাছেই কোথাও। ইমন যখন রিকশা করে স্কুলে যায় তখন তিনি হয়ত আড়াল থেকে দেখেন। তাদের স্কুলে যখন টিফিনের ছুটি হয় তারা মাঠে খেলতে থাকে তখনও তিনি দেখে যান। একদিন তিনি চলে আসবেন এ ব্যাপারে ইমন নিশ্চিত। এত দেরী হচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে

অপেক্ষা পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

বেশী দেরী হলে কচ্ছপগুলি দেখতে পারবেন না। কচ্ছপগুলি বড় হয়ে যাবে। তাদের ফেলে দিয়ে আসতে হবে বুড়িগঙ্গায়। ওরা নদীর পানির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে সমুদ্রে। বঙ্গোপসাগরে। সেখান থেকে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে। ছােট চাচা তাই বলেছেন। 

বাবা সম্পর্কে লােকজন প্রায়ই তাকে জিজ্ঞেস করে। তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও সে সহজ ভাবেই জবাব দেয় । তাদের ক্লাসের মিস (মিস ফারজানা, দেখতে খুব সুন্দর ।) একদিন টিফিন টাইমে তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইমন তােমার বাবা নাকি তােমাদের ছেড়ে চলে গেছেন? 

ইমন বলল, উনি বেড়াতে গেছেন। ‘বেড়াতে গেছেন ? কোথায় বেড়াতে গেছেন ? 

ইণ্ডিয়াতে- মধ্যপ্রদেশে। মিস ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, মধ্যপ্রদেশে? এত জায়গা থাকতে মধ্যপ্রদেশে কেন ? 

মধ্যপ্রদেশে অনেক বড় বড় জঙ্গল। বাবা জঙ্গল দেখতে গেছেন।’ 

ও আচ্ছা, খুব ভাল কথা। উনি কি তােমার মা’র সঙ্গে রাগ করে চলে গেছেন? 

জ্বি-না। বাবা কারাের সঙ্গে রাগ করে না। ‘তােমার মা, তিনি রাগ করেন ? ‘জ্বি করেন। 

কা’র সঙ্গে রাগ করেন ? ‘বুয়ার সঙ্গে করেন, ছােট চাচার সঙ্গে করেন। মা রােগাতাে এইজন্যে মা’র অনেক রাগ। রােগা মানুষদের খুব রাগ থাকে।’ 

‘রােগা মানুষদের খুব রাগ থাকে এটা কে বলল ? ‘ছােট চাচা বলেছেন। উনিও রােগা এই জন্যে উনারও খুব রাগ। ‘আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।’

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *