ইমন মা’র রাগের জন্যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। টিভিতে কার্টুন দেখার সময় সাউণ্ড খুব কমিয়ে দেয়। মা খুব যখন হৈ চৈ করতে থাকেন তখন সে টিভির সাউণ্ড পুরােপুরি অফ করে দেয়।
সাউন্ড ছাড়া কার্টুন দেখতে তার খারাপ লাগে না। সাউন্ডগুলি ভেবে নেয়। কোন দৃশ্যে কি রকম সাউন্ড হবে এখন সে মােটামুটি জানে।।
মা যখন অন্যদের উপর রাগ করে তখন ইমনের তেমন খারাপ লাগে না, কিন্তু যখন সুপ্রভার উপর রাগ করেন তখন খুব খারাপ লাগে, কাঁদতে ইচ্ছা করে। সুপ্রভার উপর মা প্রায়ই রাগ করেন।
সুপ্রভা কেঁদে গলা ফাটিয়ে ফেলছে- মা ফিরে তাকাচ্ছেন না। বুয়া এসে যদি বলে—আপু কানতাছে। তখন মা তীব্রগলায় বলেন, কাঁদছে কাঁদুক তুমি তােমার কাজ কর। কাজ ফেলে চলে এসেছ কেন? ছােট চাচা এক সময় উঠে এসে বলেন, ভাবী বাচ্চাটার কি হয়েছে ? মা তখন বিরক্ত গলায় বলেন, জানি
কি হয়েছে। ওর মনের খবর আমি জানব কি ভাবে ?
কাঁদতে কাঁদতেতাে গলা ভেঙ্গে ফেলছে। ‘গলা ভেঙ্গে মরুক। ‘ভাবী এইসব কি কথা বলছেন?
আমার যা মনে আসছে বলছি, তােমাদের অসুবিধা হচ্ছে ? ‘হ্যা, অসুবিধা হচ্ছে। বাচ্চাটা পেটের ক্ষিধেয় কাঁদছে, আপনি ফিরে তাকাচ্ছেন না, এটা কেমন কথা।’
‘তুমি এমন চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলছ কেন ? তােমার ভাইতাে কখনাে মুখ শক্ত করে এমন ভাবে কথা বলেনি।
‘চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলার জন্যে আমি সরি। ভাবী শুনুন, ফর গডস সেক, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার চেষ্টা করুন।
‘স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার চেষ্টা করার মত অবস্থা কি আমার আছে ? | ‘ভাইজানের জন্যে কষ্ট শুধু আপনি একা পাচ্ছেন আর কেউ পাচ্ছে না এটা আপনি কি করে ভাবছেন ? কষ্ট পাচ্ছেন ভাল কথা-কিন্তু একটা দুধের শিশুকে কষ্ট দেবেন কেন ? তার অপরাধটা কোথায় ?
‘খবর্দার, তুমি আমার সঙ্গে চোখ লাল করে কথা বলবে না।
ভাবী আমি চোখ লাল করে কথা বলছি না, আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি- ওকে দুধ খেতে দিন।’
নাটক করবে না। নাটক আমার ভাল লাগে না—একে তােমরা নিয়ে কোথাও পালক দিয়ে দাও।’
‘আচ্ছা ভাবী ঠিক আছে, তাই করব। আপাতত আপনি একে সামলান।
এই পর্যায়ে মা সুপ্রভাকে কোলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না থেমে যায়। তখন কান্না পেয়ে যায় ইমনের। সে ছােট চাচার ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছােট চাচা গম্ভীর গলায় বলেন, ইমন তােকে কেউ মেরেছে ?
ইমন ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলে, না। মারে নি। ‘তােকে কেউ বকা দিয়েছে ?
‘তাহলে কাঁদছিস কেন? ‘জানি না।’ ‘পুরুষ মানুষ কি কাঁদতে পারে ?
‘ফোস ফোস করতে পারে ?
‘হেঁচকি তুলতে পারে ?
‘তুইতাে একই সঙ্গে কাঁদছিস, ফোস ফোস করছিস এবং হেঁচকি তুলছিস। তিনটা নিষিদ্ধ জিনিশ করছিস। চোখ মুছে কচ্ছপ নিয়ে আয়—একটা মজা দেখাব।’
‘কি মজা ?’ ‘আগে নিয়ে আয়, তারপর দেখবি।’
ইমন কচ্ছপ নিয়ে এল । ফিরােজ কচ্ছপ দু’টা উল্টা করে মেঝেতে রেখে দিল। এরা খােলসের ভেতর থেকে মাথা এবং পা বের করে সােজা হবার চেষ্টা করছে, পারছে না। ফিরােজ হৃষ্ট চিত্তে বলল, এই হচ্ছে মজা।
‘কি মজা?’ ‘যত চেষ্টাই করুক, এরা এখন আর সােজা হতে পারবে না। ছটফট করবে কিন্তু পারবে না। বাইরের কোন সাহায্য লাগবে। তুই বা আমি যদি সােজা করে দি, তাহলেই সােজা হতে পারবে । মজাটা এইখানেই। মানুষেরও মাঝে মাঝে কচ্ছপের মত অবস্থা হয়। মানুষ উল্টে যায়। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করতে থাকে, ঠিক হতে পারে না। বাইরের সাহায্য ছাড়া ঠিক হওয়া তখন সম্ভব না। তাের মা’র এখন এই অবস্থা চলছে। সে উল্টে গেছে। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করছে, কিন্তু পারছে না। কাজেই তাের মা’র উপর রাগ করেও কোন লাভ নেই। মা’র উপর তাের রাগ নেইতাে ?’
না নেই।’ ‘ভেরীগুড। আরেকটা কথা- যদি কোন কারণে খুব মন খারাপ হয় তখন কচ্ছপ উল্টে দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবি- তখন দেখবি মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।
‘কেন ?’ ‘কেন কেন করবি না। চড় খাবি।’
‘আচ্ছা করব না।
আজ ইমনের মন সামান্য খারাপ। বেশী না সামান্য। এই সামান্য মন খারাপ নিয়ে কচ্ছপ উল্টানাে যায় না বলে সে উল্টাচ্ছে না- শশার টুকরা কেটে খেতে দিচ্ছে। এরা খাচ্ছে না। হাতে ধরে থাকলে এরা খায় না, কিন্তু পানিতে ছেড়ে দিলে মুখ বের করে কুট কুট করে খায়।
ইমন। এদিকে শুনে যাও।’
ইমনের বুক ধ্বক করে উঠল। আগে মা ডাকলে আনন্দ লাগতাে, এখন মা ডাকলেই বুক ধ্বক করে উঠে। ইমন কচ্ছপ দু’টা বালতিতে রেখে মা’র ঘরের দরজা ধরে দাঁড়াল। মা সুপ্রভার গায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। তিনি চোখ সরু করে তাকালেন। ইমনের বুক শির শির করতে লাগল।
জা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন ? কাছে আস। ইমন ঘরে ঢুকল।
‘হাত ভেজা কেন ? আবার কচ্ছপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলে ? হাত ধুয়ে এসেছ?’
হ্যা।’ ‘সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছ ?
ইমন সাবান দিয়ে হাত পােয়নি-তারপরেও ভয়ে ভয়ে হঁ সূচক মাথা নাড়ল। সে জানে এই মিথ্যা মাথা নাড়ার জন্যে তার বাঁ কাধের ফেরেশতা পাঁচটা ‘বদি’ লিখেছে। ফেরেশতার নাম কেরামান কাতেবিন। তার কাজ মানুষের খারাপ কাজগুলি লেখা এবং কোন খারাপ কাজের জন্যে কয়টা বদি হয়েছে তার হিসাব রাখা। দাদীজান তাকে বলেছেন।
‘দেখি হাত কাছে আন। সাবানের গন্ধ আছে কি-না দেখি।
ইমন হাত এগিয়ে দিল। মা গন্ধ শুকলেন। মনে হল তিনি সাবানের গন্ধ পেয়েছেন। কারণ কিছু বললেন না। সাবানের গন্ধ পাওয়ার কথা না। সে হাতে সাবান মাখে নি। কচ্ছপ ঘাটা ঘাটি করেছে। মনে হয় কচ্ছপের গায়ে সাবানের গন্ধ আছে। কচ্ছপ শুকে দেখতে হবে ।
‘সুরাইয়া বলল, তােমার বােনটা দেখতে কি রকম হয়েছে ? কার মত হয়েছে?
ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, ছােট বাচ্চাদের মত হয়েছে।
‘বােকার মত কথা বলছ কেন? ছােট বাচ্চাতাে ছােট বাচ্চার মতই হবে । বুড়ােদের মত হবে নাকি ? দেখতে কার মত হয়েছে ? তােমার মত, না আমার মত, নাকি তােমার বাবার মত ?
‘জানি না মা।’
‘জানবে না কেন ? দেখতে হয়েছে অবিকল তােমার বাবার মত। তােমার বাবার নাক অনেকটা চাপা। এই দেখ এর নাকও চাপা। চাপা না?’
ইমন বুঝতে পারছে না, নাক চাপা কি চাপা না। তার কাছেতাে নাকটা সুন্দরই লাগছে। তারপরেও বলল, হুঁ।
সুরাইয়া ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন তােমাকে আমি কি বলব মন দিয়ে শুনবে। আমরা এই বাড়িতে থাকব না।
ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, কোথায় যাব ?
‘তােমার বড় মামার বাড়িতে গিয়ে থাকব । তােমার বড় মামা তাঁর বাড়ির একটা ঘর আমাকে দিয়েছেন। একটা ঘরইতাে আমাদের জন্যে যথেষ্ট। কি, যথেষ্ট না ?
‘এ রকম মুখ শুকনা করে হুঁ বলছ কেন ? বড় মামার বাড়িতে থাকতে তােমার অসুবিধাটা কি ? আর যদি অসুবিধা থাকেও কিছু করার নেই। তােমার বাবার কোন খোঁজ নেই। কাজেই তােমাদের কপাল ভেঙ্গেছে। আমাদের জীবন কি ভাবে কাটবে জান ? আজ এই বাড়ি, কাল ঐ বাড়ি।
ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, এই বাড়িতে কেন থাকবনা মা ?
‘এই বাড়িতে থাকব না, কারণ তােমার ছােট চাচার কোন চাকরি বাকরি নেই। এতদিন সংসার চলেছে গ্রামের বাড়ির ধানী জমি বিক্রি করে। এই ভাবে আর কতদিন চলবে ? তাছাড়া তােমার ছােট চাচা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। চোখ লাল করে আমার দিকে তাকায়। তার এত সাহস কেন হবে ? যেখানে তােমার বাবা কোনদিন আমার দিকে চোখ লাল করে তাকায় নি- সেখানে সে তাকাবে কেন ?
‘বড় মামার বাসায় কবে যাব মা ?’
‘এক সপ্তাহের মধ্যেই যাব। তােমার বই খাতা তুমি নিজে সব গুছিয়ে নেবে।